যে নির্বাচনে দুই পক্ষই হেরেছে

চিকিৎসার কারণে সপ্তাহ তিনেক কিছু না লিখলেও গত ১১ ডিসেম্বরের একটি সেমিনারের কথা কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। সেমিনারটিতে গণহত্যাবিষয়ক কয়েকজন বিশেষজ্ঞের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছিল, তাঁদের পুরো গবেষণার মূলে বোধ হয় ছিল বাংলাদেশ নামক দেশটির জন্ম-ইতিহাস এবং তার পরবর্তীকালের রাজনীতি।
‘সমসাময়িক কালে গণহত্যার উৎস এবং প্রভাব’ সম্পর্কে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইমেরিটাস প্রফেসর মার্টিন শর বক্তব্যে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন সময়ে গণহত্যার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তনের কথা উঠে আসে। তাঁর মতে, গণতন্ত্রায়ণের কারণে বর্তমান বিশ্বে জনগণ শাসকদের কাছে অধিকতর জবাবদিহি আশা করে এবং সে কারণে প্রায়ই নির্বাচন সমাজে উত্তেজনা ছড়ানোর মূল উৎসে পরিণত হয়। প্রফেসর শ বলেন, প্রায়ই নির্বাচনের ফল চুরি বা কেড়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। তিনি এ ক্ষেত্রে ২০০৮ সালে কেনিয়ায় অনুষ্ঠিত নির্বাচন ও নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতির উদাহরণ দেন।
প্রফেসর শ আরও বলেন, রাজনৈতিক ও সামরিক সংকটই হচ্ছে গণহত্যার উৎস এবং প্রায়ই নির্বাচন থেকে এসব সংকটের সূত্রপাত ঘটে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস তো সেই সাক্ষ্যই দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ইতিহাস তো নির্বাচিত সরকারগুলোর ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া ও সংখ্যাগরিষ্ঠের কণ্ঠরোধের ইতিহাস। সত্তরের নির্বাচনের রায়কে নস্যাৎ করার সামরিক-বেসামরিক চক্রান্ত এবং বাঙালিদের জাতিগত নির্মূল অভিযান বা গণহত্যার মর্মান্তিক ইতিহাসেই তো বাংলাদেশের অভ্যুদয়। অথচ সেই নির্বাচনের একটি গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা বাংলাদেশে ৪২ বছরেও গড়ে তোলা গেল না। সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশে এখন আতঙ্কের ছায়া।

২.
২০১৪-এর শুরুতে বাংলাদেশে যে জেদ ও জবরদস্তির নির্বাচন হলো তাতে রাজনৈতিক অস্থিরতা যে নতুন মাত্রা লাভ করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
দেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যতম আওয়ামী লীগ একটি নির্বাচনের রায়কে যেভাবে নিজেদের পক্ষে নিল, সেটাই হতে যাচ্ছে তাদের সবচেয়ে বড় পরাজয়। ’৯৬-এর ভোটারবিহীন নির্বাচনের জন্য নিন্দিত বিএনপির সমপর্যায়ে আওয়ামী লীগকে নামিয়ে নিয়ে আসাকে পরাজয় ছাড়া অন্য কিছু কি বলা চলে? একই সঙ্গে এই জবরদস্তির নির্বাচন বিরোধীদের আন্দোলনকে কি নৈতিক বিজয় নিশ্চিত করে দেয়নি? পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় থেকে আওয়ামী লীগ বলে আসছিল, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম। অথচ তারা দৃষ্টান্ত তৈরি করছে নতুন ধরনের একটি বশংবদ নির্বাচন কমিশনের। কমিশনটি যে নতুন ধরনের, তার কারণ, এই প্রথম একটি বাছাই-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটি গঠিত হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতা ও নির্বাচনকালীন কর্তৃত্বের দিক দিয়ে তা এখন বহুল নিন্দিত আজিজ কমিশনের সমগোত্রীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনেও আচরণবিধি কার্যকর করতে অক্ষম ছিল এই কমিশন। বিরোধী দলের কর্মসূচি নস্যাতে সরকারি অবরোধ বাস্তবায়নে নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকায় নির্বাচন কমিশনের তো দর্শকের আসনে থাকার কথা নয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে একযোগে আওয়ামী লীগের লাঠিধারী কর্মীদের টহলদারিতে কি নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন ছিল? প্রেসক্লাবে হামলার সাফাই গাইতে যখন সেখানে জঙ্গিদের সভা অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়, তখন সে কথাগুলো পুলিশ কমিশনারের বলে বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখ থেকে এমন কথা শুনে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু নির্বাচনকালীন প্রশাসনের সময়ে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য একজন পুলিশ কর্মকর্তার এ ধরনের রাজনৈতিক বুলিতে যে নিরপেক্ষতার প্রতিফলন দেখা যায়, তাতে চমৎকৃত হওয়া ছাড়া আর কীই-বা করার থাকে।
বিরোধীদের যেকোনোভাবে হারাতে হবে—এই রাজনৈতিক কৌশলই বিরোধী দলের মূল দাবির যৌক্তিকতাকে কি আবারও সামনে তুলে আনেনি? গত পাঁচ বছরে কয়েক হাজার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের কৃতিত্বের দাবিদার সরকার প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনেও প্রশাসনকে ব্যবহারের নতুন নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। রাজনৈতিক সরকার যে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে অক্ষম, সে কথা প্রতিষ্ঠার জন্য কথিত নির্বাচনকালীন মন্ত্রীরা যে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়েছেন, সে জন্য বিএনপির উচিত তাঁদের ধন্যবাদ জানানো। আওয়ামী লীগের মরহুম নেতা আব্দুল জলিল নবম সংসদেরই এক অধিবেশনে সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা শাখা এবং সামরিক কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার আইন করে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাম নামধারী বর্তমান মন্ত্রীদেরও কেউ কেউ তাঁর সেই আহ্বানে সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে জাতীয় পার্টির প্রধানকে কবজায় নিতে সেনা হাসপাতালকে ব্যবহারের নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপনে তাঁদের বিকার নেই। বিরোধী দলের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে ‘তেঁতুল হুজুরের’ কাছে সামরিক কর্মকর্তাকে পাঠানোর কথা নাহয় বাদই দিলাম।

