ব্রহ্মপুত্র-যমুনার বালু বিদেশে রপ্তানি?

প্রমথনাথ বিশী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের নদীকে যে নিবিড়ভাবে জানতে পারে না, সে কীভাবে বাংলাদেশকে জানবে?...কোমল, পাললিক বঙ্গ তাদের শিশু।’ সেই বাংলাদেশই নিজে যা দ্বারা গঠিত হয়েছে, তা আজ রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছে। ৭ মার্চ প্রথম আলোর অনলাইনে প্রকাশিত ‘যমুনার বালু যাচ্ছে মালদ্বীপ ও সিঙ্গাপুরে’ শিরোনামের খবরে বলা হয়েছে: যমুনার বালু মালদ্বীপ ও সিঙ্গাপুরে রপ্তানি করা হবে। এই দুই দেশে রপ্তানির জন্য উত্তোলিত বালু প্রতি ঘনফুটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে এক টাকা। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সোমবার জাতীয় বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
খবরে আরও জানা যায়, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ড্রেজিং লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান নিজ খরচে প্রাথমিকভাবে দুই বছরের জন্য যমুনা নদী ড্রেজিং এবং ড্রেজিং করা বালু সিঙ্গাপুর ও মালদ্বীপে রপ্তানির বিষয়ে পানিসম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৮ অক্টোবর তিন মন্ত্রণালয় যৌথভাবে পরীক্ষামূলক বালু উত্তোলন ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার ড্রেজিং লিমিটেড দ্বারা বিদেশে বালু রপ্তানির বিষয়টি জাতীয় বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় আলোচনা হয়। উল্লেখ্য, কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী নদীবন্দরকে পুনরায় চালু করার বিষয়ে গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। বন্দরটিতে জাহাজ আনা-নেওয়ার জন্য ব্যাপক ড্রেজিং কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।

>সিঙ্গাপুর ও মালদ্বীপ যে কারণে বালু আমদানি করতে চায়, সেই একই কারণে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের নতুন ভূমি গড়ে তুলে আয়তন বৃদ্ধির জন্য বালুর দরকার নেই? ড্রেজিংয়ের সময় যে চরগুলো বিলীন হয়ে যাবে, তার বাসিন্দারা মালিকানাচ্যুত হয়ে যাবেন কোথায়?

ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তিস্থল চেমাইয়াংডুং হিমবাহ থেকে শানপো নামে প্রায় ১২ হাজার ফুট উঁচু মালভূমির ওপর দিয়ে পূর্ব দিকে প্রায় এক হাজার মাইল প্রবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ দক্ষিণ দিকে ঘুরে ৪৪২ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত সাদিয়ার কাছে আসামে প্রবেশ করেছে। আসাম উপত্যকায় প্রথমে ডিহং এবং পরে ব্রহ্মপুত্র নামে পশ্চিম দিকে প্রায় ৪৫০ মাইল প্রবাহিত হওয়ার পর গারো পাহাড়ের কাছে হঠাৎ দক্ষিণে বাঁক নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলার নুনখাওয়া-চিলমারী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারপর উনিশ শতকে গাইবান্ধার ফুলছড়ির কাছে পুরোনো ধারাটি পূর্ব দিকে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নামে ময়মনসিংহ হয়ে ক্ষীণ হয়ে আসে। আর যমুনা নামে প্রধান ধারাটি ১৫০ মাইল দক্ষিণে প্রবাহিত হওয়ার পর গোয়ালন্দের কাছে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়ে পদ্মা নামে প্রবাহিত হয়েছে। এই মিলিত স্রোত চাঁদপুরের কাছে মেঘনায় এবং পরে ওই তিন ধারা মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। আমাদের গণমাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নথিপত্রে চিলমারী থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত যমুনা নামে ভুলভাবে চিহ্নিত করা হয়।
নদ-নদী এমন ধরনের জলধারা, যা উৎপত্তির মূল থেকে শুধু পানি বহন করে না, তা নুড়ি-বালু ও পলিও বহন করে। নদীর সমুদ্রাভিমুখে যা পার্বত্য ও পুরোনো উচ্চ পলি পড়া ভূ-ভাগের ক্ষয়সাধন করে বৃষ্টির পানি নদীতে এনে দেয়। আর নদ-নদীপ্রবাহের সঙ্গে সেই মৃত্তিকা বহন করে এনে আবার নতুন জায়গায় নতুন ভূ-ভাগ সৃষ্টি করে, যেভাবে সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ।
সিঙ্গাপুরের নামে বালু চুরির অভিযোগ বেশ পুরোনো। মালয়েশিয়া দীর্ঘদিন ধরে এই অভিযোগ জানিয়ে আসছে। নগররাষ্ট্র হিসেবে সিঙ্গাপুর বিভিন্ন দেশে থেকে বালু আমদানির মাধ্যমে সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে স্থলভাগ বাড়িয়ে নিচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে মালদ্বীপের ভারত মহাসাগরে তলিয়ে যাওয়ার ভয় সৃষ্টি হয়েছে। মালদ্বীপ সরকার কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ার কাছে জমি কিনতে চেয়েছে, যদিও তারা রাজি হয়নি। চলতি মার্চ মাসের প্রথম শুক্রবার দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ‘ভূ-প্রকৌশলে কৃত্রিম দ্বীপ’ এবং ‘জনসংখ্যা স্থানান্তরের’ বিষয়ে সে দেশের মন্ত্রীদের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরা হয়েছে। সে দেশের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, সৌদির সহযোগিতায় ফাকু দ্বীপমালাকে দুবাইয়ের মতো নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চায়।
মালদ্বীপ ও সিঙ্গাপুরে এক ঘনফুট বালু ড্রেজিং কোম্পানি নিয়ে যাবে এক টাকা দরে। স্থানীয়ভাবেই এক টন বালু বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকায়। অথচ সেই অনুসারে রপ্তানি করা এক টন বালুর দাম পড়বে ৫০-৬০ টাকা। যখন বালু রপ্তানি শুরু হবে, তখন স্থানীয়ভাবে ব্যবহারের জন্য বালুর দাম বেড়ে যাবে আরও কয়েক গুণ। কিন্তু বালুর একচ্ছত্র মালিক বনে যাবে ড্রেজিং কোম্পানি।
ভূতত্ত্ব জরিপ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের তথ্যমতে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনার কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার অংশের প্রতি টন বালুতে কাচ তৈরির উপাদান সর্বোচ্চ পরিমাণ কোয়ার্টজ সিলিকা ৫০ কেজি, ইলমিটাইট ৬০০ গ্রাম, জিরকন ৪০০ গ্রাম, রুটাইল ৪০০ গ্রাম, গার্নেট ২ কেজি ৫০০ গ্রাম ও মোনাজাইট ১০০ গ্রাম আছে। যার মোট চলতি বাজারমূল্য ৩ লাখ ২০ হাজার ৮৯২ টাকা। অর্থাৎ ১ টন বালু থেকে ৫৪ কেজি খনিজ উপাদান আলাদা করে বিক্রি করলে বাংলাদেশ পাবে সোয়া ৩ লাখ টাকা। বাকি বালু নতুন ভূমি গঠনে ও ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের পুনর্বাসনে ব্যবহার করা যায়। এ জন্যই সেই ১৯৭৮ সালে চীন ও অস্ট্রেলিয়ার পক্ষ থেকে করা বালু আমদানির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে ভূতত্ত্ব জরিপ অধিদপ্তর বালু উত্তোলনের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে রেখেছে। ২৯ আগস্ট ২০১৫ সালে এ বিষয়ে কমনওয়েলথ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা সংস্থা এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের মধ্যে একটি সমঝোতা স্বাক্ষরও হয়। স্বাক্ষরপত্রে বলা হয়েছে, প্রতিবছর ২৫০ মিলিয়ন টন খনিজ বালু সংগ্রহ করা সম্ভব।
কিন্তু ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘কার্বন মাইনিং বাংলাদেশ লিমিটেডের’ (সিএমবিএল) অনুকূলে কুড়িগ্রামের উলিপুর ও চিলমারীর অন্তর্গত ব্রহ্মপুত্র বেসিনের ব্লক-এ, ব্লক-বি ও ব্লক-সি এলাকায় খনি ইজারা প্রদানের লক্ষ্যে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে সিএমবিএলকে খনি ইজারার শর্তসমূহ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার জন্য একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে। অথচ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর ও পরমাণু শক্তি কমিশনের কাজটি করার বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা দুটিই রয়েছে। এই ইজারার শর্তেও রপ্তানির বিষয়টি থাকলেও আমরা আশ্চর্য হব না!
সিঙ্গাপুর ও মালদ্বীপ যে কারণে বালু আমদানি করতে চায়, সেই একই কারণে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের নতুন ভূমি গড়ে তুলে আয়তন বৃদ্ধির জন্য বালুর দরকার নেই? ড্রেজিংয়ের সময় যে চরগুলো বিলীন হয়ে যাবে, তার বাসিন্দারা মালিকানাচ্যুত হয়ে যাবেন কোথায়? একমাত্র সমাধান এই বেসিনে খনিজ পৃথক্করণ গবেষণাগার ও ব্যবহারের জন্য শিল্পকারখানা স্থাপন ও বাকি সাধারণ বালু দিয়ে নদীর দুই পারে নতুন ভূমি গড়ে তোলা।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রমতে, ‘যে শাস্ত্রে ভূমির অধিকার ও রক্ষণাবেক্ষণের উপায় নির্দেশিত, তাই হলো রাজনীতি; আর যে শাস্ত্রে পৃথিবীতে লাভ ও পালনের উপায় বর্ণিত, তা হলো অর্থশাস্ত্র। যে বস্তু এখনো পাওয়া যায়নি, তাকে হস্তগত করাই লাভ এবং যা পাওয়া গেছে তার যথাযথ পরিচর্যাই পালন।’
সে মতে ভূমি ও খনিজ সম্পদের প্রশ্ন রাজনীতি ও অর্থশাস্ত্র দুটিরই ব্যাপার। সেই রাজনীতি অর্থশাস্ত্রের ব্যাপারে চাণক্যদের কাছে বরাবর হেরে গেছি বলে ‘ব্রহ্মপুত্র সভ্যতা’ বলে কিছু নেই। আজকেও ব্রহ্মপুত্র-যমুনার জলের মতো কালো মানুষের হাতে রাজনীতি নেই বলে অর্থশাস্ত্রও নেই। তাই আমাদের রাষ্ট্রের পরিচালকেরা দেশের মাটি বিক্রির আয়োজন করেন। গঙ্গা মানে গঙ্গার পলি আটকে গেছে ফারাক্কায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পলিও যদি ভাটির দেশ থেকে বিদেশে যায়, তাহলে সমুদ্রের গর্ভে হারিয়ে যাওয়াই কি আমাদের নিয়তি? আর নদীভাঙা মানুষেরা ভিটে হারিয়ে যাবেন কোথায়?
নাহিদ হাসান: প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।
[email protected]