আসুন, পাপড়ি, অনন্যা আর সম্রাটের পাশে দাঁড়াই

পাপড়ি খাতুন ও অনন্যা খাতুন বড় কোনো অন্যায় করেননি। তাঁরা সন্ত্রাসী নন, কোনো হত্যা মামলার দাগি আসামি নন, কোনো চুরি বা ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গেও তাঁরা জড়িত নন। তবু ১২ বছর ধরে এই দুই বোন বন্দী জীবন যাপন করছেন। কারণ, তাঁদের পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাঁদের অপরাধ, তাঁরা মানসিক প্রতিবন্ধী। পরিবারের সদস্যরাই তাঁদের এভাবে বেঁধে রেখেছেন। আর যেকোনো উপায় তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়েই তাঁদের বেঁধে রাখতে হচ্ছে। যেহেতু মানসিক ভারসাম্য নেই, তাই ছেড়ে দিলেই ওই দুই বোন মানুষের বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়ে তাদের খাবারদাবার খেয়ে ফেলাসহ নানা সমস্যা করেন। তাই পায়ে শিকল পরিয়ে রাখা।

২২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় ছাপা হয় পাপড়ি ও অনন্যার দুর্বিষহ জীবনের কথা। জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার আদারভিটা গ্রামে জরাজীর্ণ ও দুর্গন্ধযুক্ত একটি ঘরে ওই দুই বোনের বাস। চিকিৎসা ও যত্নের অভাবে তাঁরা দুর্বল হয়ে পড়েছেন। থাকেন একই বিছানায়। বিছানাই তাঁদের জগৎ। বিছানাতেই তাঁদের ঘুম, খাওয়াদাওয়া আর মলমূত্র ত্যাগ। তাঁদের দেখাশোনা করেন তাঁদের ভাই সম্রাট, যাঁর বয়স কিনা মাত্র ১৯ বছর। মা-বাবা নেই, তাই দুই বোনকে দেখাশোনার ভার পড়েছে সম্রাটের ওপর। বোনদের খাইয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে তাঁদের মলমূত্র পরিষ্কার তাঁকেই করতে হয়।

পত্রিকা থেকে জানা যায়, আদারভিটা উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ১৯৯৯ সালে পাপড়ি খাতুন আর ২০০১ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় অনন্যা খাতুনের আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। একপর্যায়ে তাঁরা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বন্ধ হয় লেখাপড়া। পাবনা মানসিক হাসপাতালে কয়েক মাস রেখে তাঁদের চিকিৎসা করা হয়। এরপরও ভালো না হওয়ায় সামাজিকভাবে বিব্রত হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে ২০০৪ সাল থেকে পায়ে শিকল পরিয়ে রাখা হয় তাঁদের। এখন পাপড়ির বয়স ৩৩ বছর আর অনন্যা খাতুনের ৩০ বছর। প্রতিবন্ধী দুই বোন ও ছোট এক ভাইকে নিয়ে অতি কষ্টেসৃষ্টে জীবন যাপন করছেন সম্রাট। অন্য মানুষের গরু লালনপালন করে এবং মানুষের জমিতে কৃষিকাজ করে সংসার চালান। বোনদের দেখাশোনা করা ছাড়াও রান্নাবান্নাসহ সংসারের সব কাজই তাঁকে করতে হয়। একজন চাচা ছাড়া আর কোনো আত্মীয়স্বজন তাঁদের খোঁজ রাখেন না।

পাপড়ি, অনন্যা আর সম্রাটের জীবনযুদ্ধের খবর পড়ে মনে প্রশ্ন জাগে, দেশের উন্নয়নটা ঠিক কোন জায়গায় হচ্ছে? আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছি। ২০২১ সালের মধ্যে দেশটি ডিজিটাল হয়ে যাবে। অথচ পাপড়ি ও অনন্যারা যে তিমিরে আছেন, সেই তিমিরেই রয়ে যাবেন! তাঁদের দুঃখ-দুর্দশা কারও চোখে যেন পড়ছে না। তাঁদের জন্য কারও কি কিছু করার নেই!

ভাবুন তো সম্রাটের কথা। ১৯ বছর বয়সী একটি তরুণ কী অসীম ধৈর্যের সঙ্গেই না তাঁর দুই বোনকে দেখেশুনে রাখছেন! বোনদের মতো তাঁর পায়ে লোহার শিকল পরা না থাকলেও অদৃশ্য শিকলে বাঁধা তাঁর দুটি পা। সংসার সামলাতে গিয়ে তাঁর পড়ালেখা করা আর হয়ে ওঠেনি। আমার এই লেখাটি যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের অনেকের ঘরে সম্রাটের বয়সী অনেক ছেলে আছেন। তাঁদের সঙ্গে তুলনা করুন সম্রাটকে। মানসিক প্রতিবন্ধী দুই বোনকে যেভাবে তিনি সামলে যাচ্ছেন, তা কয়টা ছেলে পারবে। কিন্তু এভাবেই কি তাঁর জীবন কাটবে? সম্রাট জানেন, মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীদেরও চিকিৎসা আছে। কিন্তু চিকিৎসা করাতে তো অনেক অর্থের প্রয়োজন। সেটা তিনি পাবেন কোথায়? যেখানে সংসার চালানোই দায়, সেখানে তিনি বোনদের চিকিৎসা করার টাকা পাবেন কোথায়? আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, কেউই তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না। সরকারও নির্বিকার। জামালপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শাহ আলম তো বলেই দিয়েছেন, এ ধরনের রোগীকে হাসপাতালে চিকিৎসা করালে তাঁরা ওষুধ সরবরাহ করে সহযোগিতা করতে পারেন। এ ছাড়া তাঁদের করার কিছু নেই।

পাপড়ি ও অনন্যার জন্য আমাদের সমাজের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু করার আছে। সরকারের যেমন এগিয়ে আসা উচিত, তেমনি বেসরকারি সংগঠনগুলো ও সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরা অনেক কিছু করতে পারেন। পারেন আর্থিক সহযোগিতা দিতে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। যথাযথ চিকিৎসা হয়তো এ দুই বোনকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। আসুন, আমরা সবাই পাপড়ি, অনন্যা আর সম্রাটের পাশে দাঁড়াই। এই দুর্বিষহ জীবন থেকে তাঁদের উদ্ধার করি।
রোকেয়া রহমান : সাংবাদিক