তবু ২০১৪ শুভ হোক

২০১৪ শুভ হোক
২০১৪ শুভ হোক

রাত পোহালেই নতুন বছরের শুরু। মহাকালের অতল গহ্বরে বিলীন হয়ে গেল একটি বছর। আদি-অন্তহীন সময়ের মধ্যে একটি বছর একটি বিন্দুর মতো। কোনো জাতির জীবনেও একটি বছর অতি অল্প সময়ই বটে। তবে কখনো একটি বছর ঘটনা-বৈচিত্র্যে স্মরণীয় হয়ে থাকে। ২০১৩ খ্রিষ্টীয় অব্দটি বাংলাদেশিদের জন্য পূর্ববর্তী অন্য বছরের মতো নয়—একটি বিশেষ বছর।
বছরটি যে শুধু দুঃখের, বেদনার, শোকের, কষ্টের, হারানোর বছর তা-ই নয়, ভবিষ্যতে ইতিহাসে বছরটি বিবেচিত হবে একটি ল্যান্ডমার্ক হিসেবে। বহু শতাব্দী পর এ ভূখণ্ডের মানুষের জীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা ১৯৭১-এ। সেই অধ্যায়টি একটি করুণ পরিণতি লাভ করল ২০১৩-তে। একাত্তর ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের বছর। ২০১৩ গণতন্ত্র বিসর্জনের বছর। গণতন্ত্র বিসর্জনের অর্থ মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিতেই আঘাত হানা।
আজ বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর অনেকের কাছেই গণতন্ত্র ছাড়া আর যেকোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ও নিপীড়ন-লুণ্ঠন, অন্য কিছু নয়। তাই মুক্তিযুদ্ধ এখন শুধুই ইতিহাস—অহংকার নয়, প্রেরণা নয়। অনেকের কাছে মুক্তিযুদ্ধ নয়, ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি পুঁজি। কারও কারও কাছে মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি বিক্রয়যোগ্য পণ্য। তাই মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা জনগণের কাছে ওয়াদা করেছিলেন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করবেন এবং কোনো পরিবার ২৫ বিঘার বেশি জমির মালিক হতে পারবে না, তাঁরা গত পাঁচ বছরেই শত শত নয়, হাজার হাজার বিঘা জমির মালিক হয়েছেন।
৪২ বছর আগে বর্তমান ভূস্বামীদের প্রায় কারও পরিবারেই ২৫ বিঘা জমি ছিল না। সে জন্যই তাঁরা চাননি যে কোনো জোতদারের মালিকানায় ২৫ বিঘার বেশি থাক। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে বাংলাদেশের অর্থনীতি হবে সমাজতান্ত্রিক। ২২ শিল্পপতির ধ্বংস চান। স্বাধীনতার পরে মুহূর্ত দেরি না করে বাঙালিদের মাঝারি ধরনের শিল্প-কারখানাও রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চেয়েছিল ২২ পরিবারের বিলুপ্তি। চার দশকে মুক্তিযুদ্ধ উপহার দিয়েছে দেশকে ২২ হাজার পরিবারকে, যাদের প্রত্যেকের সম্পদ স্বাধীনতা-পূর্ব ২২ পরিবারের সম্পদের চেয়ে বহু গুণ বেশি। আজ ৪৪ হাজার পরিবার আমরা পেয়েছি, যাদের বিত্ত আদমজী-ইস্পাহানিদের চেয়ে বেশি। ১৯৭৩ এমনকি ’৮৩-তেও যাঁর ব্যাংকে কোনো অ্যাকাউন্টই ছিল না, তাঁর এখন দেশ-বিদেশের ব্যাংকে অসংখ্য অ্যাকাউন্ট শুধু নয়, কোনো কোনো ব্যাংকের মালিকানা পর্যন্ত আছে।
স্বাধীনতা অর্জনের পরই ‘সত্য’ শব্দটি বাংলার মাটি থেকে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করা হয়। এ মাটিতে সত্য খুবই অপ্রিয়। যা অপ্রিয়, তা যত গুরুত্বপূর্ণই হোক, এ ভূখণ্ডে তা পরিত্যাজ্য। তবে একটি সত্য কথা অনেক স্বনামধন্য চেতনাপন্থীরা টিভি চ্যানেলে কোটি কোটি দর্শককে শুনিয়ে বলছেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে আমি আজ এই জায়গায় আসতে পারতাম না।’ কত বড় আত্মবিশ্বাসহীন ও আত্মপরাজিতের স্বীকারোক্তি।
অবৈধ উপায়ে বিত্ত আহরণের অসামান্য প্রতিভা ছাড়া জীবনের আর কোনো ক্ষেত্রে বাঙালি—বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। অথচ বাংলাদেশ তো সোমালিয়া বা সুদান নয়। ওসব দেশে জন্মগ্রহণ করেননি একজন অতীশ দীপঙ্কর, চৈতন্যদেব, রামমোহন রায়, লালন ফকির, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম। তবে হাজার বছর ধরে বাঙালি শাসিত হয়েছে অবাঙালি শাসকদের দ্বারা, তাই শাসক হিসেবে বাঙালির ব্যর্থতায় বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
