মজুরের দেশে মজুরের মরা-বাঁচা

আট ঘণ্টা কাজের অধিকার এখন বিশ্বে এমনভাবে স্বীকৃত যে তাকে স্বতঃসিদ্ধ বলেই মনে হয়। কিন্তু এই অধিকার মানুষ এমনি এমনি পায়নি। তার জন্য অসংখ্য মানুষের শ্রম-ঘাম-মেধা কাজ করেছে, অনেক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। এত বছর পরও আট ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরির অধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে বাংলাদেশ অনেক দূরে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে নেহাত টিকে
থাকতেও শুধু আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলেই হয় না, শিশুসহ পরিবারের একাধিক সদস্যকে কাজে যোগ দিতে হয়। এ ছাড়া মজুরিবিহীন শ্রমের অস্তিত্ব আছে, আছে নারীর অস্বীকৃত শ্রম। আইএলও কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করলেও সেই কনভেনশনে স্বীকৃত শ্রমিকদের বহু অর্থনৈতিক ও আইনগত অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

সংখ্যার বিপুল গরিষ্ঠতা বিবেচনা করলে অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশও শ্রমিক বা মজুরের দেশ। শ্রমিক বলতে প্রথমে শিল্পশ্রমিকের ধারণা মাথায় এলেও শ্রমজীবী মানুষের বিস্তৃতি আরও অনেক বেশি। শ্রমিক বা মজুর বলতে সেই মানুষকেই বোঝায়, যিনি তাঁর শারীরিক মেহনত বা শ্রমশক্তি বিক্রি করে জীবন ধারণ করেন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তো বটেই, বিশ্বের সব অঞ্চলেই পুঁজির ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার কাছে শ্রমশক্তি বিক্রির মানুষ, অর্থাৎ মজুরেরও বিস্তার ঘটে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বহুদূর। সে জন্য শুধু শিল্প খাতের মধ্যেই শ্রমিক পরিচয় সীমাবদ্ধ রাখলে পুঁজির আধিপত্য ও ক্রিয়ার প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। প্রযুক্তি বিকাশের মধ্য দিয়ে শ্রমশক্তি বিক্রেতাদের মধ্যে বহু ধরন তৈরি হয়েছে। এই বিবেচনায় শ্রমশক্তি ও মেধাশক্তি পুঁজির কাছে বিক্রি করে উদ্বৃত্ত মূল্য সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছেন, এ রকম নারী-পুরুষের সংখ্যাই সমাজে শতকরা ৯৯ ভাগ। ‘আমরা ৯৯ শতাংশ’ স্লোগান দিয়ে বিশ্বজুড়ে এই পরিচয়ই নতুনভাবে নির্মিত হচ্ছে।

সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে এখনো কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। জাতীয় আয়ে কৃষির অনুপাত অনেক কমে এলেও দুই কোটির বেশি নারী-পুরুষ কৃষির সঙ্গেই যুক্ত। গার্মেন্টসসহ ছোট-বড় সব কারখানার হিসাব ধরলে শিল্পশ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭২ লাখ। অর্থনীতির গতির ধরনের কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সম্প্রসারণ বাড়ছে আর বাড়ছে তাতে যুক্ত মানুষের সংখ্যা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকানে কর্মরত শ্রমিকদের সংখ্যা এখন প্রায় ৮৫ লাখ। রিকশা–ভ্যানসহ পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিক। নির্মাণশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। নতুন প্রযুক্তির খাত যেমন মোবাইল, আইটিসহ বাণিজ্যিক শিক্ষা, চিকিৎসা সব ক্ষেত্রেই বিভিন্ন স্তরের মজুরের সংখ্যা বেশি, তবে তাঁদের পরিচয় অনেক ক্ষেত্রেই ঢাকা দেওয়া। প্রায় সব ক্ষেত্রেই পুঁজির বিপরীতে মানুষেরা অসংগঠিত, অস্থায়ী অস্বচ্ছ কর্মশর্তে নিয়োজিত।

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের ছোট-বড় কারখানায় যত শ্রমিক নিয়োজিত, তার চেয়ে বেশিসংখ্যক বাংলাদেশি এখন শ্রমিক হিসেবে বিদেশে কর্মরত। তাঁদের কাজের ক্ষেত্রও অনিশ্চিত, নির্যাতন, প্রতারণায় ভরা। বাংলাদেশে বেশ বড় বৈদেশিক মুদ্রার মজুত তৈরি হয়েছে এখন। এর পেছনে মূল অবদান যে গার্মেন্টস শ্রমিক ও বিদেশে কর্মরত সোয়া কোটি শ্রমিক নারী-পুরুষের, তাঁদের জীবনই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। রানা প্লাজা থেকে শুরু করে বিদেশ থেকে আসা লাশের সারি, আর অসংখ্য পরিবারের আহাজারি এই সত্যটিই স্পষ্ট করে।

