যা হলো তা মুখ রক্ষার নির্বাচন

অনেক বিরোধিতা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেল। নির্বাচনের পরদিন এটাই বলার আছে যে অপারেশন সাকসেসফুল, বাট পেশেন্ট ইজ ডেড। নির্বাচনের নামে গণতন্ত্রের দেহে যে অস্ত্রোপচার হলো, তা আইনত ঠিক থাকলেও গণতন্ত্র নামক রোগীর জীবন আরও বিপন্নই হলো। বিএনপির বর্জনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় খালি মাঠে গোল দেওয়ার সুবাদে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছে। ১৫৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ছিল না। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে এ নির্বাচন করা হলো। এর মাধ্যমে আসলেই কি সংবিধান সমুন্নত থাকবে? এই নির্বাচন কি আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্ত করবে, নাকি আরও সংকটে ফেলে দেবে?
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কারণে, অবশ্যই আমাদের সংসদ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ৯০ দিন সময়সীমার মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এমন নির্বাচনের উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত করা। সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র’। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনের সূচনা হয়। তবে যেনতেনভাবে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে গণতন্ত্র কায়েম হয় না। এটি হতে হবে মানসম্মত ও সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য। আর মানসম্পন্ন নির্বাচন মানেই, সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের ভাষায় ‘প্রত্যক্ষ’, অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক তথা ‘জেনুইন’ বা সঠিক নির্বাচন। অর্থাৎ আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার হলো সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা।
আমরা নিজেরাও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইন অনুযায়ী সত্যিকার নির্বাচন করতে বাধ্য। উদাহরণস্বরূপ, ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের নামের যে চুক্তি বাংলাদেশ ২০০০ সালে স্বাক্ষর করেছিল, তাতে প্রত্যেক নাগরিকের ‘ভোট প্রদানের ও নির্ধারিত সময়ের পর সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার’ অধিকার প্রদানে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ (ধারা ২৫)। একইভাবে সর্বজনীন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের ২১ ধারা অনুযায়ীও আমরা সত্যিকার নির্বাচন করতে বাধ্য। আর ভোটারদের সম্পৃক্ততা ও প্রধান দলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালিত হলেই সেই নির্বাচনকে সঠিক বলা যাবে। এবং সেই নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করবে।
আমাদের সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সাংসদদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আর এ নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তথা মানসম্মত। আর মানসম্মত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে ‘রিজার্ভয়্যার অব পাওয়ার’ অর্থাৎ অগাধ ক্ষমতা দিয়েছে। (সূত্র: আফজাল হোসেন বনাম প্রধান নির্বাচন কমিশনার, ডিএলআর ৪৫)। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ১১৯ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমনকি আইনি বিধানের সঙ্গে সংযোজন করার—যে ক্ষমতা সাধারণত নির্বাচিত সংসদের জন্য নির্ধারিত—‘ইনহেরেন্ট’ বা অন্তর্নিহিত ক্ষমতা কমিশনের রয়েছে (আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেম, ৪৫ ডিএলআর)। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠানই নয়, বরং সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।
দুর্ভাগ্যবশত, ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৫২ শতাংশ ভোটার নির্বাচনের দিনের আগেই তাঁদের ভোট প্রয়োগের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ১৫৩ প্রার্থী জনগণের ভোট ছাড়াই ‘জনপ্রতিনিধি’ নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ১৪৭টি আসনে মাত্র ৩৯০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এমনকি ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও প্রার্থী সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি ছিল। এবারকার নির্বাচনে আমাদের ৪১টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে মাত্র ১২টি দল অংশ নিয়েছে।
সার্বিকভাবে বলতে গেলে আমাদের সাংবিধানিক মূল চেতনা তো কেবল নির্বাচন করা নয়, একটা মানসম্মত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং এই নির্বাচনে যা মোটেই অর্জিত হয়েছে বলে বলা যায় না। তাই, আমাদের নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এই নির্বাচনকে সংবিধান রক্ষার নির্বাচন না বলে, মুখরক্ষার নির্বাচন বলাই শ্রেয়। আমাদের আশঙ্কা, যে সহিংসতা শুরু হয়েছে বা অব্যাহত আছে, তা ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে।
সহিংসতা বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ হলো, জামায়াত-শিবিরের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ফলে জামায়াত-শিবির সংক্ষুব্ধ। তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে চায় এবং যারা ইতিমধ্যে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছে, তাদের মুক্ত করতে চায়। তাই তারা সংগত কারণেই সহিংসতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। তবে আমরা মনে করি যে যেহেতু যুদ্ধাপরাধের বিচার একটি জাতীয় অগ্রাধিকার, বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হলে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, তারা সুবিধা করতে পারবে না।
এটা সুস্পষ্ট যে অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দশম সংসদের অবস্থান হবে অত্যন্ত দুর্বল। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সামনে দুটি পথ খোলা থাকবে। একটি হলো, বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া এবং সমঝোতার ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে একাদশ সংসদের জন্য নির্বাচন করা। অন্য বিকল্প হলো, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো; যার জন্য প্রয়োজন হবে বল প্রয়োগের।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।