কোরীয় উপদ্বীপে নতুন সংকট

মিংঝাও ঝাও
মিংঝাও ঝাও

কোরীয় উপদ্বীপে নতুন সংকট ঘনিয়ে উঠছে। গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে উত্তর কোরিয়া মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ করেছে। এরপর ১ মার্চ থেকে দক্ষিণ কোরিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক নজিরবিহীন যৌথ সামরিক মহড়া শুরু করে। আগামী এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত এই সামরিক মহড়া চলবে। এতে দুই দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক স্থল, নৌ ও বিমানসেনা অংশ নিচ্ছেন। বি-৫২ বোমারু বিমান ও বিমানবাহী ইউএসএস কার্ল ভিনসনের মতো কৌশলগত যন্ত্রও এতে ব্যবহৃত হবে। আর রাশিয়া ও চীনের আপত্তি সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় টার্মিনাল হাই অ্যালটিচুড এরিয়া ডিফেন্স (থাড) মিসাইল বিধ্বংসী ব্যবস্থা স্থাপন করছে।
ওদিকে যেদিন যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়া যৌথ মহড়া শুরু হলো, সেদিনই উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উন কোরিয়ান পিপলস আর্মির কম্বাইন্ড ইউনিট ৯৬৬ সফর করেছেন। পাঁচ দিন পর উত্তর কোরিয়া চারটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করে। জানা যায়, এর একটি জাপান উপকূলের ২০০ মাইলের মধ্যে পড়েছে। এই পরীক্ষার কারণে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, উত্তর কোরিয়া ব্যাপক হারে পারমাণবিক ও ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত বাড়িয়েছে। আর ২০২০ সালের মধ্যে তারা আমেরিকা মহাদেশে আঘাত হানতে সক্ষম—এমন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে ছোট আকৃতির পারমাণবিক ওয়ারহেড যুক্ত করতে পারবে।
উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধি ও সাবেক জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে মার্চ মাসের শুরুর দিকে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর উত্তর কোরিয়ার কূটনীতিকদের ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আলোচনা বাতিল হয়ে যায়। এতে দুই দেশের মধ্যকার যোগাযোগের ঘাটতি চিরস্থায়ী রূপ পেল। বর্তমানে দেশ দুটি যেমন মুখোমুখি অবস্থানে থাকার কারণে যে ঝুঁকিতে রয়েছে, তা আরও বাড়ল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দৃশ্যত উত্তর কোরিয়ার ওপর চাপ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিমের সঙ্গে সরাসরি কথা না বলে এবং প্রচারণার বাগাড়ম্বরকে বাস্তবায়ন না করে তিনি এ পথে হাঁটছেন। ট্রাম্পের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল উত্তর কোরিয়া-বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের নীতি গভীরভাবে পর্যালোচনা করছে। তারা বিভিন্ন সম্ভাব্য নীতি খতিয়ে দেখছে। এর মধ্যে রয়েছে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনার ওপর নিবৃত্তিমূলক অতর্কিত হামলা থেকে শুরু করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের মতো ‘কূটনৈতিক’ পদক্ষেপ।
এমনকি ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে এককভাবে আলোচনা করতে রাজি থাকলেও তাঁর প্রশাসন দৃশ্যত তা করতে প্রস্তুত নয়। কারণ, তাদের যেমন উত্তর কোরিয়া-বিষয়ক সমন্বিত নীতি নেই, তেমনি তাদের নীতি প্রণয়নের বিশ্বাসযোগ্য কর্মপদ্ধতি নেই। ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস কর্মহীনতায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। মাইকেল ফ্লিনকে হঠাৎ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ থেকে সরানোই নয়, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল দেখভাল করার মতো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের অভাব থেকেও ব্যাপারটা বোঝা যায়।
