এরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি (!)

২৯ ডিসেম্বর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে এসেছি। দেখি ব্যাডমিন্টন কোর্টের পাশে ম্লানমুখে বসে আছেন ঢাবি শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক আলমগীর হোসেন। আমাকে দেখে তাঁদের ওপর কয়েক ঘণ্টা আগে ঘটে যাওয়া হামলার কথা বলেন। টি-শার্ট উঁচু করে পিঠের আঘাত দেখাতে চান—‘স্যার, একটু দেখবেন, কীভাবে মেরেছে আমাদের!’ ফিজিকসের অধ্যাপক আমিনুল তাঁর পাশে বসা। তিনি বলেন, ‘শাহবাগের ওসিকে বললাম, আমরা তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, খালি হাতে এখানে বসে আছি। আর এরা লাঠি হাতে মারছে আমাদের, আপনি কিছু করবেন না? তিনি আমাদের বলেন, ওপরের নির্দেশ আছে, আমরা কিছু করতে পারব না, আপনারা চলে যান এখান থেকে!’ আমিনুল মৃদু কণ্ঠে বলেন, ‘মার আমরা আরও অনেকেই খেয়েছি, লজ্জায় বলি না কাউকে!’
আমিনুলের কথা ঠিক। পরদিন প্রথম আলোতে দেখি, মার খেয়েছেন অধ্যাপক মোস্তফা মামুনও। মামুন আমাদের ব্যাডমিন্টনে ১৯ বছর ধরে চ্যাম্পিয়ন। খেলতে খেলতে আমরা কখনো সামান্য উত্তেজিত হই, একটু-আধটু মনোমালিন্যও হয় কখনো কখনো। মামুনের সঙ্গে কারও কখনো মনোমালিন্য হয় না, কখনো একটু গলা উঁচু করে কথাও বলেন না তিনি। পত্রিকায় দেখি, মার খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন মামুন এবং আরও কয়েকজন শিক্ষক।
কারা মেরেছে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের? মেরেছে আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ। কেন মেরেছে? প্রজন্ম লীগের সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি’ হিসেবে তাঁরা মাঠে ছিলেন। তাঁর বক্তব্য: ‘শিক্ষকদের ওই সমাবেশ থেকে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে আমরা তাঁদের প্রতিহত করি।’
মুক্তিযুদ্ধের এই ‘সপক্ষ শক্তি’ যেসব শিক্ষককে পিটিয়েছে, তাঁদের অনেকেই পঞ্চাশোর্ধ্ব, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মামুন আহমেদসহ অনেকে শিক্ষকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি, যাঁদের নাম উল্লেখ করলাম, তাঁদের প্রত্যেকে বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করছেন। যাঁরা মার খেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারেরও আছেন কেউ কেউ। তাঁরা হাতে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে খালেদা জিয়ার ঘোষিত সমাবেশে যোগ দিতে গিয়েছিলেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের শিক্ষকেরাও শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেত্রী থাকার সময় তাঁর সমাবেশে যোগ দিয়েছেন)। পুলিশ বাধা দিলে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসে পড়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করছিলেন। তবু তাঁদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে যারা, তারা নাকি ‘মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি’!
২৯ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টে বিরোধী দলের সমর্থক আইনজীবীদের ওপরও সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে ঢুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সরকারের পেটোয়া বাহিনী। একজন নারী আইনজীবী তাদের লাথি, ঘুষি আর ধাক্কা খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। তাঁর পিঠে তার পরও লাথি মেরেছে তারা। প্রথম আলোর ছবিতে দেখি, মাটিতে ধরাশায়ী এই যন্ত্রণাকাতর নারীর পেছনে উদ্যত হায়েনার মতো কয়েক যুবক, একজনের হাতের লাঠিতে আবার জাতীয় পতাকা বাঁধা! এরাও নাকি ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি’!
হেফাজতের মিছিলে বর্বরভাবে একজন নারী সাংবাদিকের ওপর হামলার পর আমরা সবাই ধর্মীয় উগ্রবাদীদের পাশবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলাম, পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছিল কয়েকজনকে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, নারী আইনজীবীকে একই বর্বরতায় আক্রমণকারী এই যুবকদের বিরুদ্ধে অনেকেই সোচ্চার হবে না, পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করবে না। কারণ, তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি’!
