ঘণ্টার গলায় বিড়াল বাঁধতেই হবে!

মধ্যযুগে সারা ইউরোপে লাতিন ভাষায় রায় লেখা হতো। উকিলেরাও সওয়াল করতেন লাতিনে। আইনশিক্ষার একমাত্র মাধ্যম ছিল লাতিন। নবজাগরণের যুগে এমন কোনো যন্ত্র কি আবিষ্কৃত হয়েছিল যে বিচারকেরা ইংরেজি, ফরাসি, জার্মানের মতো (সে যুগের নিরিখে) ‘অনুন্নত’ ও ‘বর্বর’ ভাষায় রায় লিখতে পেরেছিলেন? যে ইংরেজিতে বা ফরাসিতে প্রথম রায় লেখা শুরু হয়েছিল, সেটা নামেই শুধু ইংরেজি বা ফরাসি ছিল। লাতিন শব্দে ঠাসা ছিল সেই ইংরেজি বা ফরাসি। এখনো ইংরেজিতে লেখা আদালতের কোনো রায়ে লাতিন বা লাতিন-মূল শব্দের ছড়াছড়ি লক্ষ করা যাবে।

বাংলাতেও রায় দেওয়ার সময় একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে না কেন? রায় লেখার কাজে ব্যবহৃত যে ইংরেজি বা লাতিন শব্দগুলোর প্রচলিত এবং বোধগম্য বাংলা (এবং সংস্কৃত, ফারসি, আরবি) প্রতিশব্দ নেই, সেগুলোর ইংরেজি বা লাতিন রূপই রেখে দেওয়া
হোক, ঠিক যেমন করে ইংরেজিতে তৎসম বা তদ্ভব লাতিন শব্দ রেখে দেওয়া হয়েছিল। এই শব্দগুলোর বাংলা উচ্চারণ ও বানান কী হওয়া উচিত, সেটা ভাষাবিজ্ঞানীরা ঠিক করে দিতে পারেন।

বাংলাদেশের বিচারকদের সিংহভাগ যেহেতু বাংলা মিডিয়ামেই লেখাপড়া করেছেন, সেহেতু বাংলায় রায় লিখতে তাঁদের সমস্যা হওয়ার কোনো কারণ নেই। বিচারক নিয়োগের সময় ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় দক্ষতা থাকার যোগ্যতা বাধ্যতামূলক করে দিলেই বাংলায় রায় লেখার সমস্যার সমাধান হতে পারে। টোয়েফলের মতো কোনো পরীক্ষার মাধ্যমে ইংরেজি জ্ঞান যাচাই করা যেতে পারে। বাংলা জ্ঞান যাচাই করার জন্যও অনুরূপ পরীক্ষা উদ্ভাবন করতে পারেন ভাষাবিজ্ঞানীরা। ফরাসি ভাষায় রায় লিখতে পারেন না, এমন কোনো ব্যক্তি বিচারক হিসেবে নিয়োগই পাবেন না কানাডার কুইবেকে। জার্মানি বা জাপানে এমন বিচারক থাকা কি সম্ভব, যিনি জার্মান বা জাপানি ভাষায় রায় লিখতে পারেন না?

বাংলায় রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা সমস্যা হয়তো এই যে রায় বাংলায় লিখতে গেলে পূর্ববর্তী কোনো মামলার রায়ের গৎ কপি-পেস্ট করা সম্ভবপর হয় না। এই সমস্যা সাময়িক। একবার শুরু হলে কয়েক বছরের মধ্যেই হাজার হাজার রায় লেখা হয়ে অনুকরণযোগ্য বহু গৎ তৈরি হয়ে যাবে। যেকোনো যন্ত্রের মতো একটি ভাষা আমরা যতই ব্যবহার করব, ততই ভাষাটি ব্যবহারে আমরা চৌকস হয়ে উঠব। একটি ভাষা যত বেশি এবং যত বিচিত্র প্রয়োজনে ব্যবহৃত হবে, ততই সে ভাষাটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। পূজা নয়, ভাষা ব্যবহার দাবি করে।

