জামায়াত: আর হাইকোর্ট দেখাবেন না

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির নেত্রী  খালেদা জিয়া
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুশোচনা করলেন না, বরং তাঁর প্রকাশভঙ্গিতে আত্মতৃপ্তিই ফুটল। তিনি অন্তত বলতে পারতেন, জনগণ যতটুকু দিয়েছে, ততটুকুতে তিনি সন্তুষ্ট বটে। কিন্তু এতে তাঁর আত্মতৃপ্তির অবকাশ কম। বিজয় আছে, বিজয়ের গৌরব নেই। এই নির্বাচন তিনি চাননি। এমন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তিও তিনি চান না। এটা নিতান্তই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, সত্যিকারের একটি প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন দিয়ে তিনি প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রে উত্তরণ চান। সংবিধানের বাইরের লোকেরাও জনগণের মন ভরাতে এটা বলেন। অবশ্য নির্বাচিতের তকমা থাকায় সেটা তাঁকে বলতে হলো না।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন ও জামায়াতের আইনগত অস্তিত্বের ফয়সালা টপ এজেন্ডায় আসুক। আমি তো শাহবাগের মঞ্চকে এই প্রশ্নে এখনই আলটিমেটাম দিতে বলব। এই ইস্যু স্থায়ীভাবে সুরাহার একটি রোডম্যাপ সরকারকে অবিলম্বে ঘোষণা করতে হবে।
জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার শর্ত বিএনপিকে দেওয়ার আগে সরকারি দলকে ওই শর্ত পূরণ করতে হবে। জামায়াত নিষিদ্ধ করা হবে কি না? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘হাইকোর্ট একে জঙ্গিবাদী সংগঠন হিসেবে রায় দিয়েছেন। তাদের নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে একটি রিট আছে। এটা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমরা এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে পারি না।’ এই বক্তব্য পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। হাইকোর্টে রিট থাকলে সে বিষয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে বারিত করে না। সংসদকে তো নয়ই। প্রধানমন্ত্রীর দাবি, রোববার তিনি জামায়াতবিরোধী ম্যান্ডেট পেয়েছেন। এর মানে জনগণ তাঁকে সংসদে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছে। তাহলে এখন তাদের ‘হাইকোর্ট’ দেখাচ্ছেন কেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে জাতির ওপর চাপানো হয়েছে এবং আবেগের বশে হলেও বিরাট জনগোষ্ঠী তা মেনে নিয়েছে এবং হয়তো নেবে এই কারণে যে তারা আশা করবে, এর মধ্য দিয়ে তারা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে একটা চূড়ান্ত ফয়সালা পাবে। শেখ হাসিনার ওই মনোভাবে তাই আমরা গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা অনুভাব করি। দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টির আশঙ্কায় তাই এর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ গড়ে তোলার আহ্বান জানাই। এই অবস্থান যদি মানতে হবে, তাহলে খালেদা জিয়াকে তিনি কোন নৈতিকতায় জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের শর্ত দিলেন?