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের শিল্প খাতের অনেক রকম পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ধারাবাহিকতা যেমন আছে, তেমনি গুণগত কিছু পরিবর্তনও দেখা যায়। যেসব ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে আছে: ১. বাঁচার মতো মজুরির তুলনায় প্রকৃত মজুরি অনেক কম; ২. ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারবিহীন সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক, শতকরা ৫ ভাগের কম; ৩. মোট উৎপাদনমূল্যে অনুপাত অনেক কম হলেও ÿক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকদের অবস্থান; ৪. তালিকাবিহীন বহুসংখ্যক কারখানায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শ্রমিকের অবস্থান।

পাশাপাশি শিল্পশ্রমিকদের মধ্যে যেসবÿ ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন দেখা যায় সেগুলো হলো: ১. শিল্পশ্রমিকদের লিঙ্গীয় গঠনে পরিবর্তন। আশির দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত শ্রমিকদের মধ্যে নারী শ্রমিকদের অনুপাত ছিল অনুল্লেখ্য।ÿ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ছাড়া নারী শ্রমিকদের দেখা যেত না। কিন্তু এখন মোট শিল্পশ্রমিকের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ নারী। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ছাড়াও গার্মেন্টসসহ রপ্তানিমুখী কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকদের অনুপাত শতকরা ৮০ ভাগ। ২. শ্রমিকদের প্রধান ক্ষেত্র রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থানান্তরিত হয়েছে। ৩. আগে শিল্প খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য থাকার কারণে শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল এসব প্রতিষ্ঠান। আদমজী পাটকলসহ সেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা ব্যক্তিমালিকানাধীনে হস্তান্তরিত হওয়ার পর শ্রমিক সংগঠন ও আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বড় রকমের ছেদ পড়েছে। ৪. ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থায়ী কাজের অনুপাত খুব কম। বহু প্রতিষ্ঠানে স্থায়ীভাবে কোনো নিয়োগই দেওয়া হয় না। বহু প্রতিষ্ঠানেই নিয়োগ দেওয়া হয় চুক্তিভিত্তিক বা দৈনিকভিত্তিক। জাতীয়ভাবে ন্যূনতম মজুরি নির্দিষ্ট না থাকায় এসব কারখানায় মজুরি স্তর অনেক নিচে, স্থায়ী নিয়োগ না হওয়ার ফলে মজুরি নিয়ে দর-কষাকষি বা আইনি লড়াইয়ের সুযোগ নেই। ৫. রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন প্রধানত সরকার ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠীই ব্যবহার করেছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই অধিকার আরও সংকুচিত হয়েছে।

পুরোনো রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের আন্দোলন সংগঠনের দেশব্যাপী ব্যাপক শক্তি সমাবেশের সর্বশেষ ঘটনা ঘটে ১৯৮৪ সালের মে মাসে। এরপর শ্রমিক আন্দোলন মালিকশ্রেণির রাজনীতির অধস্তন হয়ে যাওয়ার কারণে আন্দোলন, সংগঠন ও যৌথ মঞ্চ—সবই ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। তা ছাড়া চট্টগ্রাম, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীর অনেকগুলো বড় কারখানা এর মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের আন্দোলনের পুরোনো কেন্দ্রগুলোও অকার্যকর হয়ে পড়ে। এসব কারণে পরবর্তী সময়ে পুরোনো সংগঠন ও শিল্পশ্রমিকদের নিয়ে বড় কোনো আন্দোলন দেখা যায়নি। শ্রমিক আন্দোলনের দৃষ্টিগ্রাহ্য বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় এর প্রায় ২০ বছর পর, সম্পূর্ণ নতুন এক ক্ষেত্রে, গার্মেন্টস শ্রমিকদের মধ্যে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের এই আন্দোলনের সঙ্গে আশির দশক পর্যন্ত পরিচালিত শ্রমিক আন্দোলন সংগঠনের পার্থক্য গুরুত্বপূর্ণ।

