লোকরঞ্জনবাদ দূর হয়নি

দাউইসন বেলেম লোপেস
দাউইসন বেলেম লোপেস

পৃথিবীর দুই প্রভাবশালী গণমাধ্যম ব্রিটেনের দ্য ইকোনমিস্ট ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন অ্যাফেয়ার্স সম্প্রতি দাবি করেছে, লাতিন আমেরিকা থেকে লোকরঞ্জনবাদের পশ্চাদপসরণ শুরু হয়েছে। এখন কেউ যদি ‘লোকরঞ্জনবাদের’ সঙ্গে ‘বামপন্থীদের’ মিলিয়ে ফেলেন, তাহলে ব্যাপারটা যুক্তিগ্রাহ্য হয়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া ও ইকুয়েডরের বামপন্থী নেতারা সমর্থন হারাচ্ছেন। কারণ, এসব দেশের অর্থনীতি ধসে পড়ছে এবং মধ্য বামপন্থী দল ও নীতি দুর্বল হয়ে পড়ছে।
কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠের কী অবস্থা হবে? সম্প্রতি লাতিন আমেরিকার মধ্য ডানপন্থী দল ও রাজনীতিকেরা কেমন করছেন? প্রথমত, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এবং এরপর ক্ষমতায় বসার পর তাঁদের পারফরম্যান্স কেমন? এর উত্তরে আমি বলব, খুব একটা ভালো নয়।
মেক্সিকোর এনরিকে পেনা নিয়েতো, আর্জেন্টিনার মরিসিও মারসি ও ব্রাজিলের মিশেল টেমারের নেতৃত্বে দেশগুলোর অবস্থা ভালো নয়। এই নেতাদের জনপ্রিয়তা একদম তলানিতে এসে ঠেকেছে। প্রায় প্রতিদিনই তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে।
কথা হচ্ছে, মেক্সিকো ও আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট সরাসরি নির্বাচিত হয়েছেন, তবে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট তা নন। মিশেল টেমারের সংস্কারবাদী অ্যাজেন্ডার কাছাকাছি অ্যাজেন্ডা ২০১৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেটা তখন হালে পানি পায়নি। তিনি এক বিতর্কিত অভিশংসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, ওটা ‘ছোটখাটো অভ্যুত্থান’ ছিল, যার মধ্য দিয়ে ব্রাজিলের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন।
এমনকি লাতিন আমেরিকার জনপ্রিয় ও মধ্য ডানপন্থার আইকন হুয়ান মানুয়েল সান্তোস কলম্বিয়ায় কর্কশ সমালোচনার
মুখে পড়েছেন। তাঁর সরকার বহুদিনের কসরতের পর ফার্ক বিদ্রোহীদের সঙ্গে যে শান্তিচুক্তি করেছিল, গণভোটে মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। চুক্তি যদি সংশোধন না করে কংগ্রেসে অনুমোদন করানো না হতো, তাহলে কলম্বিয়ার জনগণ তা নাকচ করে দিত।
এবার দুবার ভাবুন। লোকরঞ্জনবাদকে যদি আমরা এভাবে সংজ্ঞায়িত করি যে এটা একধরনের রাজনৈতিক চর্চা, যার মাধ্যমে নেতৃত্ব সাংবিধানিক পথে না গিয়ে অন্যভাবে জনগণের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে ডানপন্থী দল ও রাজনীতিকদের উত্থানের কী ব্যাখ্যা দেবেন? তাঁরা অতটা জনপ্রিয়ও নন। এর সঙ্গে কি লাতিন আমেরিকার লোকরঞ্জনবাদী নেতাদের পতনের সম্পর্ক আছে?
