আওয়ামী লীগ হারিয়া প্রমাণ করিল

চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর এখন আওয়ামী লীগ এই বলে বুঝ দিচ্ছে যে এটা তাদের জন্য শাপে বর হয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবিত ও মৃত’ ছোটগল্পে কাদম্বিনী ‘মরিয়া প্রমাণ’ করেছিল যে সে মরে নাই। আর এ যুগের আওয়ামী লীগ ‘হারিয়া প্রমাণ করিল যে তাহারা’ হারে নাই, বরং দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব বলে তারা যে দাবি করছে, সেটিই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয়েছে, তা নিয়ে কেউ আপত্তি করবে না। কিন্তু এই চার কুমিরের ছানা দেখিয়ে কি বিএনপির মন গলানো যাবে? ওদের কি দলীয় সরকারের অধীনে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে রাজি করানো যাবে? এসব প্রশ্নের সদুত্তর ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনের যত গালভরা গল্পই সরকার শোনাক না কেন, জট খুলবে না।

প্রধানমন্ত্রী সংসদে খুব সুন্দরভাবে বলেছেন, ‘নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনেই হবে, জনগণ চাইলে ক্ষমতায় থাকব, না চাইলে থাকব না। জনগণের ভোট চুরি করে ক্ষমতায় থাকাকে ঘৃণা করি।’ কথা ভালো, কিন্তু মানে কে?

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর এসব কথায় বিরূপ মন্তব্য করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ‘স্বৈরাচারী’ ভাষা দেখতে পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। চার সিটি নির্বাচনে জেতার পর এ ধরনের ‘স্বৈরাচারী’ ভাষা হয়তো তাঁরা আরও ঘন ঘন দেখতে থাকবেন। কারণ, এখন তাঁদের ভোটের জোর বেড়েছে। তাই তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার অথবা অন্তত নির্দলীয় সরকারপ্রধান ছাড়া আর কিছুতে তাঁদের মন গলবে না। মনে হয় আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে কঠিন অবস্থায় পড়তে হবে। এই বৈতরণি পার হতে হলে নৌকার পালে নতুন হাওয়া লাগাতে হবে। বিরোধী দলকে একটি কার্যকর সমঝোতায় আনতে না পারলে হয়তো সরকারি দলের হালে পানি পাওয়া সহজ হবে না।

সিটি করপোরেশন নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন একই মাপকাঠিতে বিচার করা যায় না। চারটি সিটি করপোরেশনের পরীক্ষায় নির্বাচন কমিশন উতরে গেছে। কিন্তু ৩০০ আসনের নির্বাচনে একই পরিবেশ নিশ্চিত হবে কি না, তা পরীক্ষিত হয়নি এখনো। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ‘জনগণ না চাইলে থাকব না’ বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা বিরোধী দলকে আশ্বস্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়। বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথা বলেছে। কিছু কর্মসূচিও নিতে শুরু করেছে।

এখানেই ভয়। তারা কোন আন্দোলনের কথা বলছে? এর আগে তো দেখা গেছে, তাদের আন্দোলন মানে আগুন আর বোমা। হরতালে রেললাইন তুলে ফেলার ভয়ংকর সংস্কৃতি এখন তারা চালু করেছে। আন্দোলন করছে সরকারের বিরুদ্ধে, আর মারছে নিরীহ রেলযাত্রী, বাসযাত্রী। এ ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে বিএনপি কিছু বলে না। তারা গণতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু সহিংসতার নিন্দা জানায় না। এখন আন্দোলনের নামে যদি আবার মানুষ মারা শুরু হয়, আর সরকারের পুলিশ যদি ঢালাও গ্রেপ্তার শুরু করে, নির্যাতন চালায়, তাহলে নির্বাচন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। এতে বিএনপির বরং ক্ষতিই হবে। কারণ, জনরায় ও ভোটের শক্তি সহিংসতায় নষ্ট হতে পারে। এই রায় চার সিটি করপোরেশনের সীমানা পার করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কৌশলী না হলে বৃহত্তর বিজয় অর্জন করা কঠিন।

তাই প্রচলিত ধর-মার-কাট ধরনের আন্দোলনের চিন্তা বিএনপিকে বাদ দিতে হবে। আন্দোলনের নামে এখন সহিংসতার পথে তাদের না যাওয়াই ভালো। সরকারি দলের লোকেরা বিএনপির মিছিলে ঢুকে বোমাবাজি করছে বলে দাবি করলে কয়জনের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে? তাই বিএনপির খাতা পরিষ্কার রাখা দরকার। মানুষ সুস্থ রাজনীতি চায়। সহিংসতা করে দলের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সনাতন ধারার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার কঠিন পরীক্ষা এখন বিএনপির সামনে।

