আইন নয়, শক্তির শাসন চলছে

আইন নয়, শক্তির শাসন চলছে। ‘সরকারি অবরোধ’ও এবারই নতুন নয়, এবারই শেষ নয়। নতুন চটকদার স্লোগান ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ মানে মসনদের দিকে অভিযাত্রা। দুই দলের নেতা-কর্মীদের আজ যাদের মাঠে সক্রিয় দেখা যাবে, তারা নিশ্চয়ই সম্পদশালী অথবা তাদের খেদমতগার। কারণ, সম্পদশালীরাই অবরোধ করার সময় পায়। ঠেকানোরও সময় পায়। তাই এ ধরনের বালা-মুসিবত থেকে রেহাই চাইলে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের হদিস পেতে হবে। এটা আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা নয়। এটা রাজনৈতিক সমস্যা নয়। এটা তথাকথিত ভোটের অধিকার হরণের সংকটও নয়। এটা মূলত অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করা ও তা রক্ষা করার সমস্যা।
সম্পদ বিবরণীর খবর আমাদের নির্বাচন কমিশন শুধু নয়, সুপ্রিম কোর্ট ও দুদকের দিকেও নতুন করে তাকানোর সুযোগ করে দিল। আসুন, প্রতিহত করা ও প্রতিরোধ করার ডামাডোলের মধ্যে আমরা বরং অবৈধ সম্পদ রক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতাগুলোর দিকে নজর দিই। কয়েক দিন ধরে পত্রিকায় মন্ত্রী, মন্ত্রীপত্নী ও শাসকদলীয় রুই-কাতলাদের সম্পদের পাহাড় গড়ার খবর এক-এগারো কালে সুপ্রিম কোর্ট ও দুদকের বিশেষ ভূমিকাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
আজকের পরিস্থিতির দায়, বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্ট এড়াতে পারেন না।
বেগম খালেদা জিয়া তাঁর সংবাদ সম্মেলনে চলতি সম্পদ কেলেঙ্কারি নিয়ে মুখ খুলতে ভোলেননি। কিন্তু তা ততটুকুই, যতটুকু তাঁর জুতার মাপে লাগে। পুনর্বার সিংহাসনে বসতে তাঁর যেখানে যতটুকু প্রতিশ্রুতি না দিলেই নয়, সেটুকু তিনি দেবেনই।
তাই তিনি এবং তাঁর মিত্ররা এইট পাস আবু সাফাকে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় সম্পর্কে মুখ খোলেন না। দলের আয়-ব্যয়ের হিসাব যখন ইসি গোপন করে চলে, তখনো দুই দল দুই নেত্রী এককাট্টা থাকেন। ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’র আয়োজন ও প্রতিহত করতে কার কত খরচ হলো, সেটাই আমরা জানতে চাই।
আজকে মন্ত্রী, মন্ত্রীপত্নী ও প্রভাবশালীরা বিএনপি সরকারের মতোই সম্পদের পাহাড় গড়তে পারলেন। তাঁদের প্রত্যেকের ওপরে ওপরের ‘দোয়া’ আছে। দায়মুক্তির রক্ষাকবচও আছে। আইনি রক্ষাকবচটা রাজনীতিকেরা সাম্প্রতিক ইতিহাসে সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন। দুদক মায়াকান্না জুড়ল। কারণ, দুদক আইন পাল্টে সংসদ সরকারি কর্মচারীদের সুরক্ষা দিল। এই সুরক্ষা হলো দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করা। দুদক ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যথারীতি ক্ষমতাসীন দলের তল্পিবাহক হয়ে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে। আবার এই দুদক যদি তৎপর হতোও তাহলে কী ঘটত, সেটা আঁচ করতে আমরা এক-এগারোর উপাখ্যান ভুলতে পারি না।
এটা পর্যালোচনা করব। হাতেনাতে পরীক্ষা করে দেখব, দুর্নীতিতে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন দেশটির সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের শাস্তি দিতে কী ধরনের প্রবণতা দেখিয়ে থাকে। এমনকি গণমাধ্যমও কমবেশি একই সুরে কোরাস গাইতে অভ্যস্ত।
অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি কেবলই দুর্নীতির সূচক নয়, এটা নির্বাচনী দুর্নীতি ও ভোট অবমাননার সূচকও বটে। দুই নেত্রী ঠেকানোর রাজনীতি করছেন। শেখ হাসিনা শেখাচ্ছেন, ভোট নয়, যুদ্ধাপরাধীর বিচারই আসল। আর খালেদা জিয়ার মন্তব্য, ‘দুই প্রধান রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে একটি ঐকমত্য ও সমঝোতা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।’ এটা আক্ষরিক অর্থে রক্তারক্তি এড়ানো অর্থে সত্যি। এর চেয়ে বেশি নয়। ডাকাবুকোদের সঙ্গে মনোনয়ন-বাণিজ্য বা অবরোধ-বাণিজ্য করে দুই দল যদি ক্ষমতার ‘শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর’ ঘটাত, তাহলে আজকের অবস্থা সৃষ্টি হতো না। এক-এগারো সৃষ্টি হতো না। ১৯৯৬-তে নিয়মরক্ষার নির্বাচন করতে হতো না।