আমার মন বলছে, এই অঞ্চল থেকে বামপন্থী ও মধ্য বামপন্থী নেতাদের পশ্চাদপসরণের যে কথা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে লোকরঞ্জনবাদের জনপ্রিয়তা কমার তেমন একটা সম্পর্ক নেই। লাতিন আমেরিকার বর্তমান ডান ও মধ্য ডানপন্থী নেতারা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও শক্তিশালী সংবিধানের প্রতি তেমন একটা অঙ্গীকারবদ্ধ নন। বরং বলা যায়, ব্যাপারটা এর উল্টো। উদাহরণস্বরূপ, সাইমন বলিভারের তথাকথিত শিষ্যদের কথাই বলা যায়, যেমন মৃত হুগো চাভেজের ভেনেজুয়েলা, ইভো মোরালেসের বলিভিয়া, রাফায়েল কোরেয়ার ইকুয়েডর, মানুয়েল জেলায়ার হন্ডুরাস ও ফার্নান্দো লুগোর প্যারাগুয়ের।
সবাই না হলেও অধিকাংশ বামপন্থী সরকার প্রক্রিয়াগতভাবে গণতান্ত্রিক কৌশল প্রয়োগ করেছে, যার মধ্যে আছে মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করা, গণভোট প্রভৃতি। যখনই তারা সুবিধাজনক সময়-সুযোগ পেয়েছে, তখনই তারা নিজেদের স্বার্থে রাজনীতির নিয়ম পাল্টানোর লক্ষ্যে এসব করেছে। এমনকি তাদের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা যখন সাংবিধানিক শর্ত পুরোপুরি পূরণ করেনি, তখনো তারা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে এড়িয়ে যায়নি। বরং তারা এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে লক্ষ্য পূরণ করেছে।
নিয়ম ভাঙার মানে হলো নতুন নিয়ম সৃষ্টি করা। বিশেষ করে, ভোটাররা যদি আপনার পাশে থাকেন। এখন দেখা যাক, ডানপন্থী দলগুলো কীভাবে ২০০৯ সালে হন্ডুরাসে, ২০১২ সালে প্যারাগুয়েতে ও ২০১৬ সালে ব্রাজিলে ক্ষমতায় আসে। এই তিনটি
দেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়, কীভাবে ভোট নয়, সাংবিধানিক বিশ্লেষণ লাতিন আমেরিকার সাম্প্রতিক সরকার পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে পারে।
হন্ডুরাসের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেলায়া এক আইন পাস করার চেষ্টা করেছিলেন, যেটা পাস হলে কেউ একাধিকবার প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচিত হতে পারতেন। তো দেখা গেল, সশস্ত্র বাহিনীর লোকজন তাঁকে অপহরণ করে পায়জামা পরা অবস্থায় পার্শ্ববর্তী দেশ কোস্টারিকায় পাঠিয়ে দিলেন। তাঁর মাথায় তখন বন্দুকের নল তাক করা ছিল। এরপর হন্ডুরাসের সুপ্রিম কোর্ট পরোক্ষভাবে এই অপহরণের অনুমোদন দেন।
এরপর প্যারাগুয়ের লুগো কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন এক অভিশংসন প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাচ্যুত হন, যে প্রক্রিয়া শেষ হতে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় লাগেনি। প্যারাগুয়ের সংসদের বিরোধী দলগুলোর ভাষ্যমতে, এই অভিশংসন যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সম্পন্ন করা হয়েছিল। অর্থাৎ দেখা গেল, এ ক্ষেত্রেও বিচার বিভাগ সংসদের পক্ষাবলম্বন করে। ফলে এই প্রক্রিয়া আইনগত স্বীকৃতি পায়।
ব্রাজিলে যা হলো তা প্রাতিষ্ঠানিক নৈরাশ্যের একদম চূড়ান্ত নমুনা। সংবিধানের বিরুদ্ধে ‘দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রে অপরাধ করায়’ একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে দেড় বছরের মাথায় অভিশংসন করা হলো, যিনি প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের ভোট নিয়ে পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন। রুসেফের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি রাজস্ব আদায়ে কিছু কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। অথচ ব্রাজিলের সব বেসামরিক সরকারপ্রধানই এটা করে থাকেন। ফেডারেল স্টেট গভর্নরদের কথা আর না-ই বললাম।
একদম কম বললেও এটা বলতে হবে, রুসেফকে ক্ষমতাচ্যুত করার ঘটনাটি একদম অপ্রচলিত ও অভূতপূর্ব ছিল। এটা করতে আইনের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তাও অ্যাডহক। আর পুরো ব্যাপারটা ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট দেখভাল করেছেন।
ব্যাপারটা হয়েছে কী, দ্য ইকোনমিস্ট ও ফরেন অ্যাফেয়ার্স উভয় পত্রিকাই লাতিন আমেরিকা-বিষয়ক তাদের সংস্কারের খপ্পরে পড়েছে। লাতিন আমেরিকান হিসেবে এটা বলতে পারি, বিগত কয়েক বছরে লাতিন আমেরিকার মানুষ রাজনৈতিক দস্যুদের নতুন করে আবিষ্কার করেছে। সময় এসেছে, ২০ শতকের শুরুর দিকের ওই হিমায়িত চিত্রকল্পগুলো ঝেড়ে ফেলতে হবে।
লাতিন আমেরিকা এখন আর লোকরঞ্জনবাদীদের পুরোনো ঘরানার জায়গা নয়। সেখানে এখন গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক কায়দাকানুন নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। অর্থাৎ তা আরও পরিশীলিত হয়েছে। আরও বড় কথা হচ্ছে, এটা শুধু
ডান বা বামদের একচেটিয়া অধিকারে নেই, উভয় পক্ষই এটা করেছে। প্রথম দেখায় যে রকম মনে হয়, এই অঞ্চলের রাজনীতি ঠিক তেমন নয়।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, আল-জাজিরা থেকে নেওয়া।
দাউইসন বেলেম লোপেস: ব্রাজিলের ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল ডেভেলপমেন্টের গবেষক।