গায়েবি ব্যাপার কি চলতেই থাকবে?

‘পুকুর চুরি’ কথাটা বাঙালি মাত্রই জানেন। তবে কিছু কিছু দুর্নীতিকে বোধ হয় পুকুর চুরি বললে ঠিক বোঝা যায় না। কমপক্ষে নদী বা বিল চুরি বলা উচিত। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম যে হবে, সেটা আমরা সাধারণ মানুষ মোটামুটি মেনেই নিয়েছি। কিন্তু সেটা যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন আসলে আমরাও হতভম্ব হয়ে পড়ি। তারপর আবার যখন আমাদের দেশের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা সেটাকে ‘কিছুই না’ বা ‘সামান্য ঘটনা’ বলে উড়িয়ে দেন, তখন অধিক শোকে পাথর হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এখানকার মানুষের বৃহৎ অংশই কৃষিকাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। অথচ এ খাতে অনিয়মের ঘটনা হরহামেশা ঘটে যাচ্ছে। ঠিক দাম না পেয়ে খেতের ফসল এনে রাস্তায় ফেলে দিয়ে প্রায়ই প্রতিবাদ করেন আমাদের আলু, মুলা কিংবা টমেটোচাষি। কৃষক যাতে ফসলের ন্যায্য দাম পান, এ ব্যাপারে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ যেমন দেখি না, তেমনি ফসল ফলানোর জন্য জমিতে যে সার দিতে হয়, তার প্রাপ্তিতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় মাঠের কৃষককে।

প্রথম আলোর (৭ এপ্রিল ২০১৭) একটি প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীন সান্তাহার বাফার গুদাম থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকার সার লাপাত্তা। কোনো হদিসই নেই এ সারের। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দাবি করছে, তারা গুদামে সার পৌঁছে দিয়েছে। অন্যদিকে, গুদাম-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র নাকি উইপোকায় খেয়ে ফেলেছে। উইপোকাদের বুদ্ধিমান না মেনে উপায় কী! ঠিক যে পরিমাণ সারের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না, বেছে বেছে সে পাতাগুলোই কেটে গায়েব করে দিল! আগের দিনে নাকি কাজীর গরু কিতাবে থাকত, গোয়ালে থাকত না। কিন্তু আজকের দিনের দুর্নীতিবাজেরা আরেক কাঠি সরেস। তারা গোয়ালেরটা তো সরায়ই, কিতাবও হাপিশ করতে ছাড়ে না।

যেখানে গুড় সেখানে মাছির সূত্রে সান্তাহার বাফার গুদামে দুর্নীতির এমন চিত্র নতুন নয়। ২০১৩ সালেও এ গুদাম থেকে প্রায় দুই হাজার মেট্রিক টন সার লোপাট হয়ে যায়। ২০ কোটি টাকার সার হাওয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনা যাঁরা তদন্ত করছেন, তাঁরা এর সত্যতা পেয়েছেন। তাঁরা বলছেন, পণ্য প্রাপ্তি স্বীকার-সংক্রান্ত রসিদ (এমআরআর) বইয়ে ৫৯টি পৃষ্ঠা গায়েব হয়ে গেছে। এর কারণ জানতে চাইলে গুদাম কর্তৃপক্ষ বলছে, নির্দিষ্ট ওই পৃষ্ঠাগুলো উইপোকায় খেয়ে ফেলেছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে যখন সান্তাহার বাফার গুদাম থেকে দুই হাজার মেট্রিক টন সার লোপাট হওয়ার ঘটনা ঘটে, তখন গুদামের ইনচার্জ ছিলেন নবির উদ্দিন। একইভাবে সাম্প্রতিকতম ২০ কোটি টাকার সার লোপাটের ঘটনার সময়ও গুদামের ইনচার্জ ছিলেন নবির উদ্দিন। তদন্ত কমিটির সদস্য বিসিআইসির সহকারী হিসাব কর্মকর্তা রাশেদ নিজাম বলেন, ‘আমাদের মনে হয়েছে, এ রকম আরও অনেক ঘটনা রয়েছে সার চুরির।’ ফলে, এ বিষয়ে আরও তদন্ত হওয়া উচিত।

শুধু গুদাম থেকে নয়, এমনকি নথি গায়েব হচ্ছে আদালত থেকেও। গোপালগঞ্জের আদালত থেকে হত্যা মামলার বেশ কিছু নথি গায়ের হওয়ার ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছে বাদীপক্ষ। (প্রথম আলো, ৩১ মার্চ ২০১৭)। মামলাটির ১৭ জন সাক্ষীর জবানবন্দি ও জেরার নথি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবতে অবাক লাগে, আদালতের মতো একটি স্পর্শকাতর জায়গা থেকে কী করে গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলার নথি হারিয়ে যায়। নথির নিশ্চয়ই হাত-পা গজায়নি! এটি প্রায় ১১ বছর আগের একটি মামলা। সাক্ষীদের মধ্যেও অনেকেই মারা গেছেন। সুতরাং, এর কার্যক্রম এগিয়ে নিতে নতুন করে সাক্ষ্য ও জবানবন্দি নেওয়া মোটামুটি অসম্ভব। আদালতের নথি যেসব ব্যক্তির হেফাজতে থাকে, দ্রুত তাঁদের আইনের আওতায় আনা উচিত এবং সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজে এ নথি উদ্ধার করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত কর্তৃপক্ষের।

এর আগে ২০১০ সালে চট্টগ্রাম থেকে আরেকটি হত্যা মামলার কেস ডাকেট গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তখনো অভিযোগের আঙুল উঠেছিল আদালতের দুর্নীতিবাজ কর্মচারীর দিকে। এ রকম নথি গায়েবের ঘটনা নিশ্চয়ই আরও অনেক রয়েছে। গণমাধ্যমে সব ঘটনা উঠেও আসে না সব সময়। গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র গায়েবের শাস্তি যথাসম্ভব কঠোর হওয়া উচিত। এসব ঘটনাকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। হত্যা মামলার নথি গায়েব আরেকটি হত্যার সমান বলে কেন মনে করছি না আমরা? কেনইবা সারের গুদামের নথি গায়েবকে সমপরিমাণ সার লোপাটের সমান অপরাধ বলে গণ্য করব না আমরা? আইনকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এসব গায়েবি ব্যাপার কি চলতেই থাকবে?