দশম সংসদ বৈধতা পাবে না

সংসদ ভবন
সংসদ ভবন

বৈধতার প্রশ্ন উঠেছে এবং ৫ জানুয়ারির পরে কেবল রাজনৈতিক বৈধতা নয়, সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্নও উঠবে। ইতিমধ্যে দিল্লিতে গত ৩১ ডিসেম্বর ভারতীয় সাংবাদিকেরা তাঁদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের কাছে বৈধতার প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্নটি সরল, কিন্তু উত্তর গরল। তাই মুখপাত্র এর উত্তর দেননি। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘জনাব, ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে নির্বাচন হচ্ছে। এখন এটা স্পষ্ট যে বিরোধী দল অংশ নিচ্ছে না। এই নির্বাচনের বৈধতার প্রশ্নে আমাদের কি কোনো মন্তব্য রয়েছে?’ মুখপাত্রটি প্রবাদের ‘গরু রচনা’ মুখস্থ বলেছেন। জবরদস্তি গরু টেনে নদীতে ফেলেছেন। বলেছেন, ‘এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, দুই দেশের ভালোমন্দে পরস্পরের বৈধ স্বার্থ রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আবারও বলেন, ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই নির্বাচন হচ্ছে। সরে যাওয়ার উপায় নেই।’
জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করা হয়েছিল। এবারও তা করা সম্ভব। অনেকে বলছেন, ঘড়ির কাঁটা ৫ জানুয়ারি পেরোলেই কেল্লা ফতে। বিএনপি বা অন্য কেউ নির্বাচন বাতিলের কথা মুখে আনতে পারবে না। কিন্তু আমরা যদি বাংলাদেশের সাংবিধানিক চেতনা বিবেচনায় নিই, যদি মনে রাখি বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ছাড়াও দেশে বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ বিচারপতি ছিলেন এবং আছেন, তাঁদের লেখা রায়গুলোও প্রজাতন্ত্রের প্রচলিত আইন, তাহলে অন্তত আর যা-ই হোক, আমাদের সংবিধান দেখানো হবে না। আমাদের ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ের ভয় দেখানো হবে না।
১ জানুয়ারি সজীব ওয়াজেদ জয় বৈশাখী টিভির এক প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘এই নির্বাচন সংবিধানের চেতনার বিরুদ্ধে যায় না।’ এটা সর্বৈব অসত্য। এর আগেও নির্দিষ্টভাবে বলেছি, দরকার হলে আরও অনেক রায় দিয়ে প্রমাণ করতে পারি, এই নির্বাচন সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করছে। এমনকি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সপক্ষে ফেনা তোলা রায়গুলোরও পরিপন্থী।
জয় বলেছেন, বিএনপির জন্য সংবিধান সংশোধন কমিটি দুই বছর নাকি বসে ছিল। ধরে নিলাম সত্য। চাইলে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে সংবিধানের নতুন সংশোধনী আনা যাবে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন করে ফেললেও এতে কোনো বাধা সৃষ্টি হবে না। সংবিধানে আরও ঘাপলা আছে। সংবিধান রক্ষা নিয়ে ফেনা তুলছে অথচ তারা একটি সংশোধনী আনতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। নবনির্বাচিতদের শপথ পড়ানো নিয়ে সংবিধানে সংঘাতপূর্ণ বিধান আছে। ৫ জানুয়ারির পরে তারা চাইলে একটা সংশোধনী আনতে পারে। অন্যথায় বশংবদ ইসির আনুকূল্যে নবনির্বাচিতরা সংঘাত মাড়িয়ে শপথ পড়বেন।
‘সংবিধান অনুযায়ী’ কথাটা যদি প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মিত্রদের শর্ত ছাড়াও যুক্তিসংগত ও গ্রহণযোগ্য বলে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে মানতে হবে নির্বাচন কমিশন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরও গোটা নির্বাচন বাতিল করার এখতিয়ার রাখে। এর আগে দেখিয়েছি, কী করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করে আগামী এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন করা যায়। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ১ জানুয়ারি চ্যানেল আইয়ে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের জটিলতার কথা বলেছেন। কিন্তু এটাকে এখন জটিল বলা যাবে না। উতরানো সম্ভব।
যাক এবার বলি, ৫ জানুয়ারির পর কী হবে? নির্বাচন কমিশন ওই দিন বা তার পর যেকোনো দিন নির্বাচন বাতিল করতে পারবে। আমরা এটাও মনে রাখব, তারাও নির্দিষ্টভাবে বেআইনি কাজ করেছে। বর্তমান তফসিল সেই বিচারে অবৈধ। ঋণখেলাপিদের টাকা জমা দেওয়া ও তাঁদের মনোনয়নপত্র দাখিলের মধ্যে সাত দিন সময় রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তারা তা খেয়াল করেনি। নির্বাচন কমিশনের সবারই এটা জানা। কিন্তু চুপচাপ আছে।
২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দশম সংসদের কাউকেই সংসদ সদস্য বলা যাবে না। ২৫ জানুয়ারির আগে তাঁরা কেউ কার্যভার গ্রহণ করতে পারবেন না। এটা নির্দিষ্টভাবে বলা আছে। তাই এই বিধান অমান্য করা যাবে না। তাই প্রধানমন্ত্রীকে দশম সংসদের নেতা হতে হলে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।
এটা পরিহাস যে, সামরিক শাসকদের দ্বারা ডকট্রিন অব নেসেসিটি দিয়ে এ দেশ চলেছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বলে দিলেন, এই মতবাদটা কেবল সামরিক শাসকের নয়, এটা বেসামরিক শাসকেরাও ব্যবহার করতে পারেন।
আমরা আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে লিখেছি, ‘আমরা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ’। দশম সংসদ নির্বাচনের সদস্যরা চক্ষুলজ্জা ঝেড়ে বড় গলায় কি ওইভাবে বলতে পারবেন যে, আমরা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ?
