সভাপতি পাগল, সাধারণ সম্পাদক খুনি!

আ জ ম নাছির উদ্দীন ও  মহিউদ্দিন চৌধুরী
আ জ ম নাছির উদ্দীন ও মহিউদ্দিন চৌধুরী

এর প্রতিক্রিয়ায় মেয়র নাছির সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এসবই পাগলের প্রলাপ। তিনি মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। দলের মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষুব্ধ, এখন আর সেই অন্তর্জ্বালা চেপে রাখতে না পেরে এসব কথা বলছেন।’

স্পষ্টতই নগর আওয়ামী লীগ এখন তিন ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষে আছেন মহিউদ্দিনের সমর্থকেরা। যে ব্যানারেই হোক না কেন, সেদিনের জনসভার আয়োজক, সমর্থক ও দর্শকেরা আওয়ামী লীগের এই নেতার অনুসারী, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আ জ ম নাছির উদ্দীনের সমর্থকেরা নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে মিছিল-সমাবেশ করে বর্তমান মেয়রের প্রতি তাঁদের সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। তৃতীয় ধারাটি নীরব দর্শকের মতো দুই নেতার এই বাগ্‌যুদ্ধ দেখছেন, এই অঞ্চলে দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশায় ভুগছেন। দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের একটি বড় অংশ এই ধারায় আছেন। নগরের অনেক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী মহিউদ্দিন চৌধুরীর জনসভায় অংশ নেননি, নাছিরের সমর্থনে মিছিল-সমাবেশেও যোগ দেননি।

দলের যখন এই অবস্থা তখন কেন্দ্রীয় কমিটি মুখে কুলুপ এঁটেছে। বস্তুত চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দল ও সংঘাত-সংঘর্ষের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। এর সর্বশেষ পর্যায় মহিউদ্দিন ও নাছিরের দ্বন্দ্ব।

নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের সময় ও তারপরের বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে মহিউদ্দিন চৌধুরী দলের ওপর একচ্ছত্র প্রভাব সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য সোচ্চার হয়ে তিনি এমনকি দলের বাইরেও চট্টগ্রামবাসীর সমর্থন আদায় করে নিয়েছিলেন। তিনি পরপর তিনবার মেয়র পদে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। তার মধ্যে দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এমন সময়ে যখন আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দল।

নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি যে বারবার নির্বাচিত হয়েছেন তার পেছনে ছিল এ অঞ্চলের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং চট্টগ্রামের উন্নয়নে তাঁর ভূমিকার স্বীকৃতি। মেয়র থাকাকালে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সেবা ও চিকিৎসা খাতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাফল্য ছিল বিস্ময়কর।

তবে তৃতীয় দফা মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে মহিউদ্দিন চৌধুরীর আচরণ অনেকটা স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল বলে মনে করেন সচেতন মানুষ। এ সময় কেউ তাঁর যেকোনো বক্তব্য বা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দ্বিমত করলেই তিনি ক্ষিপ্ত হতেন। তিনি ক্রমেই চাটুকারবেষ্টিত হয়ে পড়ছিলেন।

তিনি একসময় সিটি করপোরেশনের ব্যয়ভার বহন তথা নগরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য যথেষ্ট সরকারি বরাদ্দ না পেয়ে বিভিন্ন আয়বর্ধক প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। একপর্যায়ে সেবামূলক কর্মকাণ্ডের চেয়ে ব্যবসাই যেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ২০১০ সালে মেয়র নির্বাচনে মহিউদ্দিন তাঁরই এককালের শিষ্য মনজুর আলমের কাছে পরাজিত হন। তখন থেকেই দলে তাঁর প্রভাব কিছুটা হলেও খর্ব হতে থাকে।

এদিকে নগর কমিটিতে আ জ ম নাছির উল্লেখযোগ্য কোনো পদ না পেলেও (অনেক সময় কমিটির সদস্য পদেও ছিলেন না) দলের ছাত্রসংগঠনে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ছিল প্রচুর। ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রিত বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁর প্রভাব ছিল। ২০১৩ সালে নগর আওয়ামী লীগের নগর কমিটিতে সাধারণ সম্পাদকের পদ লাভ এবং তার পরপরই ২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দলের মনোনয়ন পাওয়া ছিল নাছিরের বিস্ময়কর উত্থান।

মহিউদ্দিন চৌধুরী এ দুটি ঘটনা আপাতদৃষ্টে মেনে নিলেও ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। বিশেষ করে মহিউদ্দিনের প্রতিষ্ঠা করা প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নাছিরের তৎপরতা এবং বিলবোর্ড উচ্ছেদের ফলে মহিউদ্দিনের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ অনুসারীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনায় তিনি বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁদের বিরোধের প্রভাব পড়েছে ছাত্রলীগের ওপর। ছাত্রলীগ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েকবার ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে।

গত বছর ডিসেম্বর মাসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই বিরোধ নিরসনের একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে নগর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে তাঁর দুই পাশে বসিয়ে দলের অন্তঃকোন্দল মিটিয়ে নেওয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর পরামর্শ দুই নেতাই হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন, এমন একটি ধারণা পেয়েছিল নগরবাসী। কিন্তু তাঁদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে সে ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়নি।

দলে নাছিরের উত্থান যেমন বিস্ময়কর ছিল, তেমনি দলের হাইকমান্ডের কাছে এত দ্রুত তাঁর গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাওয়াও বিস্ময়কর। ঢাকার দুই মেয়রকে মন্ত্রী এবং এমনকি রংপুরের মেয়রকেও প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হলেও চট্টগ্রামের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরের মেয়রকে এ ধরনের কোনো মর্যাদা দেওয়া হয়নি। তদুপরি মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে ব্যারিস্টার মহীবুল হাসান চৌধুরীর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক পদে স্থান পাওয়া হাইকমান্ডের একধরনের ‘বার্তা’ হতে পারে। নাছিরের দ্রুত উত্থান ও প্রায় একচ্ছত্র হয়ে ওঠার ব্যাপারটিতে ঝিমিয়ে পড়া মহিউদ্দিনের সমর্থকেরা এই নতুন ‘বার্তা’য় আবার চাঙা হলেন।

এই পালে হাওয়া দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম সফর। তিনি কদিন আগে পানি শোধনাগার উদ্বোধনের জন্য চট্টগ্রামে এসে বিমানবন্দরের পথে একটি অসমাপ্ত সেতু ও রাস্তার পাশে খুঁড়ে রাখা গর্ত দেখে খুবই বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন।  তিনি বর্তমান মেয়র নাছির ও সিটি করপোরেশনের গাফিলতির ইঙ্গিত করেছেন এবং প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছেন, মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালে চট্টগ্রামের অনেক উন্নয়ন হয়েছিল। এতে মনে হাওয়া স্বাভাবিক প্রধানমন্ত্রী সাবেক মেয়রের সঙ্গে বর্তমান মেয়রের একটি তুলনা টেনে মহিউদ্দিনকে অধিকতর যোগ্য বিবেচনা করেছেন।

এতে মহিউদ্দিন ও তাঁর সমর্থকেরা নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছেন। মহিউদ্দিন যেসব বিষয় নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন, এবার প্রকাশ্যে সেই সব বিষয় নিয়ে সরব হলেন। তিনি নগরবাসীর গৃহকর বাড়ানোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। নাছির এর উত্তরে বলেছেন, গৃহকর নির্ধারণের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের, সিটি করপোরেশনের কাজ কর আদায় নিশ্চিত করা। কর আদায় না করে নগরের উন্নয়ন করা সম্ভব নয় বলেও যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি। আমাদের ধারণা, এর মাঝামাঝি একটা উপায় আছে। তিনি তাঁর পূর্বসূরি মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ অন্যদের পরামর্শ নিলে বিষয়টি এত দূর গড়াত না। তৃণমূলের রাজনীতিতে অনেক বেশি অভিজ্ঞ মহিউদ্দিন গৃহকর বৃদ্ধির বিরোধিতাকে বর্তমান মেয়রের বিরুদ্ধে সহজেই ব্যবহার করতে পারবেন।

বন্দর নিয়েও বিরোধ আছে। একসময় বন্দরের শ্রমিক রাজনীতি ছিল মহিউদ্দিনের একক নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু সেখানে এখন সাংসদ এম এ লতিফ ও সামশুল হক চৌধুরীর সহযোগিতায় নাছির একটি প্রভাববলয় তৈরি করেছেন। ব্যবসায়ী ও বন্দর ব্যবহারকারীরা মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে তিনি বন্দরকে জিম্মি করে, বারবার বন্দর অচল করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ব্যবসায়ীদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। আবার নাছির, লতিফ ও সামশুল হকরা বন্দরে নানা রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে বাড়তি সুবিধা লাভ করছেন বলে মহিউদ্দিন ও তাঁর সমর্থকদের অভিযোগ। অর্থাৎ এই বিরোধে স্বার্থের দ্বন্দ্বও আছে।

নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সম্পর্ক যে এখন স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ তা বলা বাহুল্য। চট্টগ্রামে রাজনীতির প্রতিপক্ষহীন মাঠে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা নিজেরাই হয়ে উঠেছেন নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী। নেতাদের এই বিরোধ যদি মাঠপর্যায়ের কর্মীদের সংঘাত-সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেয়, বিশেষ করে দলের ছাত্রসংগঠন যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে নেমে পড়ে, তবে বিপন্ন হবে নাগরিক জীবন। সেই অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় নেতাদের কি এ ব্যাপারে কিছুই করার নেই?

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।