প্রতিরক্ষা কূটনীতিতে দিল্লির প্রস্তুতি নেই

>প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৭ থেকে ১০ এপ্রিল ভারত সফর করবেন। এ সময়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব প্রসঙ্গ নিয়ে চীনের সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমস ও ভারতের দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস–এ প্রকাশিত দুটি নিবন্ধ প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে প্রকাশিত হলো।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় ভারতের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা এবং গত সপ্তাহে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী চ্যাং ওয়াংকুয়ানের শ্রীলঙ্কা ও নেপাল সফরের মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, ভারতের আশপাশে প্রতিরক্ষা কূটনীতির নতুন হালচাল শুরু হয়েছে। ভারতীয় সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াতও এ সপ্তাহে বাংলাদেশ ও নেপাল সফরে যাচ্ছেন।

কেউ এটাকে প্রতিবেশী দেশে রুটিন সফর ভাবতে পারেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে প্রতিরক্ষা বন্দোবস্ত আনুষ্ঠানিক রূপ পায়নি। এখন এটি হতে যাচ্ছে এমন সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ায় ঢাকার গণমাধ্যমে বেশ উদ্বিগ্ন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকার কেউ কেউ ভাবছেন, বাংলাদেশে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতির রাশ টেনে ধরতেই নয়াদিল্লি এই চুক্তি করতে চাইছে। চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের দুটি সাবমেরিন কেনার ব্যাপারটিও এর মধ্যে আছে। আবার অন্যদের উদ্বেগ, ঢাকা দিল্লির একটু বেশি কাছে চলে যাচ্ছে।
জেনারেল চ্যাংয়ের শ্রীলঙ্কা ও নেপাল সফরের প্রাক্কালে চীনা সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমস-এ দিল্লিকে সতর্ক করা হয়, তারা যেন ভারতের প্রতিবেশীদের সঙ্গে বেইজিংয়ের কৌশলগত সহযোগিতায় নাক না গলায়। তারা অভিযোগ করে, দিল্লি ‘দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরকে পেছন-উঠান’ মনে করছে। ভারত যদি ‘চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে চায়’, তাহলে ‘বেইজিংকে পাল্টা লড়াই করতে হবে, কারণ এতে তার মূল স্বার্থ লঙ্ঘিত হবে’। গ্লোবাল টাইমস এমনিতে বেশ স্পষ্টভাষী, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের এই বক্তব্য খুবই কড়া।
এখানে কী হচ্ছে? ভারতের প্রতিবেশীদের সঙ্গে চীনের নিরাপত্তা সহযোগিতা নতুন কিছু নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে ভারতের নিরাপত্তা মহলের বহুদিনের উদ্বেগ। এই সহযোগিতার মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি স্থানান্তরের মতো বিশেষ ব্যাপারও রয়েছে। আজ আমরা দেখছি, চীনের প্রতিরক্ষা বন্দোবস্ত পাকিস্তান ছাড়িয়ে ভৌগোলিকভাবে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। চীনের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ব্যাপারটা এত দূর চলে গেছে যে, তারা এই অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটিও করতে পারে।
কলম্বো ও হাম্বানটোটায় চীনের বন্দর নির্মাণের যে কৌশলগত মাত্রা আছে, সেটা কিন্তু শ্রীলঙ্কার পানিতে চীনা সাবমেরিনের ভুস করে মাথা তোলার মধ্য দিয়েই বোঝা গিয়েছিল। আফ্রিকার জিবুতিতে চীনের প্রথম বিদেশি সামরিক ঘাঁটি হতে যাচ্ছে। পাকিস্তানের করাচি বন্দর ও গাদারে চীনা নৌবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি আছে, যেটা অদূর ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ সামরিক স্থাপনায় রূপান্তরিত হতে পারে।
গ্লোবাল টাইমস নয়াদিল্লিকে উপদেশ দিয়েছে, ভারতের প্রতিবেশীদের সঙ্গে চীনের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের ব্যাপারটি দিল্লিকে মেনে নিতে হবে। ‘এসব দেশে বেশি বেশি চীনা প্রতিষ্ঠান শিকড় গাড়তে শুরু করলে চীন অনিবার্যভাবেই তাদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করবে। শুধু চীনের নয়, এই অঞ্চলের স্বার্থ রক্ষার্থেও তাদের এটা করতে হবে।’
ভারত দেরিতে হলেও এই ব্যাপারটা আমলে নিতে শুরু করেছে। দিল্লি এখন বুঝতে পারছে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক ও অবকাঠামোগত সহায়তা বাড়তে থাকলে এর কৌশলগত রূপও দেখা যাবে, যার মধ্যে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা অংশীদারিও থাকতে পারে। ইউপিএ সরকার চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পকে আপত্তিসহকারে মেনে নিলেও নরেন্দ্র মোদির সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর সম্পর্কেও সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছে। ভারত আন্তসীমান্ত যোগাযোগ ও প্রতিরক্ষা কূটনীতিও জোরদার করেছে। এতে যে বেইজিং ও দিল্লির মধ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ বাড়বে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরং ভারত যে উপমহাদেশে চীনের ক্ষমতা বিস্তারের ব্যাপারে এত দিন পরে কার্যকরভাবে সাড়া দিল, সেটাই বরং বিস্ময়ের ব্যাপার।
পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের বহুদিনের সামরিক সম্পর্ক এবং দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে ক্রমবর্ধমান হারে চীনের অস্ত্র বিক্রিকে ভারত এত দিন ভালোভাবে না নিলেও তারা আশপাশের দেশগুলোতে চীনের কৌশলগত প্রভাব বৃদ্ধির ব্যাপারে একেবারেই অপ্রস্তুত ছিল। দিল্লি অনেক দিন থেকেই উপমহাদেশে নিজের স্বাভাবিক শক্তি সম্পর্কে আত্মসন্তুষ্ট ছিল।
স্বাধীনতার পর ভারত তার আশপাশে পশ্চিমা, বিশেষ করে ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ১৯৮০ সালে আফগানিস্তান দখল করে নেয়, তখন সে খুবই সতর্কতার সঙ্গে ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করেছে। কিন্তু বহুদূরের যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রভাব আজ ২১ শতকে ক্ষয়ে যাচ্ছে, এখন চীনের সামরিক শক্তি ভারতকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি দেশীয় অস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানির কথা বলেছেন, কিন্তু তিনি এখনো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আলস্য দূর করাতে পারেননি।
এমনকি তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রতিরক্ষা কূটনীতির ব্যাপারটা গ্রহণ করাতে পারেননি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সামরিক
বাহিনী বারবার অনুনয়-বিনয় করা সত্ত্বেও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ব্যাপক পরিসরে সামরিক বিনিময় করতে পারেনি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের এ-বিষয়ক বর্তমান মনোভঙ্গি না বদলালে ‘ভারতীয় আঞ্চলিক আধিপত্য’ ও ‘উপমহাদেশের কৌশলগত একতা’ নিয়ে দিল্লির বাগাড়ম্বর দূর করতে বেইজিংয়ের তেমন একটা বেগ পেতে হবে না।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া।
সি রাজা মোহন: ভারতীয় কলামিস্ট।