মানবতার সম্প্রীতি ও ঐক্য

সহজাত প্রবৃত্তির কারণেই মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে চায়, অপরের সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দেয়। মানুষের প্রকৃতিগত প্রেমবোধই তাকে এ আচরণে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে সে অন্যের কোনো উপকারে আসতে পারলে চেতনে-অবচেতনে অকৃত্রিম প্রশান্তি লাভ করে। তবে সামাজিক জীবন-যাপনের তাগিদে বা নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সে বিপরীতমুখী আচরণও করে। নিজেকে ক্ষমতাবান হিসেবে প্রকাশ করার লিপ্সায় মত্ত হয়। তখন উপকারের রূপ বদলে গিয়ে তা স্বার্থসিদ্ধির পন্থায় পরিণত হয়ে যায়। অথচ আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টি করে তাদের বিভিন্ন জাতি এবং গোত্রে বিভক্ত করেছেন, যাতে তারা পরস্পরকে চিনতে পারে। এ জন্য নয় যে তারা পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ও ঝগড়া-বিবাদ করবে। মানুষের মর্যাদা তার আদর্শে ও মানবিক গুণাবলির নিরিখে বিবেচিত হবে। যেমনটি পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি; যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩)

ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও প্রতিযোগিতার যুগে মানুষ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। স্বভাবে প্রত্যেক মানুষ বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, যান্ত্রিকতার যুগে লোকেরা ইসলামের মর্মবাণী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ব্যস্ত নগরের মানুষেরা কেউ যেন কারও নয়, কেউ কাউকে চেনে না, সালাম বিনিময়ের প্রয়োজন মনে করে না। পারস্পরিক শান্তি কামনা তো দূরের কথা, কারও বিপদ-আপদেও কেউ ফিরে তাকায় না, হায় রে মানুষ! আমরা যে সমাজে বাস করি, সে সমাজে মানুষে মানুষে বিশ্বাস, আস্থা, প্রেম-প্রীতি, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বুঝিবা মেঘলোকে উধাও হয়ে গেছে! সবাই যেন ভুলতে বসেছে, মানুষ মানুষের জন্য! মানুষ মানুষেরই স্বজন! মানুষে মানুষে
সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি আর জাতীয় ঐক্য-মৈত্রীর সেতুবন্ধ গড়ার প্রত্যাশায় যুগ যুগ ধরে শুভবুদ্ধিসম্পন্নদের অব্যাহত প্রচেষ্টার কাঙ্ক্ষিত সুফল আজও মেলেনি। অথচ মুসলমানদের পারস্পরিক সদয় ব্যবহার ও সহানুভূতিশীলতার দিকনির্দেশনা দিয়ে নবী করিম (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘আল্লাহ তার প্রতি সদয় হন না, যে মানুষের প্রতি সদয় হয় না।’ (বুখারি)

সভ্যতার বিকশিত সময় ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগেও মনুষ্য সমাজে সহিংসতা, রক্তপাত, হানাহানি, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসাপরায়ণতা আর উন্মাদনার যে চিত্র প্রায় নিত্য ফুটে উঠছে, এতে মানবতা আজ বিপন্ন। পৃথিবীতে মানুষের যা কিছু উদ্যোগ-উদ্যম, সবকিছুই শান্তিতে বেঁচে থাকার লক্ষ্যকে ঘিরে আবর্তিত হয়। পৃথিবী সুখময় না দুঃখময় এ নিয়ে তাত্ত্বিক বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু এ কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত যে বিশ্বে নিরাপদে বেঁচে থাকার সাধনাতেই মানুষ নিজেকে ব্যাপৃত রাখে। জানমালের নিরাপত্তাসহকারে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা মানুষের মধ্যে থাকাটাই স্বাভাবিক। অথচ শান্তির বাতাবরণ বিনষ্ট করে দেশের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে অজানা আতঙ্ক ও অশান্তির দাবানল। ইতিমধ্যে জানমালের নিরাপত্তাহীনতায় সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এবং তারা যেকোনো মূল্যে দলমতের উগ্রতা, সন্ত্রাস, হানাহানি ও রাজনৈতিক হিংস্রতার শিগগিরই অবসান চাচ্ছে।