প্রকৃত সত্য হলো, হাইকোর্টের কোনো রায়ে জামায়াতকে ‘জঙ্গি সংগঠন’ বলা হয়নি। ট্রাইব্যুনাল তাকে যুদ্ধাপরাধী বা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। গোলাম আযমের ৯০ বছরের কারাদণ্ড হয়। গত আগস্টে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলকালে জামায়াত নিষিদ্ধের পক্ষে যুক্তি দেয় রাষ্ট্রপক্ষ। এর সুরাহা হয়নি। এ ছাড়া হাইকোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ এক বিভক্ত রায়ে জামায়াতকে দেওয়া ইসির আগেকার সাময়িক নিবন্ধনের বৈধতা নিষ্পত্তি করেছে। ২:১ রায়ে হাইকোর্ট সাময়িক নিবন্ধন বাতিল করেছেন। কিন্তু এটি আপিল বিভাগে যে অবস্থায় আছে, তাতে জামায়াত যদি নির্বাচনে অংশ নিত, তাহলে হাইকোর্টের ওই রায় দেখিয়ে জামায়াতকে নির্বাচনে অযোগ্য করা কঠিন হতো। এর আগে জামায়াত প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কোনো দলকে নিষিদ্ধ করতে তাঁর পরিকল্পনা নেই। মনে হচ্ছে, তিনি তাঁর অবস্থান অপরিবর্তিত রেখেছেন। এবং জামায়াত প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারে।
শহীদ পরিবারের আবেগ-অনুভূতি এবং এমন একটি একতরফা নির্বাচনের পরে বলব, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা জামায়াত প্রশ্নে সব ধরনের সিদ্ধান্তহীনতা, অস্পষ্টতা ও কৌশলগত বুজরুকির অবসান ঘটান। কত তারিখের মধ্যে যুদ্ধাপরাধের বিচার শেষ হবে, তার সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করুন। আগামী নির্বাচনের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াত ইস্যু বিযুক্ত করুন। সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে বিচার বিভাগকে স্বাধীনতা দেওয়ার মতো শাসনগত সংস্কার যুক্ত করুন।
সে কারণে বিভক্ত নাগরিক সমাজকে আগে শাসনগত সংস্কার প্রশ্নে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। যদি তারা এখন কেবল একতরফা নির্বাচন নিয়েই সরকারি দলের সমালোচনায় মুখর থাকে, অন্ধ হয়, তাহলে তাতে বিএনপি-জামায়াতের পোয়াবারো। আবার যদি নাগরিক সমাজের কোনো অংশ কেবল বিরোধী দলের নিন্দায় সোচ্চার হয়, শুধুই ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ দেখে, তাহলে তাতে ক্ষমতাসীনদের স্বৈরশাসক হওয়ার প্রবণতা তীব্র হবে। এখন তাই ন্যূনতম ঐক্য হতে হবে প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ গঠন করা। বিদেশি কূটনীতিকদের বুলি, ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের সঙ্গে ‘অংশগ্রহণমূলক শাসন’ কথাটিও যুক্ত করতে হবে। শাসন প্রসঙ্গ নির্বাসনে পাঠিয়ে কেবল ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ বিএনপি ও ১৮ দলের নর্তনকুর্দনই নিশ্চিত করবে। তাই স্লোগান পাল্টাতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার দেওয়া গতকালের দুটি লিখিত বিবৃতি আমি খুঁটিয়ে পড়লাম। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আগামী নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা করেই সমাধান করা যাবে।’ খালেদা জিয়া সর্বাত্মক বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে কেবল ‘নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছার’ আহ্বান জানান। এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গিই অগ্রহণযোগ্য। উভয়ের মনোভাব পাল্টে নির্বাচন ও সুশাসনের নতুন প্যাকেজ দেখতে চাই। যিনি এটা আগে করবেন, তিনিই বেশি লাভবান হবেন।
বিএনপির নেত্রী অবশ্য এর আগে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণের কথা বলেছেন। তাঁকে এটা বিস্তারিত, নির্দিষ্ট এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত করে শেখ হাসিনার সামনে সাজিয়ে পরিবেশন করতে হবে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন একটি দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়। এটা সবার ব্যর্থতা, এটা অন্তরে ধারণ করে ওই নির্বাচনের গ্লানি মুছে ফেলতে সবাইকে সক্রিয় হতে হবে। এর মন্ত্র হবে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে উভয় পক্ষের মধ্যে শাসন ও সংস্কার প্রশ্নে কতগুলো মৌলিক প্রশ্নে একমত হওয়া। অন্তত চেষ্টা শুরু করা।
