তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, 'আপনারা চুপ থাকেন'

আমরা ঠিক করলাম, তাঁর সঙ্গে দেখা করতেই হবে। কিন্তু কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে তনুর বাবা-মা যেখানে থাকেন, সেখানে গিয়ে দেখা করা যাবে না। আগেরবার শহরে এসেছিলেন।

রুবেলকে বললাম, মুরাদনগর যাওয়ার পথে কোথাও তাঁদের সঙ্গে কথা বলব। তাঁরা রাজি হলেন। কিন্তু কুমিল্লা শহর থেকে মহাসড়কে যেখান থেকে মুরাদনগরের বাস ছাড়ে, সেখানে যাওয়া বেশ ঝক্কির ব্যাপার। মহাসড়কে সিএনজিচালিত স্কুটার, ইজিবাইক চলে না। শহর থেকে প্রথমে বিশ্ব রোড মোড় পর্যন্ত স্কুটারে গেলাম। সেখান থেকে রিকশায় সেনাকল্যাণ সমিতির মার্কেটের নিচে গিয়ে কয়েকবার টেলিফোন দিলাম। রুবেল টেলিফোন ধরলেও কথা বোঝা যাচ্ছে না। বাসস্ট্যান্ডে হইচই, চিৎকার।

সামনে তাকাতেই দেখি একটি লোকাল বাসের সামনের দিকের আসনে বসে আছেন তনুর মা আনোয়ারা বেগম। পাশে রুবেল। সালাম দিতেই চিনতে পারলেন। বাস তখন ছেড়ে দেয় দেয় অবস্থা। মন খারাপ হয়ে গেল। এত দূর এসে ফিরে যাব?

কিন্তু আনোয়ারা বেগম আমাদের দিকে তাকালেন। একটু ভাবলেন। তারপর বাসের কর্মীকে বললেন, ‘পরের বাসে যাব।’

ছেলে রুবেলকে নিয়ে তিনি নেমে এলেন। তনু নেই। আনোয়ারা বেগম এক বছর ধরে তার স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন। মেয়ে হত্যার বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কেউ তাঁকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। রাষ্ট্র, আইন, সমাজ—কেউ না। 

  শুরুতেই আনোয়ারা বেগমকে জিজ্ঞাসা করি, এক বছর তো পূর্ণ হলো। তনু হত্যার তদন্ত কতটা এগুলো? বিষাদ কণ্ঠে তিনি বললেন, তদন্ত কর্মকর্তা জালাল সাহেব নিজে কিছু বলেন না। যখনই জিজ্ঞেস করি, বলেন, ‘আপনারা চুপ থাকেন। পত্রিকায়, টিভিতে তনুর ছবি দেখাবেন না।’

: তখন আপনি তাঁকে কী বললেন?

: বললাম, অপরাধীকে ধরুন। আমরা কিছু বলব না। আর  চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের বউয়ের ছবি যদি দেখাতে পারে, আমার মেয়ের ছবি দেখানো যাবে না কেন?

 মেয়ের কথা মনে করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘এখন বড় কষ্টে আছি। মেয়ে আমাকে যেভাবে দেখত, ছেলেরা কি সেটি পারে? তনুকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন এক মুহূর্তে শেষ করে দিয়েছে পাষণ্ডরা।’

আনোয়ারা বেগম মনে করেন, যে ভদ্রমহিলা তনুকে অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিলেন, তাঁকে খুঁজে বের করতে পারলে হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটিত হবে। তাঁর কথায় একবার তনু অনুষ্ঠানে গিয়েছিল, আরেকবার যায়নি। এটাই ছিল ওর অপরাধ! কিন্তু তাই বলে একটি মেয়েকে মেরে ফেলবে?

কথা বলতে গিয়ে ফের বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি।

তনু এক বছর ধরে নেই। মা হয়ে কীভাবে তিনি এই শূন্যতা মেনে নেবেন? তনু হত্যার বিচারের জন্য তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। আকুতি জানাচ্ছেন। অনেকে আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই।

তনুর নিহত হওয়ার দিনটির কথা মনে করলে তিনি বারবার বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়েন। একজন তাঁকে জানিয়েছেন, তনুকে হত্যা করার জন্য নাকি তাঁকে দামি ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে নিয়েছিল ঘাতকেরা। তাঁর প্রশ্ন, ওই ওষুধ কোথায় পেল তারা?

