কেন এই নির্বাচন?

প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই আজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দশম জাতীয় সংসদের ১৪৭টি আসনের নির্বাচন। ১৫৩টি আসনে ভোট গ্রহণের আদৌ প্রয়োজন হবে না। কারণ, ওই আসনগুলোর প্রতিটিতে প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা মাত্র এক। বলা হচ্ছে, তাঁরা ইতিমধ্যে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে গেছেন। আজ যে আসনগুলোতে ভোট গ্রহণের কথা, সেগুলোতে একাধিক প্রার্থী থাকলেও নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হচ্ছে না।
যে বাংলাদেশে নির্বাচনকে ঘিরে দেশজুড়ে উৎসবের পরিবেশ বিরাজ করে, সেখানে আজ কোথাও কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনা নেই। বরং সহিংসতার কারণে দেশজুড়ে এক ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার হবে অত্যন্ত কম। কিন্তু তা যদি না-ও হয়, তবু এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে না। কারণ, মোট নয় কোটি ২০ লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় পাঁচ কোটিই এ নির্বাচনের বাইরে থাকছেন; কেননা তাঁদের আসনগুলোতে কোনো ভোটই হচ্ছে না। আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘাটতি হলো, এ নির্বাচনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পর্যবেক্ষক পাঠাচ্ছে না। এ নির্বাচনকে পশ্চিমা বিশ্ব যে ‘ভালো’ নির্বাচনের সনদ দেবে না, সে খবরও ইতিমধ্যে জানা।
একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকার জন্য সরকারের প্রতি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের আহ্বান সরকারের কাছে গুরুত্ব পায়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচনে বিরোধী দলকে অংশ নেওয়াতে তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। কিন্তু বিরোধী দল অংশ না নিলে সরকার কী করতে পারে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথাও বারবার বলা হয়েছে। কিন্তু একটি মৌলিক বিষয় সরকার বিবেচনায় নেয়নি: নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি বিরোধী দলের অনাস্থা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দলীয়/সর্বদলীয় সরকারের অধীনে, সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনা বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে—এমন আস্থা বিরোধী দলের মনে সৃষ্টি করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার ক্ষেত্রে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আইনগত বিবেচনায় যথেষ্ট হলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় যথেষ্ট ছিল না। সংসদে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব যত কমই হোক না কেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সম্মতির প্রয়োজন অবশ্যই ছিল। কারণ, ভবিষ্যতের নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে সেই নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা সর্বাধিক গুরুত্ববহ। কিন্তু বিএনপিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে জনমত সংগঠনে মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যগতভাবে একটি নির্বাচনমুখী দল। অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থার জন্য দলটি চিরকাল আন্দোলন-সংগ্রাম করে এসেছে। জাতীয় পার্টির ১৯৮৮ সালের ও বিএনপির ১৯৯৬ সালের একতরফা নির্বাচনের মতো কেলেঙ্কারি আওয়ামী লীগের ইতিহাসে নেই। কিন্তু আজকের নির্বাচনের পর আর সে কথা বলা যাবে না।
তার চেয়েও বড় কথা, এ নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে না, দেশে-বিদেশে কারও কাছেই এটি গ্রহণযোগ্য হবে না। তাহলে কেন ও কার জন্য এই নির্বাচন?