কূটনীতি বনাম রাজনীতি

আমাকে মাফ করবেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের যে দাবি কোনো কোনো মহল থেকে তোলা হচ্ছে, সে ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। সে দেশের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, তা আমরা জানি। কাউকে নিন্দা বা সমর্থন করে পার্লামেন্টে এ ধরনের রুটিন প্রস্তাব গ্রহণ তো নতুন কোনো ব্যাপার নয়। মার্কিন কংগ্রেসে হরহামেশাই কাউকে না কাউকে গালমন্দ করে প্রস্তাব উঠছে। সে একধরনের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি। কিন্তু রাজনীতি ও কূটনীতি তো এক নয়, এই দুটোকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে কী করে!
পত্রিকার পাতায় অথবা রাজনৈতিক সমাবেশে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের দাবি উঠলে তাতে ভ্রু কুঁচকানোর কিছু নেই। কিন্তু এমন দাবির পক্ষে সমর্থন যদি সরকারের ভেতর থেকে আসে, তাহলে মাথা চুলকাতে হয় বইকি! বাংলাদেশ সরকারের একজন বর্ষীয়ান মন্ত্রী, যিনি নিজে একসময় কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, মুখ ফসকে বলে বসেছেন, পাকিস্তান একটি বর্বর দেশ। কথাটা শুনে ভড়কে গেছি। পুরো একটা দেশকে বর্বর বলে ফেললাম! সেখানে এখনো কয়েক লাখ বাঙালি স্থায়ীভাবে বাস করে। একাত্তরে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় জেলে যেতে হয়েছে, এমন মানুষও পাকিস্তানে আছে। পাকিস্তানি শাসকদের, অথবা সে দেশের জামায়াত বা ইমরান খানের মতো সুযোগসন্ধানী রাজনীতিকের নাম ধরে ‘বর্বর’ বা আরও কঠিন-কঠোর মন্তব্য করলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকত না। কিন্তু পুরো একটা দেশ ও সে দেশের মানুষ?
ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিদেশীয় চুক্তিতে ১৯৭৪-এ আমরা পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের বিচারের দাবি তুলে নিয়েছি। যে ১৯৫ জন সেনাসদস্যকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, পাকিস্তান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সে নিজেই তাদের বিচার করবে। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি পাকিস্তান রাখেনি। একটা ‘অলিখিত’ পাল্টা শর্ত ছিল, পাকিস্তান নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেবে। তখন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। তারপর বিভিন্ন সময়ে একাত্তরে অপরাধের জন্য পাকিস্তানের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার দাবি আমরা তুলেছি। বিএনপি সরকারের আমলে ২০০২ সালে পাকিস্তানি সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশ সফরে এলে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ‘অতিথি মন্তব্য খাতা’য় ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের জন্য ‘দুঃখ’ প্রকাশ করেছিলেন। পরে, রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সেই দুঃখ প্রকাশের জন্য মোশাররফকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন এবং উভয় দেশকে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে সামনে এগোতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
