ট্রাম্প যুগে বেঁচে থাকার তরিকা

জোসেফ ই স্টিগলিৎস
জোসেফ ই স্টিগলিৎস

কেবল এক মাস হলো, এর মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলার জাল ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি যে ভীতি ছড়িয়েছেন, তাতে সন্ত্রাসীরাও গর্ব বোধ করবেন। বিস্ময়ের কিছু নেই, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নাগরিক সমাজের নেতারা এবং সরকার যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করছে।
ভবিষ্যৎ নীতি সম্পর্কে যেকোনো দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যম্ভাবীরূপে সাময়িক। কারণ, ট্রাম্প এখনো আইনের বিস্তারিত রূপ প্রস্তাব করেননি। ওদিকে কংগ্রেস ও আদালত ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের বিপরীতে এখনো পুরোপুরি মাঠে নামেনি। কিন্তু অনিশ্চয়তার স্বীকৃতি দেওয়া মানে অস্বীকারের সত্যতা প্রতিপাদন করা নয়।
এর বিপরীতে এখন এটা পরিষ্কার, ট্রাম্প যা বলেন ও টুইট করেন, তা অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। নভেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর এক সর্বজনীন আশা সৃষ্টি হয়েছিল যে নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি যে চরমপন্থার দ্বারস্থ হয়েছিলেন, এবার তা পরিহার করবেন। নিশ্চিতভাবে লোকে আশা করেছিল, অবাস্তবতার শিরোমণি ট্রাম্প যখন এই বিপুল দায়িত্বভার কাঁধে নেবেন, যেটাকে প্রায়ই দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী পদ বলা হয়, তখন তিনি এক ভিন্ন ব্যক্তিত্বে পরিণত হবেন।
প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের বেলায় একই ব্যাপার ঘটে। মানুষ নতুন প্রেসিডেন্টকে ভোট দিক না দিক, সবাই তাঁর ওপর নিজের ইচ্ছা প্রয়োগ করেন, অর্থাৎ তাঁর কেমন হওয়া উচিত। কিন্তু যেখানে প্রায় সব নির্বাচিত প্রতিনিধি সবাইকে আশ্বাস দেন, সেখানে ট্রাম্প এমন সন্দেহ রাখেননি যে তিনি যা বলেছেন, তা করবেন না: মুসলমানদের অভিবাসনের ওপর নিষেধাজ্ঞা, মেক্সিকোর সীমান্তে দেয়াল তৈরি, নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট নিয়ে পুনঃ আলোচনা, ২০১০ সালের ডড-ফ্রাঙ্ক আর্থিক সংস্কার বাতিলসহ আরও অনেক কিছু, যেগুলো তাঁর সমর্থকেরাও বাতিল করে দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তরকালে জাতিসংঘ, ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত যেসব নীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল, আমি প্রায়ই সেগুলোর বিভিন্ন দিকের সমালোচনা করেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করে ভালো কাজে নিয়োজিত করা আর তাদের একদম ধ্বংস করে ফেলা—এই দুটির মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে।
ট্রাম্প জিরো-সাম গেমের (যেখানে একজন ততটাই জেতে, আরেকজন ঠিক যতটা হারায়) পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীকে দেখে থাকেন। বাস্তবতা হলো, বিশ্বায়নকে যদি ঠিকঠাক পরিচালনা করা যায়, তাহলে তা ইতিবাচক ব্যাপার হবে।
যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হবে যদি তার বন্ধু ও মিত্ররা শক্তিশালী হয়, তা সে অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা মেক্সিকো যেই হোক না কেন। কিন্তু ট্রাম্পের যা মনোভাব, তাতে এটা নেগেটিভ-সাম গেম হতে পারে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রও হারাবে।
অভিষেক বক্তৃতায় ট্রাম্পের এই মনোভাব পরিষ্কার হয়ে গেছে। বক্তৃতায় তিনি বারবার বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম’, যার মধ্যে সেই ঐতিহাসিক ফ্যাসিস্ট সুর ছিল। এর মধ্য দিয়ে সবচেয়ে কদর্য পরিকল্পনার প্রতি তাঁর অঙ্গীকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আগের মার্কিন সরকারগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে মার্কিন স্বার্থ এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তারা যে নীতির ভিত্তিতে তা করত, সেটা মার্কিন স্বার্থবিষয়ক আলোকিত উপলব্ধির ভিত্তিতে প্রণীত হতো। তারা বিশ্বাস করত, সমৃদ্ধিশালী বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে জোট বা মৈত্রী থাকলে যুক্তরাষ্ট্র উপকৃত হবে, যে দেশগুলো গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ।