৩.
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হানাহানির ইতিহাস নতুন না হলেও এবার সহিংসতার মাত্রা যে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে, তার তাৎপর্য বিএনপি কতটা উপলব্ধি করতে পারছে বোঝা মুশকিল। বিএনপির অধিকাংশ নেতা-কর্মী হয় কারাগারে, নয়তো আত্মগোপনে—এই যুক্তি কিছুটা সত্য হলেও আন্দোলনের সহিংসতার দায় তাঁরা কীভাবে অস্বীকার করবেন? বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট মানেই তাতে সহিংসতায় অভ্যস্ত উগ্রপন্থী ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া, এমন ধারণা চালু হলে তাঁরা দেশে সমর্থন হারাবেন এবং বিদেশে বন্ধুহীন হবেন—এই বিশ্বাস সরকারি মহলে প্রবল। আর নির্মম সত্য হলো এই যে আন্দোলনকালীন সহিংসতায় আওয়ামী লীগের সেই কৌশল কিছুটা হলেও সাফল্য পেয়েছে। তবে বিএনপির থেকে যাঁরা মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন, তাঁরা যে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন দেবেন, তেমনটা মনে করার কারণ দেখি না।
রাজনীতির এই সংঘাত ক্রমেই নিষ্ঠুরতর হচ্ছে। ঘৃণা ও বিদ্বেষ জন্ম দিচ্ছে আরও ঘৃণা এবং আরও বিদ্বেষের। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবার, গোষ্ঠী কিংবা সম্প্রদায়কেন্দ্রিক সহিংসতার যেসব রোমহর্ষক ও মর্মস্পর্শী বিবরণ পত্রিকার পাতায় উঠে আসছে, সেগুলোকে অশনিসংকেত হিসেবে বিবেচনা করে সতর্ক না হলে আরও বড় ধরনের অঘটন ঠেকানো যাবে না।
আবারও লন্ডনের গণহত্যাবিষয়ক সেমিনারের কথাগুলো মনে পড়ছে। গণহত্যাবিষয়ক একজন উপদেষ্টা হিসেবে জাতিসংঘে কাজ করেন ড. নাইজেল এল্ট্রিংহাম। তিনি ‘গণহত্যা এবং গণনিষ্ঠুরতার (ম্যাস অ্যাট্রোসিটিজ) প্রক্রিয়া’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ওই সেমিনারে বলেন, অভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষা সত্ত্বেও কোনো একটি গোষ্ঠী সংগঠিতভাবে অপর গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গুলোকে লক্ষ্য করে অপপ্রচার চালিয়ে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর কৌশল অনুসরণ করে থাকে। তিনি আরও বলেন, জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ তৈরির চেষ্টা যেকোনোভাবে কোনো না কোনো বিষয়ে পার্থক্য নিরূপণ করে তাকে বড় করে দেখানোর উদ্যোগ বা কোনো গোষ্ঠীকে অপবাদ দেওয়ার এই প্রয়াস থেকেই সম্ভাব্য গণহত্যার ক্ষেত্র তৈরি হতে থাকে। ড. এল্ট্রিংহাম এ ক্ষেত্রে রুয়ান্ডার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন, রুয়ান্ডার গণহত্যার বিচার করতে গিয়ে বিচারকেরাই এই বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করেছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই আলামতগুলোই কি এখন প্রকট হয়ে উঠছে না? প্রতিপক্ষের সমালোচনায় যেসব ভাষা ব্যবহূত হচ্ছে, তা যে শুধু অশালীন বা কুৎসিত তা-ই নয়, বরং ঘৃণা উদ্রেককারী ও উসকানিমূলক।
এ ক্ষেত্রে অবশ্য আশার কথা এই যে মানবিক প্রয়োজন এবং মানবাধিকার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সজাগ ও উদ্যোগী। গত ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সদস্যদেশগুলোয় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যা ঠেকানোর লক্ষ্যে একটি নতুন নীতিকৌশল ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘের উপমহাসচিব ইয়ান এলিয়াসেন এই নীতিকৌশল ঘোষণার সময় বলেন, গণহত্যা বা পাইকারি হারে নিষ্ঠুর হামলা (ম্যাস অ্যাট্রোসিটিজ) ঠেকানোই হলো তাঁদের লক্ষ্য। শ্রীলঙ্কার গণহত্যার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সম্ভাব্য সংকটের আলামতগুলো চিহ্নিত করে আগাম হস্তক্ষেপই হলো এই কৌশলের মূল বিষয়। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের অগ্রাধিকার হচ্ছে বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া।
আশা করি, আমাদের রাজনীতিকেরা রাজনৈতিক সংকটকে এমন পরিস্থিতিতে নিয়ে যাবেন না, যেখানে বাইরের কারও হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়। বিদেশে শান্তি রক্ষায় সামরিক সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের শরণাপন্ন হওয়া মানে এই নয় যে জাতিসংঘ আমাদের রাজনৈতিক সংকটের কথা বিস্মৃত হয়েছে। বিদেশিদের এই নির্বাচন থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত এ ক্ষেত্রে বরং আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কোনো পর্যবেক্ষক না পাঠানোর অর্থই হচ্ছে নির্বাচন পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক সংকটের আরও গভীর পর্যবেক্ষণ।

কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।