এসব কোনো কিছুতেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর প্রতি একাত্তরে তাদের ভূমিকার জন্য আমাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ বন্ধ হয়নি, হবেও না। আমি এই পত্রিকাতেই মোশাররফের দুঃখ প্রকাশকে ‘লোক দেখানো ব্যাপার’ হিসেবে অভিহিত করে মন্তব্য করেছিলাম, আমাদের দেশের পাতি মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী যে যা-ই বলুন না কেন, পাকিস্তানকে ঘৃণা করার অধিকার তাঁরা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবেন না। এমনকি পাকিস্তান যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করে, তা-ও নয়। কারণ, এই ঘৃণার অধিকার যেন এক মশাল, যা আমাদের স্মৃতিতে একাত্তরের ইতিহাসকে জাগিয়ে রাখে, তার আগুন জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব আমার, আমাদের প্রত্যেকের।
কিন্তু তাই বলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ হোক, এমন দাবি অযৌক্তিক।
আমরা চাই বা না চাই, ভৌগোলিক কারণে দক্ষিণ এশীয় দেশ হিসেবে আমরা একই ভূখণ্ডের অধিবাসী, প্রতিবেশী। সব প্রতিবেশীর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সুসম্পর্ক থাকুক, আমরা তা-ই চাই। এর এক কারণ, সুসম্পর্কের বদলে উত্তেজনা বিরাজ করলে তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়বে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে। যেমন, বৈরিতার সুযোগ নিয়ে পাকিস্তান আমাদের দেশে সন্ত্রাসী রাজনীতি ‘রপ্তানি’ করতে পারে। আমাদের নির্বাচনী রাজনীতিতেও তারা নাক গলাতে পারে। পারে কেন, তারা সে চেষ্টা করে এবং আমাদের কোনো কোনো দল তার পুরো ফায়দা আদায় করে নেয়, এ তো একদম অজ্ঞাত ব্যাপার নয়।
নাশকতামূলক কাজে পাকিস্তানের সম্ভাব্য অংশগ্রহণ ও প্রত্যক্ষ মদদ কোনো বানানো গল্প নয়, প্রতিবেশী ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে তা স্পষ্ট। ২০০৮ সালে পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলার রক্ত-দাগ এখনো মুছে যায়নি। সে কথা বারবার স্মরণ করে ভারতের রাজনীতিকেরা অথবা কলম লেখিয়েরা যত গরম গরম কথাই বলুন, সরকারি পর্যায়ে কিন্তু ভারত উল্টো পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সন্ত্রাসবাদকে রুখতে হলে এই দুই দেশকেই একযোগে কাজ করতে হবে, এ কথা ভারত ও পাকিস্তানের নেতারা উভয়েই প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন।
পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য আরেক কারণ বাণিজ্যিক। মোট পরিমাণ বা মূল্যমানের হিসাবে আমাদের দুই দেশের বাণিজ্য তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, কিন্তু সে বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বরেই তো বাংলাদেশ থেকে একটি বাণিজ্য প্রতিনিধিদল পাকিস্তানে গিয়ে তাদের সঙ্গে ৮০ লাখ ডলারের বাণিজ্য চুক্তি করল। এই চুক্তির ফলে পাকিস্তান থেকে আমরা তৈরি ফ্যান ও তার খুচরাংশ এবং শুকনো ফলমূল আমদানি করব। বলা বাহুল্য, পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো দেশ (যেমন ভারত অথবা চীন) থেকেও আমরা এসব আমদানি করতে পারি। কিন্তু সব কৌশলগত পরিকল্পনাবিদই জানেন, নিজের সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখতে নেই। চীন ও ভারতের ওপর আমরা এমনিতেই নানাভাবে নির্ভরশীল। সেই নির্ভরতা আরও বৃদ্ধি পেলে যেকোনো বাণিজ্যিক চুক্তিকালে নিজের স্বার্থ ধরে রাখার মতো কবজির জোর আমাদের থাকবে না। (আমাদের কোনো কোনো ভগিনী ও জায়া যে পাকিস্তানে বানানো তৈরি পোশাক ছাড়া তাঁদের ঈদ সম্পূর্ণ হলো না বলে ভাবেন, সে-ও তো একদম মিথ্যা কথা নয়! অনুমান করি, দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক বন্ধ হলে সেসব বোন-ভাবীর আহাজারি থামানো খুব সহজ হবে না।)
যদি খেলাধুলার মতো ‘ফালতু’ বিষয়ের কথাও ধরি, এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদের দাবিতে উত্তেজনা অব্যাহত থাকলে, সে ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়বে। সহিংসতার ছুতোয় পাকিস্তানি ক্রিকেট দল ২০১৪ সালে এশিয়া কাপ ও বিশ্ব টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতায় যোগ না-ও দিতে পারে। বাংলাদেশে আমরা সবাই এমনিতেই ক্রিকেটপাগল। নিজের দেশের মাটিতে এমন সম্মানজনক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের সুযোগ সে পেয়েছে, তার জন্য অপেক্ষা করছে প্রতিটি ক্রিকেট-প্রেমিক। এখন সে চেষ্টায় এক বিন্দু চুন বা গোবর এসে লাগলে, তাতে আমাদের নিজেদেরই ক্ষতি।
এ তো গেল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কথা। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আমাদের ভাগ্য এক সুতোয় বাঁধা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে আমরা বৃহৎ শক্তিগুলোর বৈরিতার মুখে রয়েছি। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় সুবিধাজনক শর্ত অর্জনের জন্য জেনেভাভিত্তিক বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় একযোগে, অথবা যৌথভাবে, পূর্বাহে গৃহীত সাধারণ সম্মতির ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করে থাকে। এর ফলে একটা লড়াকু অবস্থান গ্রহণ আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। ভূপৃষ্ঠের তাপ বৃদ্ধি আমাদের জন্য একটি জীবন-মরণ সমস্যা। এ ব্যাপারে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো অভিন্ন অবস্থান নেওয়ায় ধনী দেশগুলোর ‘আমরা যা বলব, তোমাদের তা-ই মানতে হবে’, এমন ঔপনিবেশিক দৃষ্টভঙ্গি কিছুটা হলেও বদলানো গেছে।
কেন পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ধরে রাখা দরকার, তার পক্ষে আরও ১৪টা যুক্তি তুলে ধরা যায়। কিন্তু আমাদের যে ব্যাপারটা বোঝার ও ভাবার, তা হলো কূটনীতি ও রাজনীতিকে আলাদা রাখার প্রয়োজনীয়তা। যার যার নিজের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে এক বা একাধিক প্রশ্নে কঠোর অবস্থান নিতেই পারে। আমাদের পাশের বাড়ির মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই ধরুন। পশ্চিম বাংলার স্বার্থ রক্ষার যুক্তিতে খোলামেলাভাবেই তিনি বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এটি তাঁর ঘরোয়া রাজনীতি, বাংলাদেশবিরোধিতার তাস ব্যবহার করে নিজের ভোটব্যাংক তিনি স্ফীত করেছেন। ঠিক একইভাবে কেন্দ্রে বিজেপি পাকিস্তানবিরোধী তাস ছিটিয়ে আগুন ধরার ব্যবস্থা করছে। বলাই বাহুল্য, তারও ওই এক কারণ, ভোট। কিন্তু কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে মমতা বা নরেন্দ্র মোদি দুজনেই আগ বাড়িয়ে পাকিস্তান সফরের উদ্যোগ নেবেন। আর সেটি হলো কূটনীতি।
ইংল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চার্চিল একসময় মন্তব্য করেছিলেন, ‘কূটনীতি হলো এমন একটা “আর্ট” যে, তুমি কাউকে “জাহান্নামে যাও” বলবে এমনভাবে, যেন সে তোমার কাছে এসে সেখানে যাওয়ার ঠিকানা খোঁজ করে।’ আড়াই হাজার বছর আগে চীনা সমরবিশেষজ্ঞ সান জু পরামর্শ দিয়েছিলেন, যুদ্ধের সর্বোত্তম পথ হলো, একটা গুলি খরচ না করেও শত্রুকে ঘায়েল করা। আমি অনুমান করি, সান জুর আর্ট অব ওয়ার আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কেউ পড়েননি। কিন্তু তাঁরা চার্চিলের পরামর্শটা তো নিতে পারেন।
প্রতিবেশী দেশ, সে যদি শত্রুও হয়, তার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ অথবা গোটা দেশটাকেই ‘বর্বর’ বলে ঢালাওভাবে গাল দেওয়া শুধু উত্তম কূটনীতি তো নয়ই, তাকে বুদ্ধিমনস্ক রাজনীতিও বলা যাবে না।
 হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।