শিল্পশ্রমিকদের মধ্যে বর্তমানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মসংস্থানের  ক্ষেত্র এই গার্মেন্টস। গত ১০ বছরে শিল্পশ্রমিক আন্দোলনের প্রধান বা প্রায় একমাত্র তৎপরতা এই খাতেই দেখা যায়। এই আন্দোলন বেশির ভাগ সময় কোনো নির্দিষ্ট কারখানা বা অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হলেও ২০০৬ ও ২০১০ সালে ঢাকা মহানগরীসহ কয়েকটি অঞ্চল অচল করে ফেলার মাত্রায় উঠেছিল। এখনো বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে প্রায়ই শ্রমিকদের বিক্ষুব্ধ অবস্থান দেখা যায়। দাবিগুলো অবশ্য এখনো খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের, যার মধ্যে আছে নিয়োগপত্র, সাপ্তাহিক ছুটি, নিয়মিত মজুরি ও বকেয়া পরিশোধ, অতিরিক্ত সময়ের মজুরি প্রদান, কাজের নিশ্চয়তা ইত্যাদি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকাংশ নারী হওয়ার কারণে যৌন নিপীড়নসহ নারীসম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ও ক্রমেই সামনে আসছে।

সাংগঠনিকভাবে খুবই দুর্বল হলেও মজুরিসহ বঞ্চনা ও নিপীড়নের মাত্রার কারণে ক্ষোভ, প্রতিবাদও প্রায়ই ফেটে পড়ে। সে জন্য গত এক দশকে শ্রমিক আন্দোলনের একটি নতুন চেহারা আমরা দেখতে পেয়েছি। এই আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত, অনেক বিস্তৃত। তবে সাংগঠনিক শক্তি ও যথাযথ দিকনির্দেশনার অভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পর্যুদস্ত। অর্থনীতির গতিমুখের কারণে বর্তমানে সব খাতের শ্রমিকদের মধ্যে অস্থায়ী, দিনভিত্তিক, খণ্ডকালীন, ইনফরমাল অনুপাতই এখন বেশি। সুতরাং তাঁদের আন্দোলনে সংগঠনের ধারণাও নতুনভাবে বিন্যস্ত করার তাগিদ প্রবল।

আন্দোলনের কারণেই গার্মেন্টস খাতে ন্যূনতম মজুরি এখন ৫ হাজার ৩০০ টাকা। অথচ দারিদ্র্যসীমার আয় যথাযথভাবে হিসাব করলে দাঁড়ায় পরিবারপ্রতি মাসিক ১৮ হাজার টাকা। তার মানে একজন তো নয়ই, দুজন কাজ করলেও মজুরি দারিদ্র্যসীমা পৌঁছাতে পারে না। বহু কারখানায় এই মজুরিও দেওয়া হয় না। শুধু মজুরি বঞ্চনা বা নিপীড়নের প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতা দিয়েই শ্রমিকের জীবন শেষ নয়। স্পেকট্রাম, তাজরীন, স্মার্ট, রানা প্লাজা বা সর্বশেষ টাম্পাকোর মতো বর্বর হত্যাকাণ্ডের শিকারও তাঁদের হতে হয়।

হাওরে ভেসে, জমি দখল আর অধিগ্রহণে, বন আর নদী বিনাশে যারা সর্বস্বান্ত হয়, তারা ভিড় জমায় শহরে, কাজের খোঁজে। মজুরির বিনিময়ে কাজের সন্ধান সফল হয় কমজনের। যারা সফল হয়, তাদেরও জীবন অনিশ্চিত যাত্রা থেকে মুক্তি পায় না। তাজরীন বা রানা বা টাম্পাকোর মতো একেকটি ঘটনা প্রকাশ করে রাষ্ট্রের স্বরূপ, ক্ষমতার সম্পর্ক, পুঁজির পুঞ্জীভবনের নির্মম প্রক্রিয়া। মালিকদের সংগঠন আছে, সেখানে তৈরি হয়েছে দলনির্বিশেষে শক্তিশালী শ্রেণি ঐক্য। বিজিএমইএ ভবনটিই তাদের সম্মিলিত অনিয়ম, ক্ষমতা ও দুর্নীতির দিকে বারবার আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মালিকদের আছে সংগঠন, সরকার, থানা-পুলিশ র‍্যাব। পাশাপাশি শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ কোনো সাংগঠনিক শক্তি নেই, রাজনৈতিক দিশা অস্পষ্ট। মাঝেমধ্যে অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ কেবল শ্রমিকশ্রেণির অন্তর্নিহিত শক্তির জানান দেয়। তা হয়তো সন্ত্রস্ত করে ‘ভদ্রলোক’দের, কিন্তু সাহস জোগায় পাবলিক বা সর্বজনকে।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ  অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়