পদ্ধতি অবৈধ, অর্থ কি বৈধ?

এক-এগারো অর্থাৎ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও কোম্পানির কাছ থেকে আদায় করা অর্থের মধ্যে ৬১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ফেরত দিতে হবে। সে সময় ১ হাজার ২২৮ কোটি ৯৫ লাখ ৬৪ হাজার ৯২৫ টাকা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায় আপিল বিভাগ বহাল রেখেছেন।

মূলত যে পদ্ধতিতে অর্থ আদায় করা হয়েছিল সেটি সঠিক ছিল না। আবার যাঁরা অর্থ আদায়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের সে এখতিয়ারও ছিল না। আইনের এই ব্যাখ্যার কারণেই সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আপিল টেকেনি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থ আদায়ের পদ্ধতি না হয় ঠিক ছিল না, কিন্তু আদায় করা অর্থ কি বৈধ ছিল? সংগত কারণেই অর্থের উৎস মামলার বিষয়বস্তু ছিল না। সুতরাং মামলায় সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক হেরে গেলেও এটা বলা যাবে না যে আদায় করা অর্থের রং ছিল সাদা।
অর্থ ফেরত পেতে যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মামলা করেছিল, তাদের মধ্যে ছিল দ্য কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি লিমিটেড। এই কোম্পানির কাছ থেকে আদায় করা হয় ২৩৭ কোটি ৬৫ লাখ ৪০ হাজার ২ টাকা ১৭ পয়সা। আদায় করা অর্থ বৈধ না অবৈধ এই প্রশ্নের উত্তর জানতে অর্থ আদায়ের গল্পটা তাহলে জানা যাক।
জেমস ফিনলে বাংলাদেশে অত্যন্ত পরিচিত একটি নাম। ব্রিটিশ এই কোম্পানির মালিকানা কয়েক হাত ঘুরে এসেছিল হংকংভিত্তিক সোয়ার প্যাসিফিক গ্রুপের কাছে। সোয়ার গ্রুপ জেমস ফিনলের বাংলাদেশ কার্যক্রম বিক্রি করে দেয় ২০০৫ সালে। আর এই কেনাবেচার লেনদেনই অবৈধ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়েছিল।
জেমস ফিনলের বাংলাদেশে চা ব্যবসা কিনে নেওয়ার জন্য দেশের কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে গঠন করেছিলেন কনসোলিডেট টি অ্যান্ড ল্যান্ডস লিমিটেড নামের কোম্পানিটি। ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী ছিলেন কোম্পানির চেয়ারম্যান। বাকিরা ছিলেন নাদের খান, সালমান ইস্পাহানি, শওকত আলী চৌধুরী, মুজিবুর রহমান, মতিউর রহমান, আনিস আহমেদ এবং জেমস ফিনলে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কিউ আই চৌধুরী।
জেমস ফিনলে বিক্রি হয় ১ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ডে। ২০০৫ সালের শেষের দিকে এই লেনদেন সম্পন্ন হয়। সে সময়ে প্রতি পাউন্ড প্রায় ১২৭ টাকা হিসাবে বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ ছিল ২২৭ কোটি টাকা। এই অর্থের লেনদেন কিন্তু বাংলাদেশে হয়নি। অর্থ পাচার করে দ্বিতীয় আরেকটা দেশে তা পরিশোধ করা হয়েছিল। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় ২০০৬ সালেই বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদেও আলোচনা হয়। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান সংসদেই বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তদন্ত আর এগোয়নি।
এরপরেই আসে এক-এগারো। দুর্নীতি দমনে গঠন হয় টাস্কফোর্স। আটক করা হয় রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের। আদায় করা হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। এর মধ্যেই ছিল কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি লিমিটেডের ২৩৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এমন নয় যে তাদের পাচার করা অর্থ ফেরত আনা হয়। আসলে পাচার করা টাকার সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে আদায় করা হয়েছিল। বিনিময় হারের পার্থক্যের কারণে পাউন্ডের দর বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত ১০ কোটি টাকা তাদের বেশি দিতে হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, এক-এগারোর সময় এম সুফিয়ান নামে বসুন্ধরা গ্রুপের একজন পরিচালকের কাছ থেকে আদায় করা হয় ১৪ কোটি টাকা। একক গ্রুপ হিসেবে বসুন্ধরার কাছ থেকেই নেওয়া হয়েছিল সবচেয়ে বেশি অর্থ, ২৫৬ কোটি টাকা। অন্তত দুজন রাজনীতিবিদের কাছ থেকেও অর্থ নেওয়া হয়। যেমন, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে একাই দিতে হয়েছিল সাড়ে ৫২ কোটি টাকা। এই অর্থের উৎস ছিল মূলত ঘুষ। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের

ছেলে সানবীরকে একটি খুনের মামলা থেকে রেহাই দিতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর ঘুষ হিসেবে নিয়েছিলেন ২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া একটি বিদেশি ব্যাংকে রাখা ২৫ লাখ ডলার জনাব বাবরই চেকের মাধ্যমে দেশে এনে জমা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ ছাড়া গুলশান থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওয়াকিল আহমেদকে জমা দিতে হয়েছিল ১৬ কোটি টাকা। জানা যায়, তিনি একটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকে দেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।
বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদেরও সে সময় মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে হয়েছিল। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো উদ্যোক্তা নিজের বা পরিবারের নামে মোট পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারেন না। কিন্তু অনেকেই আইনকে পাশ কাটিয়ে বেনামে শেয়ারধারী হয়ে থাকেন। এ রকম কয়েকজনের বেনামি শেয়ার উদ্ধার ও তা বাজারে বিক্রি করে সমপরিমাণ অর্থ জমা দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। যেমন, ন্যাশনাল ব্যাংকের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল ৩৯ কোটি টাকা ও ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পারভীন হক শিকদার জমা দিয়েছিলেন ৩ কোটি টাকা এবং মোসাদ্দেক আলী ফালু দিয়েছিলেন ৩২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এবি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছ থেকেও আদায় করা হয় ১৯০ কোটি ৪১ লাখ টাকা, বিএনপি ঘনিষ্ঠ আরেক ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের নামে জমা পড়েছিল ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৬১৩ টাকা। এই অর্থ ছিল বিদেশে পাচার করা অর্থ। সিঙ্গাপুরে একটি ব্যাংকের হিসাবে রাখা এই অর্থ ফেরত এনে জমা দেওয়া হয়েছিল। যদিও তিনি সে সময় আটক অবস্থায় ছিলেন।
বেশ কিছু রিয়েল এস্টেট কোম্পানিকেও এক-এগারোর সময় অর্থ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। যেমন, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ ও ফাউন্ডেশন থেকে নেওয়া হয় সাড়ে ৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, দ্য পিংক সিটি থেকে ৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা, ইস্টার্ন হাউজিং থেকে ৩৫ কোটি টাকা, আশিয়ান সিটি থেকে ১ কোটি টাকা, সাগুফতা হাউজিং থেকে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও স্বদেশ প্রোপার্টিজ থেকে ৯ কোটি টাকা। কয়েকজন বড় ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীও বাধ্য হয়েছিলেন অর্থ দিতে। যেমন, সাইফুল আলমের কাছ থেকে দুই দফায় ৭০ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা, নূর আলীর কাছ থেকে ২৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং ২০ লাখ ডলার, মেঘনা গ্রুপ থেকে ২৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যমুনা গ্রুপ থেকে ৩০ কোটি টাকা, হোসাফ গ্রুপ থেকে ১৫ কোটি টাকা, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী শওকত আলী চৌধুরীর কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা এবং পারটেক্স গ্রুপ থেকে নেওয়া হয় ১৫ কোটি টাকা। এমনকি জাহাজভাঙা শিল্প মালিক সমিতি থেকেও নেওয়া হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১৯ কোটি টাকা।
কোনো আইনেই এভাবে অর্থ নেওয়া যায় না। এমন না যে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ আদায়ের কোনো ব্যবস্থা প্রচলিত আইনে নেই। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, বেনামি শেয়ার রাখা হলে তা জব্দ করার বিধান রয়েছে। অর্থ পাচার বা যেকোনো ধরনের অবৈধ ব্যবহারের জন্য মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন রয়েছে। কর ফাঁকি দিলে আয়কর আইনে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু
যার কাজ, তাকে দায়িত্ব না দিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে যেনতেনভাবে অর্থ আদায়ের ওই উদ্যোগ ব্যর্থ যে হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
এক-এগারোর সময়ে আদায় করা অর্থকে অগ্রিম আয়কর হিসেবে দেখিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোষাগারে জমা করা হয়। তবে ঠিক কত টাকা আদায় করা হয়েছিল তা হয়তো কোনো দিনও জানা যাবে না। অনেক ব্যবসায়ীই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছিলেন, তাঁরা চেক বা পে-অর্ডারের বাইরে নগদ অর্থও দিয়েছিলেন। এমনও তো হতে পারে আদায়কারীরা নিজেদের পকেটেও কিছু অর্থ রেখে
দিয়েছিলেন। আদায়ের পদ্ধতি আইনসিদ্ধ না হওয়ায় পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। তবে অনেকের ক্ষেত্রেই বলা যায়—অর্থ আদায়ের পদ্ধতি যেমন ছিল অবৈধ, আদায় করা অর্থের বড় অংশও ছিল অবৈধ। এর মধ্যে হয়তো বৈধ অর্থও ছিল। ভয়ভীতি দেখিয়ে হয়তো অর্থ আদায় করা হয়েছিল।
অর্থ আদায়ের পদ্ধতি যে বৈধ ছিল না, তা আদালতের রায়ে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আদায় করা অর্থের বৈধতা নিয়ে প্রশ্নের সুরাহা হয়নি। এখন কি দুর্নীতি দমন কমিশন বা বাংলাদেশ ব্যাংক এই কাজটি করবে? এটাই এখন প্রশ্ন।
শওকত হোসেন: সাংবাদিক।
[email protected]