বাণিজ্য সহজীকরণের উদ্যোগে বাংলাদেশ

বহুপক্ষীয় বিশ্ব বাণিজ্যব্যবস্থাকে রীতিমতো কোণঠাসা করার জন্য নানামুখী আয়োজন যখন জোরদার, তখনই যেন নতুনভাবে তা এক প্রাণ সঞ্জীবনী পেল। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (টিএফএ বা বাণিজ্য সহজীকরণ চুক্তি) আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হলো। এর মানে, ডব্লিউটিওর সদস্যদেশগুলো এখন এই চুক্তি অনুসারে যার যা করণীয়, তা–ই করতে থাকবে।
টিএফএ হলো বিশ্ব বাণিজ্যের প্রক্রিয়াগুলো সহজ করে সময় কমানো ও ব্যয়সাশ্রয়ী করার বৈশ্বিক চুক্তি। এই চুক্তির মাধ্যমে ডব্লিউটিওর সদস্যদেশগুলো যার যার সীমান্তে আমদানি ও রপ্তানির পণ্যসমূহ দ্রুত ছাড় করার জন্য অভিন্ন কিছু পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছে। বিশেষত, পণ্যের চালান পরীক্ষা ও শুল্কায়নের জন্য প্রধানত উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) কাস্টমস বা শুল্ক কর্তৃপক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই প্রচুর সময় নেয়। তারা অপর্যাপ্ত দলিল ও কাগজপত্রের অজুহাতে চালান আটকে রাখে। আবার অবৈধ আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে তারা সেটা কখনো কখনো ছেড়েও দেয়। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসার ব্যয় বেড়ে যায়, বেড়ে যায় পণ্যের দাম, যা শেষ পর্যন্ত সাধারণ ক্রেতা-ভোক্তাদের ওপরই এসে পড়ে।
বাণিজ্য সহজীকরণ প্রক্রিয়ায় আমদানি-রপ্তানিকারকেরা এ ধরনের ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবে। পণ্য আমদানি-রপ্তানি ও স্থানান্তরের (ট্রানজিট) যাবতীয় দলিলপত্র ইলেকট্রনিকভাবে প্রস্তুত ও যাচাই করা হবে। সীমান্তে শুল্ক কর্তৃপক্ষ পণ্য খালাসকালে কম্পিউটারের পর্দায় যাবতীয় তথ্য-দলিল তাৎক্ষণিকভাবে দেখতে ও যাচাই করতে পারবে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ পরস্পরের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ রক্ষা ও দলিলপত্র তাৎক্ষণিকভাবে বিনিময় করতে পারবে। ফলে ব্যবসায়ীদের আর কাগজপত্র হাতে হাতে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে দৌড়াতে হবে না। এতে সময় ও খরচ বাঁচবে, অবৈধ আর্থিক লেনদেন রোধ হবে। আবার বাণিজ্যবিষয়ক যেকোনো তথ্য-উপাত্ত সহজেই অনলাইনে পাওয়া যাবে।
বস্তুত, আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করার পর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ২১ বছরের ইতিহাসে টিএফএই হলো প্রথম বৈশ্বিক চুক্তি। ১৯৯৬ সালে সিঙ্গাপুর সম্মেলনে এটি প্রথম উত্থাপিত হলেও সদস্যদেশগুলো এ নিয়ে আলোচনা পিছিয়ে দেয়। কেননা, বেশির ভাগ দেশেই তখন ইলেকট্রনিক লেনদেনের বিষয়টি ছিল অনুপস্থিত। ছিল নানা ধরনের অক্ষমতা। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশ এ বিষয়ে সক্ষমতা তৈরির দিকে মনোযোগ দেয়। এ জন্য একাধিক বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে। অবশেষে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বালি সম্মেলনে সদস্যদেশগুলো এই চুক্তি অনুমোদন করে। ডব্লিউটিওর বিধি অনুসারে অনুমোদিত চুক্তি সদস্যদেশগুলোর জাতীয় আইনসভায় বা সংসদে অনুসমর্থিত হতে হয়। সেই অনুসমর্থনের বা স্বীকৃতির দলিল ডব্লিউটিওকে হস্তান্তর করতে হয়। এভাবে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য অনুসমর্থন করলে কোনো চুক্তি কার্যকর হয়, সবার জন্য পালনের আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়।
টিএফএ কার্যকর হতে দরকার ছিল ১৬৪ সদস্যের মধ্যে ১১০টির অনুসমর্থন। পাওয়া গেছে ১১১টির। যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি অনুসমর্থনকারী তৃতীয় দেশ। ২০১৫ সালের প্রথম দিকে ওবামা প্রশাসন এটি সম্পন্ন করে। এখন ট্রাম্প যদি তাঁর প্রশাসনকে এটি ফিরিয়ে নিতে বলেন, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কিন্তু তাতে টিএফএ কার্যকর হওয়া বন্ধ হবে না। বাংলাদেশ প্রথম দিকে এটি অনুসমর্থন না করে অপেক্ষার নীতি নিয়েছিল। তবে ২০১৫ সালে নাইরোবি সম্মেলনের পর টিএফএ অনুসমর্থনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর গত বছর ৯৪তম সদস্য ও ১২তম এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ টিএফএ অনুসমর্থন করে।