ট্রাম্প নামক মেঘের কোণে যদি আশার আলো থাকে, তাহলে সেটা হচ্ছে সমতা ও সহিষ্ণুতা-বিষয়ক নতুন উপলব্ধি, যার চালিকাশক্তি হচ্ছে অন্ধত্ব ও নারীবিদ্বেষ, তা প্রকাশ্য বা গোপন যা-ই হোক না কেন। কথা হচ্ছে, ট্রাম্প ও তাঁর দলবল এই ধারণার প্রতিমূর্তি। এই সংহতি বৈশ্বিক রূপ নিয়েছে, যেখানে ট্রাম্প ও তাঁর মিত্ররা গণতান্ত্রিক পৃথিবীতে প্রতিবাদের সম্মুখীন হচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন দ্রুতই বুঝতে পেরেছে, ট্রাম্প শিগগিরই ব্যক্তি অধিকার পায়ে মাড়াবেন। গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক নীতি যেমন, যথাযথ প্রক্রিয়া, সমান সুরক্ষা, ধর্মবিষয়ক আনুষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা—এসব রক্ষায় তারা আগের যেকোনো সময়ের মতোই তৎপর। আর গত মাসে মার্কিন নাগরিকেরা এই লিবার্টিস ইউনিয়নকে লাখ লাখ ডলার দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।
একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানির কর্মী ও ক্রেতারা সিইও ও পর্ষদ সদস্যদের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছেন। কারণ, তাঁরা ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন। বস্তুত, গোষ্ঠী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট নেতারা ও বিনিয়োগকারীরা ট্রাম্পের হাত শক্তিশালী করছেন। এবার দাভোসের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে অনেকেই কর হ্রাস ও নিয়ন্ত্রণ শিথিলের ব্যাপারে অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু আমি যেসব বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম, তার কোনোটিতে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি।
আরও উদ্বেগের ব্যাপার হলো, সাহসের অভাব। এটা পরিষ্কার ছিল যে যাঁরা ট্রাম্পের ব্যাপারে ভীত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই তাঁর বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হচ্ছেন না, পাছে তাঁরা টুইটের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সর্ব ব্যাপক ভীতি। লায়েক হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথম আমি এ জিনিসটি দেখছি।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বস্থানীয় গণমাধ্যম যেমন, নিউইয়র্ক টাইমস ও দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের কীর্তিকলাপকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়নি, অর্থাৎ তাঁর মার্কিন মূল্যবোধ অস্বীকারের বিষয়টি। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মানবেন না, এটা স্বাভাবিক নয়।
একই সঙ্গে, জাতীয় নিরাপত্তা নীতি প্রণয়নের একদম মূল ব্যক্তি অর্থাৎ জ্যেষ্ঠ সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়াও স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। ট্রাম্পের প্রচারণা কট্টর ডানপন্থী। উত্তর কোরিয়ার সাম্প্রতিক ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পরিপ্রেক্ষিতে যা হলো, সেটা তাঁর মেয়ের ব্যবসায়িক স্বার্থের অনুকূল।
কিন্তু আমরা যখন প্রতি পদে পদে গ্রহণযোগ্যতার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া ঘটনা ও সিদ্ধান্ত দ্বারা বাধাগ্রস্ত হই, তখন অনুভূতি হারিয়ে ফেলা সহজ হয়ে ওঠে। এই নতুন যুগের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে সতর্ক থাকা। আর যখন যেখানে প্রয়োজন হবে, সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ।