দুই নৌকায় এরশাদের পা

দুই নৌকায় এরশাদের পা
দুই নৌকায় এরশাদের পা

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ কিছুদিন ধরেই হাসির উদ্রেক করছেন। সকালে হ্যাঁ বললে বিকেলে না বলেন। এমনকি আত্মহত্যার হুমকি পর্যন্ত তিনি দিতে বাদ রাখেননি। প্রতিনিয়ত মত পরিবর্তনের নেপথ্যে তাঁর যতখানি ক্ষমতার মোহ, তার চেয়ে বেশি তাঁর নিরাপদ জীবনের চেষ্টা।
নব্বইয়ে স্বৈরাচারী অভিধায় পরিচিত এরশাদের শাসনামলের অবসান হলে তিনি কারাবাস ভোগ করেন। জীবনের শেষ সময়ে এসে আর তিনি কারবাসী হতে চান না। ফলে তাঁকে ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গেই থাকতে হবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জোট-মহাজোটের টানাপোড়েন তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে। এই দ্বন্দ্বের আড়ালে এরশাদ বারবার বোঝার চেষ্টা করেছেন, কে ক্ষমতায় আসতে পারে। তিনি যে মুহূর্তে জোটের পাল্লা ভারী দেখেছেন, তখন মহাজোটের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন; আবার যখন মহাজোটের পাল্লা ভারী মনে করেছেন, তখন জোটের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু যে সময়ে এসে লক্ষ করলেন, জোট ও মহাজোট উভয় সম্ভাবনা সমান, তখন তিনি সাহস করে দুই নৌকায় পা রাখলেন। ১৮-দলীয় জোট নির্বাচনে আসেনি হেতু যে নির্বাচন হচ্ছে সেই সরকার কত দিন টিকে থাকবে, তা নিশ্চিত করে কারও পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। যত দিন এ সরকার থাকবে, তত দিন তার সঙ্গে যেমন এরশাদের থাকা প্রয়োজন; তেমনি সরকার যদি দীর্ঘ মেয়াদে না চলে, তার প্রস্তুতিও থাকা দারকার। বিধায়, তিনি কৌশলে রাজনীতি থেকে কিছুদিনের জন্য দূরে থাকলেন এবং রওশন এরশাদকে দিয়ে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে রাখলেন। এতে মহাজোটকে তিনি বলতে পারছেন, তাঁর দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। জোটকে বলতে পারবেন, তিনি নির্বাচনে অংশ নেননি।
ক্ষমতাসীনেরা একটি পাতানো নির্বাচনী বৈতরণি পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে। নির্বাচন কমিশন যে স্বাধীন নয়, তারও প্রমাণ মিলছে। জোট সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রার্থিতা বাতিল হচ্ছে। আবার অনেকেই আবেদন করলেও প্রার্থিতা বাতিল হচ্ছে না। জাতীয় পার্টি ১৮টি আসনে এরই মধ্যে জয়ী হয়েছে। জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের পদত্যাগ নিয়ে আরেকটি নাটক সাজানো হয়েছে। কয়েক স্তরে জাতীয় পার্টির ভাঙন সম্পন্ন হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, রওশন এরশাদ ও এরশাদকে ঘিরে জাতীয় পার্টির আরেকবার ভাঙন তৈরি হলো। এটা ঠিক নয়। বরং এরশাদ না থাকলে জাতীয় পার্টি কেমন চলতে পারে, তার একটা মহড়া চলছে। জাতীয় পার্টির আপাত দ্বিধাবিভক্তি পার্টিকে যদি আরও মজবুত করে তোলে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ক্ষমতাসীন এরশাদের রংপুরের মাটিতে একটি জনসভা করারও সামর্থ্য ছিল না। অথচ সেই এরশাদ যখন জেলে ছিলেন, তখন রংপুরের মানুষ তাঁকে জেল থেকে বের করে আনার জন্য ব্যাপক সমর্থন দিয়েছিল। বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই হয়তো চিকিৎসার নামে তাঁকে রাজনীতির মাঠ থেকে আড়াল করা হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি যে মুক্ত নন, সেটা পরিষ্কার। তবে এই বন্দীজীবন তাঁর স্বেচ্ছা গ্রহণ কি না, তা সাধারণের মনে প্রশ্ন তৈরি করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে কারাগারে থেকে তিনি করুণাধর্মী সমর্থন পেয়েছিলেন।
১৮ ডিসেম্বর ছিল এরশাদের মুক্তির দাবিতে রংপুরে হরতাল। স্বতঃস্ফূর্ত এ হরতালে রংপুরে একটি রিকশাও চলেনি। অনেক ওষুধ ও খাবারের দোকান পর্যন্ত বন্ধ ছিল। এই হরতালে অনেক পিকেটার ছিল লুঙ্গি পরা, শাড়ি পরা সাধারণ মানুষ। বাইসাইকেলে একজনকে যেতে দেখে এক পিকেটার বলছে, ‘মামু (এরশাদ) জেলোত আর তোমরা সাইকেলোত চড়ি যান? নামি যাও।’ রাস্তার পাশে বাড়ির ভেতর থেকে নারীরা বলছেন, ‘সাইকেল থাকি নামি যাও।’ তারা কোনো গাড়ি ভাঙচুর কিংবা কোথাও অগ্নিসংযোগ করেনি। কিন্তু হরতালের ধরন বলে দেয়, সাধারণ মানুষের আবেগের জায়গাটা কোথায়।
এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালীন স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছিলেন, সন্দেহ নেই। তাই বলে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপিও ক্ষমতায় গিয়ে এমন ভালো কিছু করেনি, যা এরশাদকে শতভাগ মলিন করে দেয়। বরং গণতন্ত্রের নামে বর্তমান সরকার যা করছে, তাও অনেকাংশে স্বৈরতান্ত্রিক। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন সারের নামে অনেক কৃষককে মেরেছে, জঙ্গিদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিল দেশ। দ্বিতীয়বার যখন চারদলীয় জোট নামে ক্ষমতায় আসীন হয়, তখন সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্মমতা-নৃশংসতা দেখিয়েছে, তা অতীতকে ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের দেশে উন্নয়নের প্রধান তিনটি সূচক—পোশাকশিল্প, কৃষি ও অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এই খাতগুলোর উন্নয়ন চলমান, এগুলো ততটা রাজনীতিনির্ভর নয়। তিন আমলেই মানুষ এর সুফল পেয়েছে।
তবে এরশাদের সমস্যা হলো মহাজোটের শরিক হয়েও নিজের নামের মামলাগুলোর সুরাহা করতে পারেননি। আওয়ামী লীগও তা হয়তো চায়নি। এরশাদকে হাতে রাখার অস্ত্র হিসেবে মামলাগুলো জিইয়ে রেখেছে। সেই মামলা নামের জুজুর ভয়ে তিনি প্রলাপ বকেন, দুই নৌকায় পা রাখেন। তবে, যদি দশম জাতীয় সংসদ খুব দ্রুত ভেঙে দিতে হয় এবং ১৮-দলীয় জোটকে এরশাদ ১৯-দলীয় জোটে পরিণত করেন এবং জোর করে তাঁকে চিকিৎসার নামে বন্দী করে রাখা হয়েছিল বলে প্রচার করেন, তাহলে রংপুর অঞ্চলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একক নির্বাচন করলে জাতীয় পার্টি যেখানে দু-চারটি আসনের বেশি পেত কি না সন্দেহ, সেখানে তারা রংপুর বিভাগের আসনগুলোয় লাঙ্গলের জয়-পতাকা ওড়াতে পারবে।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
[email protected]