একটি রাষ্ট্র তখনই সার্থক হয়, যখন তার শক্ত দার্শনিক ভিত্তি থাকে। সেই দার্শনিক ভিত্তি আছে জাপানের, ভিয়েতনামের, চীনের, ভারতের, জার্মানির, ফ্রান্সের, ব্রিটেনের ও আরও অনেক দেশের। পাকিস্তানের কোনো দার্শনিক ভিত্তি ছিল না, তার ছিল ইসলামের স্লোগান। তাই সে রাষ্ট্র হিসেবে পরিপূর্ণ ব্যর্থ। বাংলাদেশেরও কোনো দার্শনিক ভিত্তি ছিল না। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রভৃতি কয়েকটি শোনা কথা প্রতিষ্ঠাতারা সংবিধানের মাথায় বসিয়ে দেন। বছর কয়েকের মধ্যেই যখন দেখা গেল ওই শব্দগুলোর কোনোটিতেই নেতাদের আস্থা নেই, তখন ওগুলোরও ওপরে বসিয়ে দেওয়া হলো বিসমিল্লাহ। ফলে বাংলাদেশ না হলো একটি গণতান্ত্রিক রিপাবলিক, না হলো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, না হলো অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। বাংলাদেশ এখন একটি মস্তবড় খানকা শরিফ। খানকা শরিফে একজন পীর ও তাঁর খাদেমরাই সব—অন্যরা খায়দায়, ঘুরে বেড়ায়। বাংলাদেশের অধিকারহীন মানুষ খাচ্ছেদাচ্ছে আর ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো খাচ্ছে সরকারি দলের মাস্তান ও পুলিশের হাতের মার, কখনো বিরোধী দলের ক্যাডারদের হাতের মার। বাংলাদেশে এখন মানুষকে কিল দেওয়ার গোঁসাইয়ের অভাব নেই। কিল খাচ্ছে হতভাগ্য জনগণ।
এ অবস্থা হওয়ার কারণ, বাঙালি মুসলমানের কখনো রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা ছিল না। তারা সব সময় বহিরাগতদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। যখন ১৯৪৭ সালে শাসনের আধা ক্ষমতা পায়, তখন তার মধ্যে পুরো ক্ষমতা পাওয়ার বাসনা জাগে। সামন্ত যুগের পরে গণতান্ত্রিক যুগে মধ্যশ্রেণীই কোনো দেশের শাসনক্ষমতা পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা পালন করে। বুর্জোয়ারা তাঁদের বিত্তবৈভব নিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করে আনন্দ পান। পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের অবস্থান ছিল খুবই দুর্বল। কৃষিভিত্তিক সমাজে উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটায় বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের আকার বাড়তে থাকে। শক্তি বাড়তে থাকে। তবে এরা অজ্ঞাত কারণে খুবই লোভী মধ্যবিত্ত।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি নাগাদ বাঙালি মুসলমান মধ্যশ্রেণীর মধ্যে স্বশাসনের আকাঙ্ক্ষা জাগে। সেই আকাঙ্ক্ষা আরও অপ্রতিরোধ্য হয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্যের কারণে। তার চেয়েও বড় কথা, পাকিস্তানিদের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কোনো মূল্য ছিল না। তারা গণতন্ত্রের ভাষা বুঝত না। অস্ত্রের ভাষায় দেশ শাসন করত। সেই অস্ত্রের ভাষার আখেরি সর্বোচ্চ প্রয়োগ দেখা যায় একাত্তরে।
পাকিস্তানিদের অপরাধ এক রকম ছিল না। তারা শুধু অস্ত্রের অপব্যবহারই করেনি, ধর্মেরও অপব্যবহার করেছে। পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর অস্থিমজ্জায় ছিল সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দুবিদ্বেষ। সংগত কারণ দেখিয়ে ভারত বিরূপ হলে বলার কিছু থাকত না, ধরে নেওয়া যেত পাকিস্তানি জাতীয়তাবোধ থেকে তারা তা করছে, কিন্তু হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ওপর তাদের বিদ্বেষ ভাব অপ্রকাশ্য থাকেনি। তার জঘন্য ও নারকীয় প্রকাশ ঘটে একাত্তরে। শোষণ ও শাসনের জন্য তারা ইসলাম ধর্মকে নির্বোধের মতো ব্যবহার করেছে।
স্বাধীনতার পর এ দেশের ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের প্রত্যাশা ছিল, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে ইসলামি বা মুসলমানি সংস্কৃতি অবশ্যই প্রাধান্য পাবে, বস্তুত সেটাই সমন্বিত বাঙালি সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতিতে হিন্দু, মুসলমান, আদিবাসী সবারই অবদান রয়েছে, কিন্তু একটি উদার অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে উঠবে। দেড় হাজার বছর ধরে এ দেশের মানুষ সেই সংস্কৃতিকে লালন করেছে। কিন্তু একটি কাঙ্ক্ষিত সমাজকে নিরলস সাধনায় নির্মাণ করতে হয়। বাঙালি মুসলমান সমাজে সেই সাধক কেউ ছিলেন না। নেতা ছিলেন অনেকে। তাই ক্ষমতা হাতে পেয়ে বাঙালি মুসলমান নেতারা দিগিবদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। স্বাধীনতার চেতনার চেয়ে সম্পদের তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁদের পেয়ে বসে। সমাজতন্ত্র তো নয়ই, শাসকশ্রেণী গণতন্ত্রকে করে পদদলিত। তারা গণতন্ত্রকে রাখতে চায় একটি সাইনবোর্ডের মতো। তার আড়ালে লুণ্ঠন, নিপীড়নই প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