প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সমাবেশ ছিল। প্রেসক্লাব চত্বরে সাংবাদিকদের সভা করার রীতি দীর্ঘদিনের। সেখানেও হামলা করেছে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি’। বিশ্ববিদ্যালয়, সুপ্রিম কোর্ট আর প্রেসক্লাবে প্রতিটি আক্রমণের সময় পুলিশ আক্রমণকারীদের আশপাশে ছিল। তারা আক্রমণকারীদের কাউকে গ্রেপ্তার করেনি, এমনকি নিবৃত্ত করারও উল্লেখযোগ্য চেষ্টা করেনি। পুলিশ বরং বিভিন্ন জায়গা থেকে উল্টো গ্রেপ্তার করেছে আক্রান্ত পক্ষের লোকজনকে।
পুলিশ আমাদের জানিয়েছিল, বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচিতে ‘জনগণের’ জানমাল রক্ষা করার জন্য তারা মাঠে থাকবে। জনগণ বলতে তারা সম্ভবত বিরোধী দলের নেতা-কর্মী বা তাদের সমর্থকদের বোঝায়নি। বিরোধী দলের কর্মসূচিতে বাংলাদেশের আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক প্রমুখ পেশাজীবীর অংশগ্রহণ করার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। বিরোধী দলের সমর্থক পেশাজীবীরা এবার তা-ই করেছেন। পুলিশ তাঁদের কোনো আক্রমণ থেকে রক্ষা করেনি। করেনি, তার কারণ হয়তো এই যে ২৯ ডিসেম্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পুলিশের দৃষ্টিতে জনগণের পর্যায়ভুক্ত নন! পুলিশ হয়তো এভাবেই নির্দেশিত যে জনগণ বলতে বোঝাবে কেবল সরকার-সমর্থকদের। কারণ, শুধু সরকার-সমর্থকেরাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি, তাদের সব অনাচার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রদীপ্ত করার জন্য! কাজেই তারা সব আইনের ঊর্ধ্বে!
এ দেশে এখন সরকারের অন্যায়ের অংশীদার হলে বা তা মেনে নিলেই কেবল হওয়া যাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি। আর কোনো ভিন্নমত থাকলেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের বিরুদ্ধে কথা বললে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। সরকারি দলের মন্ত্রী-সাংসদদের দুর্নীতি, সরকারের সন্ত্রাস-গুম-গণগ্রেপ্তার কিংবা সরকারের একমাত্র আন্তর্জাতিক মিত্র ভারতের খবরদারির বিরুদ্ধে কথা বললেও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। এই বিপক্ষ শক্তিকে সর্বতোভাবে দমন করাই হচ্ছে রাষ্ট্রের এবং সরকারের কাজ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এভাবেই অপব্যাখ্যা করে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকার।
অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র, জনগণের ভোটাধিকার, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, ভিন্নমত পোষণের অধিকার, সভা-সমাবেশ আর কথা বলার স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু—সবার স্বার্থরক্ষা, বৈষম্যহীন সমাজ তৈরি করা আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
এই সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার মহান দায়িত্ব পালন করছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য অনিবার্য শর্ত। এই বিচার করার দায়িত্বটি পালন করে সরকার মুুক্তিযুদ্ধের চেতনার এই একটি দিককে বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু এর পাশাপাশি এই সরকারই এবারের নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে, (আগের বিএনপি সরকারের ধারাবাহিকতায়) দুর্নীতি ও সন্ত্রাসকে লালনের মাধ্যমে সমাজে বৈষম্য আর অনাচারের প্রসার ঘটিয়ে, সভা-সমাবেশ-রাজনীতির স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ করে, এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে হয়রানি করে (যেমন, মিরপুরের সাংসদ কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন কেন্দ্রের জমি দখল এবং সেখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের মারধর করে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়া) মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নানাভাবে পদদলিত করছে।
এর পরও সরকারের সুবিধাভোগী ও অন্ধ সমর্থকেরা কেবল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি আর ভিন্নমত পোষণকারী দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি—এই বিভ্রান্তিকর বিভাজন ছড়ানো হচ্ছে দেশে। আমরা যদি এই বিভ্রান্তিকে প্রতিরোধ না করি, তাহলে মার খেতে হবে আরও অনেক মানুষকে, আরও ভয়ংকর অন্ধকার গ্রাস করবে বাংলাদেশকে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার ভালো কাজটি করছে বলে এই সরকারের হাজারো অন্যায় কাজকে যদি আমরা মেনে নিই, তাহলে এ দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র আর মানবাধিকার বলেও কিছু থাকবে না। আমাদের সবারই মনে রাখা উচিত যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আসল নির্যাস হচ্ছে কোনো অন্যায়কেই না মেনে নেওয়া।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।