‘আমার মেয়ে মারা গেল। এখন আমি বিচারও চাইতে পারব না, এটি কী ধরনের কথা’—প্রশ্ন আনোয়ারা বেগমের।

এক বছরের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে তনুর মা বলেন, সময়টা যে কীভাবে কেটেছে বলতে পারব না। কেবল দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি।

 তিনি বলেন, ‘আগে যিনি আইও ছিলেন, তিনি তো কথাবার্তা বলতেন। জালাল সাহেব কিছুই বলেন না। কেবল ধমকান। চুপ থাকতে বলেন। তিনি বাজার এসে ঘুরে চলে যান। তিনি আমাদের কথা শোনেনও না। অন্যদের কথা শোনেন।’

তনু হত্যা মামলার ভবিষ্যৎ কী?

জবাবে আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘বিচার হবে কি না, সেটি আমি বলতে পারব না। যঁারা তদন্ত করছেন, তঁারা বলতে পারেন। আমি তো জেলখানার মতো অবস্থায় আছি। আমাদের বাড়ির পাশে যেসব বাসিন্দা ছিল, সবাইকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আমি একলা কীভাবে থাকব? খুব ভয়ে ছিলাম। পরে মহাসড়কের কাছে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের ভেতরেই আরেকটি জায়গায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ 

তনুর বাবার ওপর কোনো চাপ আছে কি না, জিজ্ঞাসা করলে আনোয়ারা বেগম জানান, ‘চাপ তো আছেই। তিনি (তনুর বাবা) বলেছেন, আমাদের তো আগে বাঁচন লাগব। তারপর বিচার।’  আনোয়ারা বেগমের ভয় তনুর বাবার চাকরি চলে গেলে তাঁদের না খেয়ে থাকতে হবে।

তিনি বললেন, ‘আমরা দুজনই অসুস্থ। তনু যখন মারা যায়, বড় ছেলে পড়াশোনা করত। পরে চাকরি নিয়েছে। মাস দু-এক ধরে সে কিছু টাকা দিচ্ছে। ছোট ছেলে বেকার, আমাদের সঙ্গে থাকে।’ 

তনু মারা যাওয়ার পর গত এক বছরে তাঁর ডায়াবেটিস হয়েছে। মেয়ের চিন্তায় প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে তাঁর সাড়ে তিন এবং তনুর বাবার দুই হাজার টাকা খরচ করতে হয়—জানালেন িতনি। 

: ২০ তারিখ তনুর মৃত্যুবার্ষিকীতে কী করবেন?

: ওর জন্যই গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি। সেখানে মিলাদ দেব। মাদ্রাসায় এতিম বাচ্চাদের খাওয়াব, গ্রামের লোকজনকে দাওয়াত দেব।

পরের প্রশ্ন ছিল, কীভাবে চলছে আপনার?

তিনি বেদনাহত কণ্ঠে বললেন, ‘মায়ের কষ্ট তো ছেলেরা বুঝতে পারে না। মেয়ে বুঝত। রুবেল আমাদের জন্য কোথাও যেতে পারে না। তাহলে বাবা-মাকে কে দেখবে? ও দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। ও চাকরির জন্য দরখাস্ত করেছিল। কিন্তু ওপর থেকে নাকি বলা হয়েছে ওকে নেওয়া যাবে না। অথচতনু হত্যার পর বলা হয়েছিল, দুই ছেলের চাকরি দেবে। কিন্তু আমি বলেছি, মেয়ের বিচারের বিনিময়ে চাকরি চাই না।’

এই সময় কেউ খোঁজখবর নিয়েছে কি না, জানতে চাইলে আনোয়ারা বেগম বলেন, ঢাকা থেকে মহিলা আইনজীবী সমিতির নেত্রী এলিনা খান খোঁজ নিয়েছিলেন। মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল টেলিফোন করেছিলেন।

তনুর কলেজের বন্ধুরা কেউ আসে কি?

আসতে ভয় পায়। বড় ছেলের বন্ধুরা আসত, তাদের ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। এখন আর আসে না।

মেয়ের হত্যার বিচারের জন্য আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে আনোয়ারা বেগমকে?