দশম সংসদের নির্বাচিতদের ম্যান্ডেট কী? তাঁরা পাঁচ বছর কোন নৈতিকতা ও কর্তৃত্বে দেশ চালাবেন? আমরা জানি না। জেনারেল ইয়াহিয়াও কার্যত বলেছিলেন, একসঙ্গে দুটি দিতে পারব না। একটি নিতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানি নাগরিকদের একটি বড় অংশ নিশ্চয় মুজিবকে ঠকিয়ে নিজেদের বড় বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী ভেবেছিল। তারা আসলে গণতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে ‘স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব’কে অর্জন ভেবেছিল। তারা ভাবতেও পারেনি গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এটা পৃথক করা যায় না। পানি দুই ভাগ করা যায় না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কোনো খণ্ডন, রদ, স্থগিত কিংবা সাহাম (ন্যায্য অংশ) চলে না।
ক্ষমতাসীনেরা বলছেন, দশম সংসদ নিয়ে আর সংলাপ চলে না। একাদশ সংসদ নিয়ে সংলাপ হতে পারে। শাসকগোষ্ঠী এক মুখে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার’ কথা বলছে। অন্য মুখে আবার আগাম বা মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলছে। কতক্ষণ বলছে, এখন আর সংসদ ভেঙে ৯০ দিন সময়ের সুযোগ গ্রহণ করা যায় না। কারণ, সংবিধান তা সমর্থন করে না। তাই এখন আর সমঝোতার জন্য কান্নাকাটি বৃথা। সমঝোতা নয়, সংবিধান বড়।
সম্প্রতি কারাবরণকারী বিএনপির একজন নেতা আমাকে বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে ভারতীয়দের কথা হয়েছে। তিনি ১৯৯৬-এর মডেলে সমাধানের আভাস দিয়েছেন। এরপর খালেদা জিয়াকেও সেই আভাস দিতে শুনলাম। তিনি নিয়মরক্ষার নির্বাচন হিসেবে মেনে নেওয়ার স্পষ্ট আভাস দিয়েছেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পাঁচ কোটির বেশি ভোটারের এই অধিকার অগ্রাহ্য করে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনকেই বড় করে তুলেছেন।
পিপলস ইউনিয়ন ফর লিবার্টিস মামলায় ভারতীয় বিচারপতি ধর্মাধিকারী বলেছেন, ‘কোনো নির্বাচনে একজন নাগরিকের অংশগ্রহণ এবং তার পছন্দের প্রার্থীকে বাছাই করা এমন একটি অধিকার, যা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে দেওয়া তার ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে ভিন্ন।’ অথচ ৫ জানুয়ারি সংবিধান চুলোয় দিয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ নিয়ে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়ছেন।
কুলদীপ নায়ারের মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন, ‘বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সংসদ সদস্যদের কেবল প্রত্যক্ষ ভোটেই বেছে নেওয়া হয়।’ অন্তত স্বীকার করুন দেশটা গণতান্ত্রিক নয়। তার পরে নির্বাচন করুন।
ভারতের প্রধান বিচারপতি পি সত্যশীবম, বিচারপতি রঞ্জন প্রকাশ দেশাই, বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ গত ২৭ সেপ্টেম্বর অভিমত দেন যে, ‘গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এটা অপরিহার্য যে দেশের যথাযথ শাসনের জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য ভালো লোককেই জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে।’
বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের আনা অভিযোগের বিরোধিতা না করেও এটা মানতে হবে যে ক্ষমতাসীন দল ও ইসি ভালো লোককে বাছাই করার রক্ষাকবচ দিতে পারেনি। তাই সংবিধানের গান গাওয়া আর গণতন্ত্রকে বাঁচানো এক নয়।
সংসদের বৈধতার প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি দূরদর্শী উক্তি করেছিলেন। সংবিধান সংশোধন কমিটির সভায় শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি বলেছিলেন, ‘আমি দুটি সংসদ অবৈধ ঘোষণার সুপারিশ করি। কারণ, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ৫ শতাংশ লোকও ভোট দেয়নি। এ দুটি বাতিল করলে ওই সংসদের করা সব সংশোধনী অটোমেটিক্যালি বাতিল হবে।’ অর্থাৎ, এটা মানলে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হতো। আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে যা করা হলো, তার তুলনায় এটা ছিল উত্তম সুপারিশ। তিনি এটা কেবল সভাতেই বলেননি, ২০১০ সালের ৮ আগস্ট চিঠি লিখেও কমিটিকে জানিয়েছিলেন।
এটা অগ্রাহ্য করা হয়েছে, কারণ শাসকের শঠতাপূর্ণ আঁতাত দুই নেত্রী টলাতে চান না। তাই মুহিত-ফর্মুলা উপেক্ষিত হয়েছিল। সে কারণেই বিএনপির নেত্রী অত সহজে দশম সংসদকে ‘নিয়মরক্ষার’ নির্বাচন হিসেবে মেনে নেওয়ার উপায় বাতলাতে পারেন। তাই তারা ক্ষমতায় গেলে দশম সংসদকে অবৈধ ঘোষণা করবে না। কিন্তু গণতন্ত্রের শিকড় গভীরে নিতে হলে সত্যিকারের নির্বাচিত সংসদকেই কোনো না কোনো দিন উপযুক্ত পরিবেশে এটা করতে হবে। আমরা ১৯৮৮ ও ১৯৯৬-এর সংসদকে অবশ্যই অবৈধ মনে করি। ৫ জানুয়ারির সংসদও বৈধতা পাবে না।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
[email protected]