গোর্খাল্যান্ড: রণে ইতি?

পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র পাহাড়ি জেলা দার্জিলিংকে নিয়ে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার যে আন্দোলন শুরু করেছিল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, ২৬ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের কাছে নতুন করে শপথ নিয়ে সেই আন্দোলনের ইতি টানলেন আন্দোলনকারী জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুং। ফের দায়িত্বও নিলেন তিনি গোর্খাল্যান্ড টেরিটরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা জিটিএর। আর হাত মেলালেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে; মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কথা দিলেন, এবার আর পাহাড়ে আন্দোলন নয়, চলবে উন্নয়নের কাজ। ফলে কয়েক বছর ধরে চলা পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের আন্দোলনের দ্বিতীয়বারের মতো যবনিকাপাত হলো। এতে দারুণ খুশি দেশ-বিদেশের পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীরা। কারণ, এখনো ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী পড়তে আসেন দার্জিলিংয়ের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে।
এই দার্জিলিংয়ে গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা জিএনএলএফের নেতা সুভাষ ঘিসিংই প্রথম শুরু করেছিলেন পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার দাবি নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন। শেষমেশ তিনিও পেরে উঠতে পারেননি তৎকালীন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করে। অবশেষে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে তৎকালীন রাজ্য সরকারের প্রস্তাবমতো স্বায়ত্তশাসিত দার্জিলিং-গোর্খা পার্বত্য পরিষদ গঠন করে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল তাঁকে। যেমনটা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুংকেও সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল পৃথক স্বায়ত্তশাসিত জিটিএ গঠন করে। একসময় এই জিএনএলএফেরই সদস্য ছিলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুং। ছিলেন দার্জিলিং-গোর্খা পার্বত্য পরিষদের কাউন্সিলরও।
২০০৭ সালে সুভাষ ঘিসিংয়ের এই ভাবশিষ্য বিমল গুরুং হঠাৎ বিদ্রোহ করে বসেন জিএনএলএফের নেতা সুভাষ ঘিসিংয়ের বিরুদ্ধে। নতুন করে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার দাবি নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন তিনি। গড়ে তোলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। তাঁরই আন্দোলনে অশান্ত হয়ে পড়ে পাহাড়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজ্য সরকারের সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে রণে ভঙ্গ দেন। ২৬ ডিসেম্বর ফের জিটিএর নির্বাহী প্রধান হিসেবে শপথ নেন তিনি রাজ্যপালের কাছে। ফলে দীর্ঘদিনের পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের আন্দোলনে ইতি টানেন বিমল গুরুং।
জনমুক্তি মোর্চা বেশ জোরেশোরেই শুরু করেছিল পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন, সেই বামফ্রন্টের আমলে, ২০০৭ সালে। তখন বিরোধী দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এগিয়ে এসেছিলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার আন্দোলনের পাশে। ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁর দল ক্ষমতায় এলে দার্জিলিং সমস্যার সমাধান করে দেবেন তিনি। ফলে সেদিন জনমুক্তি মোর্চাও মমতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে মমতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন। এর পরই ওই বছরের ১৮ জুলাই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে সহমতের ভিত্তিতে গড়া হয় গোর্খাল্যান্ড টেরিটরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। জিটিএর প্রধান নির্বাহী হন জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুং। শুরুও হয় জিটিএর উন্নয়নের কাজ।
হঠাৎ জিটিএর কাজে ছেদ ঘটে এ বছরের ২৯ জুলাইয়ের কেন্দ্রীয় সরকারের অন্ধ্র প্রদেশ ভেঙে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার ঘোষণায়। আর এর পরই পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র পাহাড়ি জেলা দার্জিলিংকে একটি পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে ফের আন্দোলন শুরু করে জনমুক্তি মোর্চা। শুধু তা-ই নয়, এ বছরের ৩০ জুলাই এই আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য জিটিএর প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে ইস্তফাও দেন বিমল গুরুং। তবে জনমুক্তি মোর্চার এই আন্দোলনে সাড়া দেয়নি কেন্দ্রীয় বা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার।
ফলে দীর্ঘ ৪৩ দিন একটানা আন্দোলন করে দাবি আদায়ের কোনো প্রতিশ্রুতি না পেয়ে অবশেষে মুখরক্ষার জন্য রণে ভঙ্গ দেয় জনমুক্তি মোর্চা। ঘোষণা দেয়, ৪০ দিনের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে এই আন্দোলন। অর্থাৎ গত ২০ অক্টোবর পর্যন্ত। কারণ হিসেবে দেখানো হয়, পূজা এবং ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার দিক বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে জনমুক্তি মোর্চা।
গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা এই যুক্তি খাড়া করলেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা এটা ভালো করেই বুঝে নিয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার কেউই পৃথক রাজ্যের দাবি মানবে না। পশ্চিমবঙ্গের কোনো রাজনৈতিক দল কখনো চাইছে না এই রাজ্য ভেঙে দুই টুকরা হোক। চাইছে না পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য পাহাড় হাতছাড়া হোক। তাই পশ্চিমবঙ্গের মানুষও একজোট হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ভেঙে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার বিরুদ্ধে।
এদিকে এই আন্দোলনের জের ধরে পাহাড়ের একমাত্র চা ও পর্যটনশিল্প প্রচণ্ডভাবে মার খেতে থাকে। পাহাড়বাসীও রুটি-রুজির প্রশ্নে চাপ দিতে থাকে জনমুক্তি মোর্চার ওপর। আর এসব কারণে পাহাড়বাসীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আন্দোলন থেকে সরে আসার পথ খুঁজতে থাকে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা।
১৯৮০ সালের দিকে এই পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন জিএনএলএফের নেতা সুভাষ ঘিসিং। তখনো দাজিলিং জ্বলে উঠেছিল। দার্জিলিং ছেড়েছিলেন দেশি-বিদেশি পর্যটক আর ছাত্রছাত্রীরা। সেদিন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বহু বাড়িঘর, হোটেলও। গোটা দার্জিলিং পুড়েছিল রাজনৈতিক আগুনে। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রাজ্য সরকার, জিএনএলএফ ও কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে পৃথক স্বশাসিত ‘দার্জিলিং-গোর্খা পার্বত্য পরিষদ’ গড়ে সামাল দেওয়া হয় পৃথক রাজ্যের আন্দোলনকে। সে সময় দার্জিলিং সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। সেদিন পার্বত্য পরিষদের চেয়ারম্যান করা হয় সুভাষ ঘিসিংকে। জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুংও ছিলেন জিএনএলএফের অন্যতম নেতা।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে সুভাষ ঘিসিংয়ের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তিনি জিএনএলএফ ছেড়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা গঠন করে ২০০৭ থেকে নতুন করে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার আন্দোলনে নামেন। দার্জিলিংজুড়ে শুরু করেন তীব্র আন্দোলন। সেই আন্দোলনেরই ইতি টানলেন বিমল গুরুং। ২৬ ডিসেম্বর ফিরে গেলেন জিটিএতে। শপথ নিলেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের কাছে। ফের হলেন জিটিএর প্রধান নির্বাহী।

অমর সাহা, প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।