বিএনপি এখন সংসদ অধিবেশনে যাচ্ছে। স্পিকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা আর অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার করবে না বলে জানিয়েছে। এটা এক ধাপ অগ্রগতি, যদিও সোমবারই সংসদে কথা-কাটাকাটি আপত্তিকর পর্যায়ে উঠেছিল। তা-ও ভালো, সীমার মধ্যেই আছে। এত দিন ওরা সংসদেই যেত না। গেলেও কঠোর ভাষায় সরকারি দলকে বকাবকি করে অধিবেশন বর্জন করত। সরকারি দলের সাংসদেরাও একই কাজ করতেন। বিরোধী দল সংসদে গেলে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় একটা ধরাবাঁধা বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। সেখানে ধীরস্থিরভাবে কোনো বিষয় আলোচনা বা আইন প্রণয়নের সুযোগ প্রায়ই থাকত না। এখন যদি স্পিকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দুই পক্ষ বাকসংযম করে, তাহলে বাইরের উত্তাপও কমে আসবে।

আর একটি উৎসাহিত হওয়ার মতো ঘটনা হলো নির্বাচনের পরের পরিস্থিতি। পরাজিত হলেও আওয়ামী লীগ ‘মানি না’ বলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েনি, বরং সিলেটে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান প্রথম দিনই ঘোষণা দিয়ে পরাজয় মেনে নিয়েছেন। বিএনপির বিজয়ী প্রার্থীও প্রতিপক্ষ প্রার্থীর বাসায় গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠার এই সংস্কৃতি আমাদের রাজনীতিতে আগেও ছিল। আবার ফিরে আসছে।

সমস্যা হলো, আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ফিরে যেতে রাজি নয়। আর বিএনপি কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে রাজি নয়। এই গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন। এই অবস্থায় ঢাকায় সিটি নির্বাচন করে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন আভাস দিয়েছিল যে রমজান মাসের পর এ দুটি নির্বাচন হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠানে মন্ত্রণালয়ের বাধা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তার একটা অগ্নিপরীক্ষার মুখে এখন নির্বাচন কমিশন।

আন্তরিকতা থাকে তো অবিলম্বে ঢাকা মহানগরের দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ঝুঁকি নিক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করুক নির্বাচন কমিশন। সরকার যদি বাগড়া না দেয়, তাহলে একটা পরীক্ষায় পাস করবে ক্ষমতাসীন দল। এর পর আসল পরীক্ষা হলো ঢাকায় শান্তিপূর্ণভাবে সিটি নির্বাচন করতে পারা বা করতে দেওয়া।

এখানে প্রশ্ন ওঠে, আওয়ামী লীগ কেন এখন আবার পরীক্ষার ঝুঁকি নেবে? একবার চারটা সিটি নির্বাচনে হেরে না-হয় কিছু একটা প্রমাণ করল, বারবার হারতে থাকলে পরাজয়ের পুঞ্জীভূত গ্লানি নিয়ে কি জাতীয় নির্বাচনে দাঁড়ানো যাবে?

এটা সমস্যা বটে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন যে কতটা স্বাধীন, তা প্রমাণের জন্যও তো এখন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দেওয়া জরুরি। চার সিটি নির্বাচনের পর এটা আরও জরুরি হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ তো নিজেরাই বলছে, হার-জিত বড় বিষয় নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনই তাদের লক্ষ্য। যদি তা-ই হয়, তাহলে অবিলম্বে ঢাকা সিটি নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।

ঢাকার নির্বাচনের ফলাফল অন্য রকমও হতে পারে। পরীক্ষা হওয়া দরকার। ঢাকায় দুটি বড় বড় ফ্লাইওভার হয়েছে, আরও কয়েকটি সম্পন্ন হওয়ার পথে। অন্যদিকে ঢাকায় বিএনপিসহ ১৮-দলীয় জোটের রাজনৈতিক অবিমৃশ্যকারিতা মানুষ দেখেছে। বিএনপি-সমর্থিত হেফাজতের অবস্থান কর্মসূচিতে কীভাবে দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, সড়ক বিভাজকের গাছগুলো নির্বিচারে উপড়ে ফেলা হয়েছে, গাড়িতে আগুন দিয়ে চালককে হত্যা করা হয়েছে, পুলিশের ওপর নির্বিচার আক্রমণ চালানো হয়েছে, এ সবই তো সবাই দেখেছে। ভীতিকর অবস্থা থেকে দেশকে রক্ষা করাও তো সরকারের এক বড় কৃতিত্ব।

তাহলে সমস্যা কোথায়? আর যদি ঢাকায়ও আওয়ামী লীগের পরাজয় হয়, তাতে কী আসে-যায়? তখন বিএনপিকে নির্বাচনে আনা তো সহজ হবে। দেশে যদি সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, এর চেয়ে বড় জয় আর কী হতে পারে।

আওয়ামী লীগ বড় বিজয় চায়, নাকি নির্বাচনের প্রশ্নে একঘরে হয়ে পড়ার ঝুঁকি নিতে চায়? দেশ কোন পথে যাবে, তা এখন অনেকাংশে নির্ভর করে সরকারি দলের ওপর।

আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।