ঢাকা সফররত অধ্যাপক জিল্লুর রহমান খান গতকাল চ্যানেল আইয়ে বললেন, লাতিন আমেরিকায় এমন সময় গেছে, যখন বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার মতো হানাহানি চলেছে। তখন তারা কেবল নির্বাচন নিয়েই পড়ে থাকেনি। নির্বাচনের পরে কীভাবে সরকার চলবে, সে প্রশ্নের তারা সুরাহা করেছে। দুই প্রধান পক্ষের মধ্যে এক পক্ষ প্রেসিডেন্ট হয়েছে তো বিরোধী দল ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছে। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী তানসু সিলার দক্ষিণপন্থী প্রতিপক্ষের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেছেন। নির্বাচন ও শাসনের সমন্বয় ঘটানো জরুরি। শেখ হাসিনার সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাবের সম্প্রসারণ বা ঢেলে সাজানো অবাস্তব, কিন্তু অলীক কল্পনা নয়। এ জন্য অনুকূল পরিবেশ লাগবে। তারেক রহমান যেভাবে যুক্তিহীনভাবে বাহাত্তরের সংবিধানকে ‘গণ-আকাঙ্ক্ষার বিরোধী’ বলছেন, তা নিন্দনীয়। দুই পক্ষের নাগরিক সমাজের মিত্রদের কাছাকাছি আনতে এ ধরনের উক্তি পরিহার করতে হবে।
গতকাল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব আইরিন খানের সঙ্গে কথা হলো। কেনিয়া কী করে ব্যাপকভিত্তিক শাসনগত সংস্কারের পথে গেল, তার চমৎকার বিবরণ দেন। সেখানকার দুই প্রধান বিবদমান দলের কাজিয়াও আমাদের দুটির মতোই উপজাতীয় ঘরানার। তারাও তাদের গোত্রতান্ত্রিক শাসন দিয়ে উচ্চ আদালতসহ সব প্রতিষ্ঠানই তছনছ করেছিল। কিন্তু এক সন্ধিক্ষণে তারা সংস্কারে সম্মত হয়েছে। বেনজির-নওয়াজও তো পারলেন। তবে সবার আগে মানতে হবে, প্রতিষ্ঠানগুলো ছারখার হয়ে গেছে। স্বীকার করলে তবে গড়া যাবে। আইরিন জানালেন, পুরোনোদের বিদায় দিয়ে কেনীয় হাইকোর্টের সব বিচারককে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
আজকের সংকট যে মূলত শাসনগত সংকট, তা রাজনীতিকদের আগে নাগরিকদের স্বীকার করতে হবে। লেকশোর হোটেলের সংলাপ অমিত সম্ভাবনা বয়ে এনেছে। প্রধানমন্ত্রী ওই সংলাপ থেকে তাঁর শখের নির্বাচনের প্রতি সমর্থনের অমৃত পান করবেন, শাসনগত পরামর্শের অমৃত উগরে দেবেন, তা হতে পারে না। আমি অর্থনীতি সমিতিকে দ্রুত দ্বিতীয় সংলাপ ডাকতে বলি। অধ্যাপক আবুল বারকাত আয়োজিত সভায় নাগরিক সমাজ কেবল জামায়াতবিরোধী বক্তব্যই দেয়নি। সেখানে পরিষ্কারভাবে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, বর্তমানে যে পদ্ধতিতে ভোট হয়, সে ব্যবস্থা আধুনিক বিশ্ব পরিত্যাগ করেছে। এই পদ্ধতিতে এটাই শেষ নির্বাচন হলে খুশি হব। সংখ্যানুপাত, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ মানতেই হবে। আগামী দুই মাসের মধ্যে উপজেলা নির্বাচন হবে। বিএনপিকে জব্দ করতে নয়, একে কার্যকর গতিশীল প্রশাসনিক একাংশ করুন। তাদের ওপর সাংসদদের দাদাগিরি বন্ধ করুন।
এখন জনমত গড়তে হবে, উভয় দলই যে কেবল নির্বাচন নিয়েই সমঝোতা চায়, সেটাই সত্যিকারের রাজনৈতিক সংকট। জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। কিন্তু নির্বাচনই সবটা নয়। একাদিক্রমে চারটি সুষ্ঠু নির্বাচন আমাদের উত্তরোত্তর সুশাসন দেয়নি। মন্ত্রীদের লুটপাট বন্ধ করেনি। এই ফাঁকিটা যাতে আমরা ধরতে না পারি, তাই দুই দলই ভাঁওতা দিয়ে চলে।
জামায়াত নিয়ে উভয় দলের ভাঁওতাবাজি বন্ধ হোক। তবে সবার আগে সমাজে জামায়াত কীভাবে থাকবে, সে বিষয়ে সংসদকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঢের হয়েছে, দয়া করে আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে রাজনৈতিক শিকার আর করবেন না।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
[email protected]