পারমাণবিক অস্ত্রই ভয়ের কারণ

ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়া নিয়েই প্রথম গুরুতর সংকটে পড়তে যাচ্ছেন, এ ব্যাপারে বেশি বেশি মানুষ ক্রমেই একমত হচ্ছেন। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, উত্তর কোরিয়ার সামর্থ্য আছে, সে এক বা একাধিক দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে পারমাণবিক ওয়ার হেড যুক্ত করতে পারে। আর তার সীমা ও যথার্থতা এত নিখুঁত যে তা আমেরিকা মহাদেশে পর্যন্ত আঘাত হানতে পারে—ট্রাম্পের শঙ্কার কারণ এটাই। উত্তর কোরিয়া যে হারে পারমাণবিক ওয়ার হেড বানাচ্ছে, তাতে এটাই প্রমাণ হয়, তারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে পারমাণবিক উপাদান বিক্রি করছে।  

নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। ১৯৯০ সালের পর সব মার্কিন প্রশাসনের উত্তর কোরিয়াবিষয়ক নীতি ছিল এ রকম—দেশটির ব্যাপারে কৌশলগত ধৈর্য বজায় রাখতে হবে। এখন সেই নীতির অবসানের সময় এসেছে। এখন এ রকম নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে যে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডারের যে গুণগত ও সংখ্যাগত উন্নতি হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান বিপদে পড়লে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েই তা প্রতিহত করতে পারে। এর সঙ্গে তারা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও নিতে পারে।

সমস্যা হচ্ছে, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা অসম্পূর্ণ, প্রতিরক্ষার ব্যাপারটা অনিশ্চিত। একমাত্র নিশ্চয়তা হচ্ছে, এ দুটি যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে এর জন্য অকল্পনীয় মূল্য দিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োজন আছে কি না, তা পুনর্বিবেচনা করতে পারে। কারণ, এতে করে এই অঞ্চলে নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে, যার কারণে এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে।

দ্বিতীয়ত, উত্তর কোরিয়ার আসন্ন (কেউ বলতে পারেন) হুমকির বিরুদ্ধে সামরিক বলপ্রয়োগ করা যেতে পারে। এই মনোভঙ্গির একটি সমস্যা হচ্ছে, সামরিক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও ওয়ার হেড ধ্বংস করা যাবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। কিন্তু তা সম্ভব হলেও উত্তর কোরিয়া সম্ভবত দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর প্রথাগত সামরিক আঘাত হানবে। সিউল ও মার্কিন সেনারা উত্তর কোরিয়ার হাজার হাজার বড় কামানের আওতার মধ্যেই আছে, তাই সে রকম কিছু হলে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন সরকার নিশ্চিতভাবেই তেমন কিছু করবে না, যার কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

সে কারণে কেউ কেউ উত্তর কোরিয়ায় সরকার পরিবর্তনের কথা বলেন। তাঁদের আশা, সেখানকার নতুন নেতৃত্ব আরও কিছুটা যৌক্তিক হবে। সম্ভবত তা হবে, কিন্তু এ রকম পরিবর্তন আনার ব্যাপারটা এখন পর্যন্ত যতটা আকাঙ্ক্ষার মধ্যে আছে, নীতিতে তার প্রতিফলন অতটা দেখা যাচ্ছে না। এখানেই আমরা কূটনীতির দ্বারস্থ হই। যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব দিতে পারে।

এরপর আলোচনা শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র এ রকম একটি চুক্তির প্রস্তাব দিতে পারে: উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার সিলগালা করতে হবে, যার জন্য ওয়ার হেড ও ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা বন্ধ করতে হবে। আর এটা মানা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের সুযোগ দিতে হবে। উত্তর কোরিয়াকে অঙ্গীকার করতে হবে, তারা কোনো দেশ বা সংগঠনের কাছে পারমাণবিক উপাদান বিক্রি করবে না।

এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আলোচনার পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যরা কোরীয় যুদ্ধের ৬০ বছর পর উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চুক্তি সই করতে রাজি হতে পারে। এ মুহূর্তে হয়তো উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এড়িয়ে যাওয়া হবে, কিন্তু দেশটির নেতারা হয়তো বুঝবেন, নিপীড়ন থাকলে সম্পর্কও স্বাভাবিক হবে না। আর সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে হলে উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক কর্মসূচি বাদ দিতে হবে।

একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের সীমা নির্ধারণ করতে হবে। উত্তর কোরিয়ার সামরিক হুমকি যত দিন থাকবে, তত দিন যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক মহড়াও শেষ হবে না। একই কারণে দক্ষিণ কোরিয়া বা এ অঞ্চলে মার্কিন সেনার সংখ্যা সীমিত করার উদ্যোগ গৃহীত হবে না। যেকোনো আলোচনা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হওয়া উচিত, পাছে উত্তর কোরিয়া এই সময়ে নতুন সামরিক বাস্তবতা তৈরি করে ফেলে।

এ ধরনের মনোভাব কি সফল হবে? এর ছোট্ট উত্তর হচ্ছে, ‘সম্ভবত’। কিম জং-উন বা তাঁর পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে চীনের ভালোবাসা নেই। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার ধ্বংস এবং সিউলকে রাজধানী করে দুই কোরিয়ার একীভবনও তাদের পছন্দ নয়। প্রতিবেশীদের ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু সেই প্রভাব খাটাতে তাদের রাজি করানো যাবে কি না, সেটাই
প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত, চীনকে আশ্বস্ত করা যে দুই কোরিয়ার একীভবনকে তারা কৌশলগত সুবিধার জন্য কাজে লাগাবে না। আবার চীনকে তার সতর্কও করা উচিত, উত্তর কোরিয়ার বর্তমান তরিকা তার স্বার্থের জন্যও হানিকর। কোরীয় উপদ্বীপের বাস্তবতায় কী করা উচিত, তা নিয়ে চীনের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা করা যেতে পারে।  

আবার এমন নিশ্চয়তাও নেই যে কূটনীতি সফল হবে। এমনকি তা ব্যর্থ হলেও সদ্বিশ্বাসে এমন একটি প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল এটা দেখালেও বিকল্প নীতি গ্রহণ সহজ হবে, যার মধ্যে সামরিক বলপ্রয়োগও থাকতে পারে। অর্থাৎ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলকে এটা বোঝানো যাবে, কেন এই বিকল্প পন্থা নেওয়া হয়েছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

রিচার্ড এন হাস: কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট।