সৃজনশীলতা দিয়ে মোকাবিলা করুন

চরম অনিশ্চয়তা আর শঙ্কার মধ্য দিয়ে শুরু হলো আরেকটি নতুন বছর। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির লাগাতার নমুনা প্রদর্শনের আরেক কিস্তির প্রদর্শনও শুরু হয়েছে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচির মাধ্যমে। নিয়ত যেখানে হানাহানি, নৃশংসতা আর প্রাণসংহারের মহড়া, সেখানে জীবন কীভাবে টিকে থাকে? অবশ্য মানুষের জীবন ঘিরে এমন প্রশ্ন যেমন আছে, আছে তার উত্তরও। জীবন কখনো থেমে থাকে না। শেষ বিচারে জীবন অপ্রতিরোধ্য। হতাশার মাঝে মানুষ তাই আশাও খুঁজে পায়। এমন আশাপ্রদ দুটি খবর ছেপেছে ২৭ ডিসেম্বরের প্রথম আলো। গাইবান্ধা আর নীলফামারীর মাঠপর্যায়ের সরকার-সমর্থক ও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একত্র হওয়ার খবর হলো রোগ প্রতিরোধমূলক। কিন্তু আলোচ্য সংবাদ দুটির শিকড় আরও গভীরে। এ হলো সত্যিকারের রোগ প্রতিষেধক খবর।
প্রথম আলোর বিশাল বাংলা পাতায় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম হলো ‘পুনর্ভবা নদীর তীরে নবান্ন উৎসব’। অপর খবরটি ছাপা হয়েছে একই দিনের ফিচার পাতা অন্য আলোতে। এটির শিরোনাম ছিল ‘বটপাতায় বিয়ের দাওয়াত’। প্রথম খবরটির সঙ্গে বিপুলসংখ্যক দর্শকের উপস্থিতিতে শিশু ও কিশোরীদের নেচেগেয়ে মেতে ওঠার একটি দৃষ্টিনন্দন ছবিও ছাপা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিজস্ব প্রতিবেদক পরিবেশিত এ খবরটির দিকে প্রথমে খুব আগ্রহভরে তাকাতে ইচ্ছা হয়নি। তাকাতে ইচ্ছা হয়নি এ কারণে যে, লক্ষ করা যাচ্ছে এক-দেড় দশক ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের প্রায় সব স্থানে এমন ধাঁচের যেসব অনুষ্ঠান হয়, তার পেছনে থাকছে মন বিষিয়ে ওঠার মতো আরেকটি খবর। পিছে আকর্ষণীয় ওই প্রতিবেদনটির মধ্যে ‘অমুক দাতা সংস্থা বা অমুক প্রসাধনপণ্যের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত এ উৎসবে’ এমন বাক্য পড়তে হয়, এ ভয়ে সেদিকে তাকাতে সাহস হয়নি। দ্বিধান্বিত মনে খবরটি পড়ার পরে অবশ্য এ ভুল ভেঙে যায়। স্বল্পমাত্রার হলেও একধরনের আশার সঞ্চার হয় মনে।
গোমস্তাপুর উপজেলার বাবুরঘোন গ্রামে এমন নবান্ন উৎসবের আয়োজন চলছে তিন বছর ধরে। কারও পৃষ্ঠপোষকতায় নয়, এ অনুষ্ঠানের ব্যয়নির্বাহ হচ্ছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিন কেজি করে নতুন ধান আর সামান্য নগদ অর্থ তুলে। আরও উল্লেখযোগ্য হলো, অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়েছেন গ্রামের নারী ও শিশুরা। এঁদের মধ্যে আবার অগ্রগণ্য হলেন দুজন নারী শিক্ষক মমতাজ ও শামীমা, সম্পর্কে যাঁরা দুই বোন।
বাবুরঘোন গ্রামে নবান্ন উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ছিল রাজশাহী অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মেয়েলি গীত। গীত আর নৃত্যের সঙ্গে নানা লোকাচারও ছিল। না, গ্রামের শিশু-নারীরা কেবল ঐতিহ্যের অনুসন্ধানে অতীতমুখী থাকেনি, তারা অতীতের সঙ্গে আজকের প্রয়োজনের মেলবন্ধনও ঘটিয়েছে। এ জন্য উৎসবসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে দেশের গান, মুক্তিযুদ্ধের গান ও আবৃত্তি। আমাদের আজকের জীবন যে শিকড়হীন নয়, এই জীবনের নতুন গতি ও ছন্দকে যে ধার করা সংস্কৃতির পরিবর্তে আমাদের হাজার বছরের সুর-তাল-লয়েই নতুনভাবে প্রকাশ করা জরুরি, সেই বার্তাটি তারা দিয়েছে নবান্ন উৎসবে।
খেয়াল করলে দেখা যাবে, তিনটি প্রধান নেতিবাচক উপাদান আমাদের সমাজজীবনকে ক্রমেই গ্রাস করে চলেছে। উপাদান তিনটি হলো নির্ভরশীলতা, সৃজনহীনতা আর বিচ্ছিন্নতা। অথচ জীবন এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রধান তিন মৌলিক উপাদান ঠিক এর উল্টো। মানুষ হবে আত্মনির্ভর, সৃজনশীল এবং ঐক্যবদ্ধ। তবেই তো মানুষ টিকে থাকবে, যা কিছু জীবনের বিরুদ্ধে, তার সঙ্গে লড়াই করতে পারবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা আজ নির্ভরশীল, সমস্যা মোকাবিলায় ভীষণ রকম সৃজনহীন। অন্যদিকে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে আমরা ভীষণভাবে একা—বিচ্ছিন্ন। আমাদের কিশোর-তরুণদের আমরা ক্রমেই কেবল কোচিং সেন্টার আর পাঠ্যবইনির্ভর করে ফেলছি। আমাদের যে কৃষি একদিন ছিল সবচেয়ে উদ্ভাবনী শক্তির আধার, সেই কৃষি ও কৃষক আজ ভীষণভাবে নির্ভরশীল। বীজ, সার, সেচ, লাঙল সবই একসময় ছিল কৃষকের নিজের আওতায়। আজ উৎপাদন বেড়েছে বটে, কিন্তু কৃষি-উপকরণের জন্য কৃষক হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। এদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভাবনার যথেষ্ট সম্ভাবনা দেশে থাকলেও বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির কল্যাণে এসব নিয়ে আমাদের শিক্ষক-বৃদ্ধিজীবীদের আজ কমই ভাবতে হয় (আজকের বিশ্বে ভাবনার বিনিময় অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু আমরা তো অন্যের ভাবনা গ্রহণের মানসিকতায় নিজেদের ভাবনা বিনিময়ের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছি)।
স্ব-উদ্যোগে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজনও এখন কমই চোখে পড়ে। কোনো অনুষ্ঠানের জন্য একশ্রেণীর মানুষের পৃষ্ঠপোষক খুঁজে বেড়ানোও যেন আজ পেশায় পরিণত হয়েছে। অনুষ্ঠান, জনসভা বা মিছিলে অংশ নেওয়ার জন্যও এখন নগদ অর্থ বা খাবার প্যাকেটের ওপর অনেক মানুষ নির্ভরশীল। ভোটের বাজারেও এ প্রবণতা ক্রমাগত বাড়ছে। মানুষের চরম লাঞ্ছনা বা বিপদকে নিয়েও পৃষ্ঠপোষক খোঁজার নজির কম নয়। এ প্রসঙ্গে এক লজ্জাকর ঘটনার কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। বছর পাঁচেক আগে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পল্লিতে এক আদিবাসী নারী ধর্ষিত হন। এলাকার একজন সমাজসেবককে ফোন করে জানতে চাই তাঁরা এ ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদী উদ্যোগ নিয়েছেন কি না। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে অপ্রত্যাশিত যে বাক্যটি শুনতে হয় তা হলো, ‘ধর্ষণের ঘটনাটি নিয়ে ইতিমধ্যেই ওপরে একটি প্রকল্প জমা দিয়েছি, অর্থ এলেই কাজ শুরু করে দেব।’
সমাজ থেকেই তো রাজনৈতিক নেতারা উঠে আসেন। কাজেই আমাদের রাজনীতিতে এ নির্ভরশীলতার আসর লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। নিজেদের সমস্যা মোকাবিলায় তাই বিদেশিদের ওপর নির্ভরতার ঘটনা প্রতিনিয়ত আমাদের সহ্য করতে হচ্ছে।
চারদিকের এ ধসের মধ্যে বাবুরঘোন গ্রামের নারী-শিশুরা আমাদের মনে নতুন আশা জাগায় বইকি। তাঁদের ওই নবান্ন উৎসবের আয়োজনের মধ্যে আমরা আত্মনির্ভরতা, সৃজনশীলতা আর ঐক্যের সুসমন্বয় লক্ষ করি। হয়তো গোমস্তাপুরের প্রত্যন্ত গ্রামটির সরল মানুষের মনে ভোগ-লোভ-মোসাহেবির নাগরিক সংস্কৃতি স্পর্শ করেনি বলেই এমনটা সম্ভব হয়েছে।
প্রথম আলোর শুক্রবারের ফিচার পাতা অন্য আলোতে প্রকাশিত ‘বটপাতায় বিয়ের দাওয়াত’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির উৎসও গ্রাম। রাজশাহীর প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ লিখেছেন, চারঘাট উপজেলার বনকিশোর গ্রামের জাহেদা বেগম তাঁর ছোট ছেলের বিয়েতে বটপাতায় আঁকা জাতীয় পতাকাকে নিমন্ত্রণপত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বিজয় দিবসে আয়োজিত এ বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রটির রূপকার চারুকলার ছাত্র আরাফাত রুবেল। গাছের পাতাকে আমন্ত্রণপত্র হিসেবে ব্যবহারের রেওয়াজ নতুন নয়। বিশেষ করে বাংলা নববর্ষে এ ধরনের প্রচেষ্টা মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আরাফাত রুবেলের কৃতিত্ব এই যে তিনি এই সৃজনশীল কাজটিকে সময়ের প্রয়োজনের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছেন। অন্যদিকে জাহেদা বেগমও বিয়ের মতো একটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক ঘটনাকে ওই নিমন্ত্রণপত্রের মাধ্যমে জাতীয় ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করে সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন বৃহত্তর কোনো স্বার্থে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের ভূমিকা কী হওয়া উচিত।
নির্ভরশীল ব্যক্তি কখনো সৃজনশীল হতে পারে না। আবার সমাজ-মানুষ-দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কেউ সৃজনশীল ও আত্মনির্ভর হয়েছেন এমন নজির নেই। কাজেই সামাজিক দায় থেকে দূরে সরিয়ে রেখে আমরা আমাদের সন্তানদের কখনোই সৃজনশীল ও আত্মনির্ভর করে গড়ে তুলতে পারব না। সৃজনশীলতা, আত্মনির্ভরতা ও ঐক্যবদ্ধতা এ তিন উপাদানের কোনোটিকেই বিচ্ছিন্নভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। তবে এ তিন উপাদানই শেষ কথা নয়। এর সঙ্গে সত্য, ন্যায়, মঙ্গল আর সুন্দরও যুক্ত। আবার এগুলোও একে অন্যের পরিপূরক। যা সত্য নয়, তা সুন্দরও নয়। অন্যদিকে সত্য ও সুন্দর ছাড়া ন্যায় ও মঙ্গল প্রতিষ্ঠা পায় না। ককটেল বা পেট্রলবোমা বানানোকে আপাতদৃষ্টিতে সৃজনশীল মনে হলেও তা সত্য, ন্যায়, মঙ্গল ও সুন্দরের শর্ত পূরণ করে না। কাজেই এ ধরনের অভিনবত্ব সৃজনশীলতার পর্যায়ে পড়ে না। আসলে সৃজনশীলতা হলো মানুষের কল্যাণে অতীত অভিজ্ঞতাকে বর্তমানে রূপান্তর ঘটানোর ক্ষমতা। স্নিগ্ধ চাঁদকে সুকান্ত ভট্টাচার্য যখন ঝলসানো রুটিতে রূপান্তর করেন, তখন তা সময়ের দাবি মেটায় বলেই সৃজনশীল কাজ হয়ে ওঠে।
বাবুরঘোন আর বনকিশোর গ্রামের নারী-শিশু-তরুণেরা মেয়েলি গীত, ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব বা বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রকে সময়ের চাহিদার সঙ্গে যুক্ত করে প্রকৃত সৃজনশীল কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমাদের অতীত ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতার ভান্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তাই পরনির্ভরতা নয়, আমরা আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার রূপান্তর ঘটিয়েই হয়ে উঠতে পারি সৃজনশীল, মোকাবিলা করতে পারি আজকের সংকটকে। সব অশুভর বিরুদ্ধে লড়াই করার এটাই স্থায়ী পথ। এ ক্ষেত্রে বাবুরঘোন আর বনকিশোর গ্রামের সেসব সৃজনশীল মানুষ আমাদের কাছে হয়ে উঠতে পারেন অনুকরণীয়।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও নাট্যকার।