আমি সন্দেহ করি না যে বিএনপি যেদিন সরকার করবে, সেদিনই আরেক সংকটের সূচনা ঘটবে। আবারও ‘সরকারি অবরোধ’ পত্রিকার শিরোনাম হবে। এর কারণ, তারা কেউ আবু সাফা বনাম নির্বাচন কমিশন মামলার রায় মানে না। মানার মতো সংগঠন তারা গড়তে চায় না। কারণ, তেমন সংগঠন গড়লে নেতৃত্বের খাসতালুকটা টলে উঠবে। তাই ওরা ওদের শর্তে ভোটাধিকার এবং অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটদান জপ করে। দুই দলের আঁতাত এখানে নিরঙ্কুশ। চলতি ডামাডোলের মধ্যেও ওদের ঐক্যটা লক্ষণীয়।
আইনজীবী আবদুল মোমেন চৌধুরী রিট করেছিলেন। প্রার্থীদের আটটি তথ্য জানার অধিকারকে সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুষঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করেন বিচারপতি এম এ মতিন। ২০০৫ সালের ২৪ মে তিনি যখন এই যুগান্তকারী রায়টি লেখেন, তখন দুই দলের কারও কানে পানি ঢোকেনি। সরকার ও ইসির প্রতি দুটি রুল জারি হয়েছিল। কিন্তু কেউ তাতে পাত্তা দেয়নি। কোনো এফিডেভিট ইন অপোজিশন ছিল না। ড. কামাল হোসেন একাই শুনানিতে অংশ নেন। আদালতের কাগজপত্র সাক্ষ্য দিচ্ছে, মূল দুই দলের সঙ্গে যুক্ত থাকা আইনজীবীরা এই রায় থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। এই নাটকের দুটি বিবেক চরিত্র ড. কামাল হোসেন ও বিচারপতি এম এ মতিন। তাঁরা বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তাঁদের ডাক শুনতে সরকারি অবরোধ ও অভিযাত্রাওয়ালাদের কেউ প্রস্তুত ছিল না, এখনো নেই। আট তথ্য প্রকাশে বিচারপতি এম এ মতিন কিন্তু নির্দিষ্টভাবে আরপিও শোধরাতে বলেননি। এক-এগারোতে অধ্যাদেশ করে এটা চালু করা হয়েছিল। ভাগ্যিস, নবম সংসদ এটা বাতিল করেনি।
সুপ্রিম কোর্টের রায় দুই নেত্রী ও তদীয় স্তাবকদের প্রয়োজনের সঙ্গে যখন যতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, ততটাই গ্রহণযোগ্য এবং এই প্রজাতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। বাকিটা বাতিল। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কথা বলে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে। এখন মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলছেন, এনবিআর ছাড়া সম্পদের বিবরণী নিয়ে আর কারও উচ্চবাচ্য বারণ। তাঁর এই বক্তব্য আদালত অবমাননা। আওয়ামী লীগ যদি সংগঠনগতভাবে এটা মানে তাহলে আওয়ামী লীগও আদালত অবমাননাকারী।
বিচারপতি এম এ মতিনের ওই ১১ পৃষ্ঠার রায়টির তাৎপর্য এই মুহূর্তে বহুমাত্রিক। আর সেটা কেবলই সম্পদের বিবরণীসংক্রান্ত নয়। ক্ষমতাসীনদের ধড়ফড়ানি সত্ত্বেও ওয়েবসাইট থেকে সম্পদের বিবরণী সরায়নি ইসি। সরালে তারা মামলায় পড়ত।
আওয়ামী লীগ ও ইসি কার্যত সুপ্রিম কোর্ট ও সংবিধান অবমাননা করে চলেছে।
সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে দুই রায় দাতার মধ্যে বিচারপতি খায়রুল হক যতটা আলোচিত বিচারপতি মতিন ততটাই অনালোচিত। বিচারপতি খায়রুলের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ঝেড়ে ফেলা হয়। বিচারপতি মতিনের রায় ‘একতরফা’ নির্বাচন আটকাতে পারে না। এটা অবৈধ বলে গণ্য হয় না।
ওই রায়টি এখন প্রচলিত আইন। যে আইন নির্দিষ্টভাবে সংবিধানের নির্বাচনসংক্রান্ত বিধানাবলি ব্যাখ্যা করেছে। বলেছে ‘প্রার্থী সম্পর্কে জানার অধিকার নাগরিকের ভোটাধিকারের অন্তর্ভুক্ত’। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে নির্বাচন করার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ইসিকেই ঘোষণা করা আছে। এটি বলেছে, নির্বাচন অনুষ্ঠান তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের এখতিয়ার ইসির ওপর ন্যস্ত। বিচারপতি মতিন লিখেছেন, ‘ইসির এই ক্ষমতা পূর্ণাঙ্গ। ধরে নিতে হবে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে যখন যেমন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তার প্রয়োগ করা দরকার, সেটা ইসিকে সংবিধান দিয়েই রেখেছে। নির্দিষ্টভাবে কোনো বিষয়ে তাকে নিষেধ করা হলে সেটাই কেবল বাদ যাবে।’ অথচ ইসি এতটাই অন্ধ যে তারা এখন ‘৯০ দিনের মধ্যে’ কথাটা ছাড়া আর কিছু দেখছে না। নাগরিক সমাজও তাই। তারা ওই রায় থেকে শুধু সম্পদ বিবরণীর অংশটুকু নিয়ে মাততে চায়। বাকিটুকু তার মগজে ঢোকে না।
আমি পরিষ্কার দেখি, বিচারপতি মতিনের এই অংশ মানলেই ইসি সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের আওতায় সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দিতে পারে। কিন্তু এভাবে ইসি সবল হোক সেটা বিএনপিও চায় না। ‘সরকারি অবরোধ’ ও গণতন্ত্রের অভিযাত্রা দুটোই শঠতাপূর্ণ।
আগামীকাল: সুপ্রিম কোর্ট যখন সংবিধানবিচ্যুত
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
[email protected]