প্রতিটি ধর্মই মানুষকে সত্য-সুন্দর-কল্যাণ ও শান্তির পথ প্রদর্শন করে, উন্নত জীবনের দিগ্দর্শন দেয় এবং পরমতসহিষ্ণুতার ওপর জোর দেয়। সুতরাং জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দলমতের বিরোধ-বিবাদের, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাহলে কেন সৃষ্টির সেরা মানুষ হয়ে মানুষেরই অনিষ্টসাধন? অহিংসা, শান্তি, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও ঐক্য-মৈত্রীর বন্ধনের জন্য চাই মানবপ্রেম। ক্ষমতার লিপ্সা ও ভোগবাদী চিন্তাধারার অপপ্রয়োগের ফলে দেশময় হানাহানি, অশান্তি, প্রভুত্ব বিস্তারের খেলা, পেট্রলবোমা ও নরহত্যার প্রতিযোগিতায় মানবতা চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত।
হিংসা-বিদ্বেষ, কলহ-বিবাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও হানাহানির পরিবর্তে যে মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে, সে-ই ভেতরে-বাইরে বড় মাপের মানুষ হতে পারে এবং আল্লাহ তার ওপর রহমত বর্ষণ করেন। পবিত্র কোরআনে ভূপৃষ্ঠে মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মনে যা আছে তা প্রকাশ করো অথবা গোপন রাখো, আল্লাহ তার হিসাব তোমাদের কাছ থেকে গ্রহণ করবেন।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৮৪)

ক্ষমতার অহংকার, আমিত্ব, ধন-সম্পদের মোহে আমরা আজ অন্ধ। গরিব-দুঃখী মানুষের সাহায্য তো দূরের কথা; বরং উল্টো জুলুম, নির্যাতন করতে দ্বিধাবোধ করছি না। সামান্য স্বার্থের জন্য অন্যের বড় ধরনের ক্ষতি করেও সুখ পাই। পার্থিব বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্টের প্রকৃত কারণ মানুষের কুকর্ম, অন্যায়, জুলুম, দুর্নীতি ও মানবতাবিবর্জিত কাজকর্ম; যা থেকে মানুষকে সম্পূর্ণভাবে কল্যাণের পথে ফিরে আসতে হবে। তাই নবী করিম (সা.) সতর্কবাণী ঘোষণা করেছেন, ‘নিজের কিংবা অন্যের কোনো ক্ষয়ক্ষতি করা যাবে না।’ (দারাকুতনি)

শান্তির পূর্বশর্ত সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও ঐক্য-মৈত্রী মানবতার সৌন্দর্য। অথচ শান্তি শব্দটি যত সহজে উচ্চারণ করা যায়, বাস্তবে এর প্রতিষ্ঠা শত-সহস্র গুণ কঠিন। কেননা শান্তি রক্ষায় মানুষকে জাগতিক এমন সব বিষয় থেকে বিরত থাকতে হয়, যা তার পক্ষে সহজসাধ্য নয়। মানুষ জন্মগতভাবে ক্ষমতালোভী, কর্তৃত্বপ্রয়াসী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রবৃত্তির বিধায় চাইলেই সে এসব মন্দ স্বভাবের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। পার্থিব লোভ-লালসা, সম্পদের মোহ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য প্রভৃতির হাতছানির কাছে মানবচিত্ত দুর্বল হয়ে
পড়ে। এসব থেকে নিজেকে বিরত রাখতে যে সংযম, ধৈর্য, বিনয় ও কৃচ্ছ্রসাধনের প্রয়োজন পড়ে, তা অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই অত্যন্ত দুরূহ বলে বিবেচিত হয়। তাই শান্তিকামী মানুষে মানুষে সম্পর্ক যত উদার, সহনশীল, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিময় হবে এবং জাতীয়
ঐক্য ও মৈত্রীর বন্ধনে শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় উপনীত হওয়া যাবে, সমাজে ততটাই সুখ-শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করবে।

. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।