বলা হয়ে থাকে যে বাংলায় রায় লেখার সময় আগের রায়ের রেফারেন্স দেওয়া সম্ভব হয় না, কারণ রায়গুলো ইংরেজিতে লেখা। ইংরেজি ভাষায় গবেষণা-পুস্তক লিখতে গিয়ে ফরাসি বা জার্মান থেকে যদি উদ্ধৃতি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, তখন কি শুধু প্রাসঙ্গিক অংশটুকু অনুবাদ করলেই চলে না? একইভাবে ইংরেজিতে লেখা রায়ের যে অংশটুকু প্রাসঙ্গিক, শুধু সেটুকুই বাংলায় অনুবাদ করে নিতে সমস্যা কী? নবজাগরণের শুরুতে নতুন ইউরোপীয় ভাষাগুলোতে রায় প্রদানের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এই পদ্ধতিই গ্রহণ করা হয়েছিল। সে যুগের বিচারকেরা নিশ্চয়ই কোনো যন্ত্র আবিষ্কারের আশায় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেননি।

আইনের শিক্ষক হাফিজুর রহমান কার্জন সম্প্রতি আশা প্রকাশ করেছেন যে তরুণ প্রজন্মের চেষ্টায় বাংলায় লেখা রায় সহজবোধ্য হয়ে উঠবে। পৃথিবীর কোনো ভাষায় লেখা আদালতের রায় সাধারণ জনগণের বোধগম্য হয় বলে মনে হয় না, কারণ আইনের ভাষা একটা বিশেষায়িত ভাষা। তবে নজরুল যদি বাংলায় রাগসংগীত রচনার মতো অসাধ্য সাধন করে উঠতে পেরে থাকেন, তবে নতুন প্রজন্মের বিচারকেরাও সহজ বাংলায় রায় লিখতে সক্ষম হবেন, যদি তাঁদের প্রতিভা ও সদিচ্ছা থাকে।

বাংলায় রায় না লেখা স্পষ্টতই বাংলাদেশের সংবিধান এবং ১৯৮৭ সালের বাংলা প্রচলন আইনের লঙ্ঘন। বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানই সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে নয়, এমনকি আদালতও নন। আমলাদের ধন্যবাদ দিতে হবে, কারণ তাঁরা প্রশাসনে বাংলা প্রচলন করতে সক্ষম হয়েছেন। আশার কথা, কোনো কোনো বিচারক বাংলায় রায় দিচ্ছেন। বছরখানেক আগে এক উকিল বন্ধুর কাছে ঢাকা হাইকোর্টের এমন এক বিচারকের কথা শুনেছিলাম, যিনি নাকি অন্তত এক দিন উকিলদের বাংলায় সওয়াল করতে বাধ্য করেছেন। এজলাসে বসেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, বাংলায় বলা না হলে তিনি সওয়াল শুনবেন না। প্রথম দিন কোনো উকিলই বাংলায় ঠিকঠাকমতো সওয়াল করতে পারেননি বলে তিনি শুনানি মুলতবি করেছেন। এতে কাজ হয়েছিল। এ ধরনের বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বাংলা আদালতের ভাষায় পরিণত হতে দেরি হবে না।

স্বাধীনতার পর সাড়ে চার দশকের বেশি সময় ধরে জনগণ সর্বক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনের দাবির ভাঙা ক্যাসেট বাজিয়ে চলেছে। আইনের দেবী অন্ধ, মানলাম, কিন্তু কানে তো তিনি খাটো নন! বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধা যে সহজ কাজ নয়, তা আমরা জানি। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আদালতে বাংলা প্রচলন করাটা কঠিনতর, আদালতের সুউচ্চ ভবনের ঘণ্টার গলায় বিড়াল বাঁধার মতো দুরূহ কোনো কাজ। বিচারক ও আইনজীবীদেরই এই দুরূহ দায়িত্বটা পালন করতে হবে। বলা বাহুল্য, কাজটা যন্ত্রের নয়, মানুষের। অনুবাদযন্ত্রের দোহাই দিয়ে ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে’ দায়িত্ব এড়াতে থাকলে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের ক্ষতির পাল্লা ভারী হবে, কারণ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের সঙ্গে দেশ ও জনগণের উন্নয়নের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক আছে।

শিশির ভট্টাচার্য্য: অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।