আজ বাংলাদেশ যে জায়গাটিতে এসেছে, তা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। নেতারা জেনে-বুঝেই রাষ্ট্রকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন। একজন বা দুজন নেতা এর জন্য দায়ী নন। সর্বশেষ যাঁর হাত দিয়ে প্রক্রিয়াটি শেষ হবে, ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাঁকেই জবাবদিহি করার জন্য দাঁড়াতে হবে। পূর্ববর্তীদের ইতিহাসের আদালতে তলব করা হবে পরে।
ভালো গণতন্ত্রে নেতা ও জনতার মাঝখানে কিছু থাকার কথা নয়। সাংগঠনিক কর্মীরা প্রয়োজনমতো দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নেতারা জনগণের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রেখে, তাঁদের আবেগ-অনুভূতি ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য না দিয়ে, অবলীলায় স্বেচ্ছাচারিতা করেন। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে তাঁরা গড়ে তোলেন একটি দালাল বাহিনী, বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণী থেকে তাঁদের রিক্রুট করেন, যাবতীয় অপকর্মে তাঁদের পান পাশে। এক গ্লাস নর্দমার নোংরা কালো পানিকেও তাঁদের দিয়ে বলাতে পারেন—মাধবকুণ্ডের ঝরনার পানি। বখতিয়ার খিলজির সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলার মানুষের যত ক্ষতি হয়েছে, তার বারো আনা করেছে শাসকশ্রেণীর দালালেরা। কারণ, দালালদের উৎসাহ ও সমর্থন পেয়েই শাসকেরা জনবিরোধী কাজ করার সাহস পান। একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পাশে বাঙালি ঘাতক-দালালেরা না থাকলে ১৭ এপ্রিলের মধ্যেই পাকিস্তানিদের আত্মসমর্থন করানো সম্ভব হতো। যুগে যুগে বিভিন্ন চেহারার দালালেরা আছে বলেই বাংলাদেশে অন্যায়-অবিচার আছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে পারেনি।
দক্ষতার সঙ্গে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দরকার একটি সুন্দর সংবিধান, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব ও দক্ষ আমলাশ্রেণী। পর্যায়ক্রমে শীর্ষ নেতা সব সময় দু-একজনই থাকেন, কিন্তু নেতৃত্ব একটি যৌথ ব্যাপার। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে অনেক মাথা একত্র হয়ে একটি অভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করলে ভুল কম হয়। একটি মাথা তা বুদ্ধিতে যত ঠাসাই হোক না কেন, তা রাষ্ট্রের মতো একটি বড় জিনিসের সব সমস্যা সঠিকভাবে সমাধান করতে পারে না।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশ যেখান থেকে পুনর্যাত্রা শুরু করেছিল, তার নির্মম সমাপ্তি ঘটবে ৫ জানুয়ারি ২০১৪। তার পরে যে যাত্রাটি শুরু হবে, তা কেমন হবে, সে সম্পর্কে আমাদের কাছে কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করেননি।
রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় এবং গণতন্ত্রের দাবিতে এ বছর যাঁরা রাজপথে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের বিদেহী আত্মার কাছে আমরা ক্ষমা চাই। বছরটিতে যা কিছু ঘটেছে, তা আমাদের সবার সম্মিলিত ব্যর্থতার জন্যই ঘটেছে। এ আমার এ তোমার পাপ।
একটি জনগোষ্ঠী যখন নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে, সর্বনাশের শেষ প্রান্তে পৌঁছে, কে তাকে উদ্ধার করবে? এ প্রসঙ্গে এগারো শতকের মহান আধ্যাত্মিক সাধক ও সুফি হজরত আলী হুজভেরি (দাতা গঞ্জেবক্শ, লাহোরে তাঁর মাজার), যিনি ছিলেন বহু দার্শনিক গ্রন্থের প্রণেতা, বলে গেছেন, কোনো জাতির শেষ ভরসা তার সাধারণ মানুষ। ধ্বংসস্তূপ থেকে তারাই পারে জাতিকে পুনরুদ্ধার করতে। সে জন্য প্রয়োজন সীমাহীন ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতি।
তবু আশা করি, ২০১৪ হোক সবার জন্য শুভ।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।