নির্বাহী বিভাগের এই শূন্যতা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার এই সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাকে গুরুতর হুমকি হিসেব গণ্য করছে। অনেক কংগ্রেস সদস্য ও জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা এখন কঠিনতর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি করছেন। এর মধ্যে আছে সন্ত্রাসবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকদের তালিকায় কিম সরকারের নাম ঢোকানো এবং সুনির্দিষ্ট হামলা চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনীকে কাজে লাগানো। কিন্তু এতে শুধু দেশটির নিরাপত্তাহীনতার বোধই তীব্র হবে, আর কিছু নয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দারা বিশ্বাস করেন, উত্তর কোরিয়ার হাতে ১০ থেকে ১৬টি পারমাণবিক অস্ত্র ও সহস্রাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আছে। ফলে সামরিকভাবে উত্তর কোরিয়ার হুমকি অকার্যকর করতে হলে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। ওদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক গুয়েন–হে অভিশংসিত হওয়ায় দেশটির পক্ষে অন্তত আগামী কয়েক মাস নতুন নীতি গ্রহণ করা সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে কোরীয় উপদ্বীপে চীনের ভূমিকা ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। একদিকে তারা উত্তর কোরিয়ার পরীক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের বিরোধিতা করেছে এবং নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব অনুসারে সেখান থেকে কয়লা আমদানি বাতিল করেছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এতটা দূরে গেছে যে তারা ঠারেঠোরে বলে বসেছে, চীন ‘যুক্তরাষ্ট্রের তালে নাচা শুরু করেছে।’
কিন্তু চীন দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন থাড ব্যবস্থাকে গুরুতর কৌশলগত হুমকি মনে করে। চীনাদের উদ্বেগ হচ্ছে, থাডের এক্স-ব্যান্ডের রাডার চীনের সেকেন্ড স্ট্রাইক পারমাণবিক সক্ষমতাকে নাকচ করে দেবে। এই ব্যবস্থা মার্কিন ও জাপানি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে উত্তর-পূর্ব এশিয়াব্যাপী জাল তৈরি করতে পারে। জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে নিজ দেশে থাড ব্যবস্থা স্থাপনে তোড়জোড় শুরু করেছেন।
২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সামরিক গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের লক্ষ্যে এক চুক্তি সই করে। তারা উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র, যদিও একসময় তারা জাতশত্রু ছিল। এখন তাদের মধ্যে যদি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি হয়, সে ক্ষেত্রে চীন-রাশিয়ার উদ্বেগ হচ্ছে, এই জোট পূর্বাঞ্চলে ছোটখাটো ন্যাটো হয়ে উঠবে।
এখন উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধের আদলে নিরাপত্তা ব্লক গড়ে উঠলে আঞ্চলিক বৈরিতা শুধু বাড়বেই। এই পরিস্থিতি এড়াতে চীন
সব দেশকে একটু ভেবেচিন্তে এগোনোর আহ্বান জানাচ্ছে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সম্প্রতি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়া ‘ধাবমান ট্রেনের মতো, যারা একে অন্যের দিকে ধেয়ে আসছে। কেউ কাউকে রাস্তা দিতে রাজি নয়’।
সম্প্রতি বেইজিংয়ে ওয়াংয়ের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রি কিলের সাক্ষাৎ হয়েছে। এরপর ১৮ মার্চ ওয়াং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের সঙ্গে দেখা করবেন। চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক আয়োজন করতে তিনি সেখানে যাবেন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সংকট সমাধানই হবে এই বৈঠকের মূল লক্ষ্য।
চীন দ্বিমুখী প্রস্তাব দিয়েছে। প্রথমত, উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ করতে হবে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক মহড়া বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সব পক্ষকে আলোচনার টেবিলে আসতে হবে। এর লক্ষ্য হবে, কোরীয় উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করে শান্তিচুক্তি সই, যা ৬০ বছরের পুরোনো কোরিয়ান ওয়ার আর্মিস্টাইস অ্যাগ্রিমেন্টকে প্রতিস্থাপন করবে।
কথা হচ্ছে, উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় অবিশ্বাস বাড়লে মার্কিন-চীন সম্পর্ক আরও খারাপ হবে, যে সম্পর্কের মধ্যে ইতিমধ্যে ধৈর্যের অভাব দেখা যাচ্ছে। তাই এখন ঠান্ডামাথার মানুষ দরকার।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
মিংঝাও ঝাও: বেইজিংয়ের চারহার ইনস্টিটিউটের গবেষণা ফেলো।