বাণিজ্য সহজীকরণ চুক্তিতে নির্ধারিত ৩৮টি পদক্ষেপের অনেকগুলো বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করেছে। যেমন বাংলাদেশে ট্রেড পোর্টাল চালু হয়েছে। এটির মাধ্যমে অনলাইনে বাংলাদেশের বাণিজ্য-বিষয়ক যাবতীয় তথ্য, বিধিবিধান ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা সম্ভব। যেমন কোনো একটি পণ্য রপ্তানি করতে গেলে কীভাবে বিএসটিআইর মান সনদ নিতে হবে, তা জানতে আগে একজন ব্যবসায়ীকে সংশ্লিষ্ট বণিক সমিতি ও বিএসটিআইর কার্যালয়ে ছুটতে হতো। এতে সময় ও খরচ বেড়ে যেত। ট্রেড পোর্টালে প্রবেশ করে এখন ঘরে বসেই পুরো প্রক্রিয়াটি জানা ও বোঝা সম্ভব। যদিও ট্রেড পোর্টালের নানা সীমাবদ্ধতা এখনো আছে। তবে এগুলো দ্রুত কাটিয়ে উঠে নিয়মিত হালনাগাদ করা জরুরি। আবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সিঙ্গেল উইন্ডো (এসডব্লিউ বা একক জানালা) ব্যবস্থা চালুর কাজ চলছে। এটির মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সব কাজ একটি মাত্র স্থানে ইলেকট্রনিকভাবে সম্পন্ন হবে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইউএস এইডসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এসব কাজে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। ২০১৯ সালের মধ্যে এটি চালু হতে পারে। বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারি কমিশনকে একীভূত করে গঠিত বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিআইডিএ) বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা করার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আগামী পাঁচ বছরে ১০০-র মধ্যে নামিয়ে আনার ব্রত গ্রহণ করেছে। এটি করতে হলে টিএফএর অর্থবহ বাস্তবায়ন অপরিহার্য। বর্তমানে (২০১৭) বাংলাদেশের অবস্থান ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৭৬তম। এ ছাড়া বাণিজ্য সহজীকরণ প্রক্রিয়া জোরদার করতে একাধিক আন্তর্জাতিক উদ্যোগও চলমান রয়েছে।
বাণিজ্য সহজীকরণের মূল সূত্র অনলাইনভিত্তিক ইলেকট্রনিক কার্যক্রম, সেটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দরকার কারিগরি দক্ষতা ও কুশলতা। বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে অনেক দেশের চেয়েই এগিয়ে আছে। কেননা, তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ দ্রুত গড়ে উঠেছে ও উঠছে। সরকারি দপ্তরগুলোতেও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তবে দুটি বড় সীমাবদ্ধতায় বাংলাদেশে টিএফএর অর্থবহ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। একটি হলো, সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে চিরাচরিত সমন্বয়হীনতা এবং যথাসময়ে তথ্য-উপাত্ত ও বিধিবিধানের পরিবর্তন হালনাগাদ না করা। যেকোনো এক বা একাধিক দপ্তর সময়মতো তাদের কাজটি না করলে পুরো প্রক্রিয়াটিই ধাক্কা খাবে। আরেকটি বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, টিএফএ-বিষয়ক সফটওয়্যার বিনির্মাণ ও স্থাপন করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি। যে অভিযোগ ইতিমধ্যে উঠেছেও।
তাই সুশাসনের বিষয়টি টিএফএ বাস্তবায়নের প্রধান পূর্বশর্ত হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে। আর এই সুশাসন নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব সরকারের। টিএফএ যেখানে অনুপার্জিত মুনাফাখুরি (রেন্ট সিকিং) রোধ করতে চাইছে, সেখানে এই বৈশ্বিক চুক্তি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশই যদি অনুপার্জিত মুনাফাখুরির খপ্পরে পড়ে, তাহলে তা হবে বড় ট্র্যাজেডি।
আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]