এখনই চাই রোডম্যাপ

নির্বাচন ও গণতন্ত্র
নির্বাচন ও গণতন্ত্র

৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে যতটুকু যথার্থ; রাজনৈতিক ও নৈতিকতার মাপকাঠিতে ততটুকুই প্রশ্নবিদ্ধ। ভোটার অংশগ্রহণের হারসহ নির্বাচনকেন্দ্রিক সম্ভাব্য সব মাপকাঠিতে যেভাবেই বিশ্লেষণ করা হোক না কেন, ৩ মার্চ ১৯৮৮ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-এর মতো আরও একবার এ দেশের মানুষের ভোটের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে ক্ষমতার রাজনীতির সহিংস ও নির্মম কশাঘাতে।
৫ জানুয়ারির আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে এবং এর আগে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, অন্তরের গভীরে তাঁরা যেমন বাস্তবে জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছেন বলে কোনো দিনই দাবি করতে পারবেন না, তেমনি তাঁদের কেউই হয়তো এমনকি একান্ত আপনজন কর্তৃক ‘অভিনন্দিত’ হলেও বিব্রত না হয়ে পারবেন না।
এরূপ ক্ষমতার লড়াই এ দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষকে আরও দেখতে হয়েছে। এবারের পার্থক্যটা এই যে, নির্বাচনী সহিংসতা আজ এক অভূতপূর্ব বিভীষিকাময় রূপ ধারণ করেছে। লগি-বৈঠার উত্তরে দা-কুড়াল, তার সঙ্গে পেট্রলবোমায়, রগ কেটে, কুপিয়ে হত্যা করে, বৃক্ষ নিধন এবং রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর ওপর আঘাত হেনে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা, নিরাপত্তাসহ মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার যুক্তিতে একদিকে নির্বাচন চাপিয়ে দেওয়া ও অন্যদিকে নির্বাচন প্রতিহত করার নামে যা ঘটেছে, তা ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির এক নির্লজ্জ ও নৃশংস চিত্র বৈ আর কিছুই নয়। এর ফলে শুধু সহিংস অগণতান্ত্রিক শক্তি, যারা বীভৎস নিষ্ঠুরতায় লিপ্ত, তারা ছাড়া আর কারোরই জয় হয়নি। প্রধানমন্ত্রী গত ২১ ডিসেম্বর যেমনটি বলেছিলেন, খোলা মাঠে গোল হয়েছে। তাঁর দলের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার দিন একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী বলেছিলেন, এবারের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এই ইশতেহার জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়ার জন্য নয়। ইশতেহারের মাধ্যমে ম্যান্ডেট নেওয়ার সুযোগ নেই, ‘আমাদের জননেত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, এটা দিয়ে মানুষের ম্যান্ডেট পাওয়া যাবে না এবং অতিসত্বর বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন।’
প্রতিপক্ষের তুলনায় আরও সহিংস, আরও নেতিবাচক, আরও অগণতান্ত্রিক, আরও স্বেচ্ছাচারী, আরও অশোভন ও আরও বিব্রতকর আচরণের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার নির্মম ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে আমাদের রাজনীতি। যে কারণে গণতন্ত্রের নামে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চর্চা বিসর্জন দিয়ে জনগণকে জিম্মি করে অপার সম্ভাবনার এই দেশের উন্নয়ন, সমাজ পরিবর্তন ও আর্থসামাজিক অগ্রযাত্রার সব সম্ভাবনাকে ধূলিসাৎ করা হচ্ছে। জনগণকে আজ অন্ধকার জগতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আরও বেশি অন্ধকারে নিমজ্জিত আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যাঁরা চোখের সামনে ঘটে যাওয়া বিভীষিকা দেখছেন না, শুনছেন না আর্তনাদ। তৈরি করছেন নিজেদের ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। রাজনৈতিক অঙ্গন করাভূত হচ্ছে একদিকে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের, অন্যদিকে উত্থান ঘটছে সন্ত্রাসী, সহিংস, উগ্র, ধর্মান্ধ শক্তির। যেকোনো গণতন্ত্রকামী দেশে রাজনৈতিক চর্চা ও নেতৃত্বের জন্য বর্জনীয় উপাদানের তালিকা প্রণয়নের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আমাদের দুই বৃহৎ দলের নেতা-নেত্রীরা।
অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য না হোক, অভিন্ন ঝুঁকির বিবেচনায় আমাদের দুই নেত্রীকেই নিজেদের পারস্পরিক অগ্রহণযোগ্যতা ও আস্থাহীনতার কারণে সৃষ্ট এই সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে। এ ক্ষেত্রে সুড়ঙ্গের শেষে ম্রিয়মাণ আলোর ইঙ্গিত দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ দেওয়া যেতে পারে, যদি তিনি বাস্তবিকভাবেই অনতিবিলম্বে একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। সরকারের প্রভাবশালী একাধিক মন্ত্রীও একই অবস্থান প্রচার করেছিলেন। অতএব, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার এই নির্বাচনের একমাত্র ইতিবাচক দিক হতে পারে এর গ্রহণযোগ্যতা যে প্রশ্নবিদ্ধ, তা মেনে নেওয়া। তা সত্ত্বেও নির্বাচন স্থগিত করার মতো সৎ সাহস দেখাতে একদিকে যেমন সরকার ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে তাদের নিজেদেরই বিবেকের তাড়নায় নির্বাচনের পর আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগের অঙ্গীকার করেছেন।
জনপ্রতিনিধিত্বের ম্যান্ডেটবিহীন অবস্থানের প্রতি মাদকীয় আসক্তি জন্মানোর আগেই উচিত হবে অনতিবিলম্বে সুনির্দিষ্ট সময়াবদ্ধ রোডম্যাপ প্রকাশ করে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের পথ ত্বরান্বিত করা। এতে সরকারই লাভবান হওয়ার আশা করতে পারে। এই রোডম্যাপের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দৃশ্যত গৃহবন্দী অবস্থান ও নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাসহ সব হয়রানি বন্ধ করতে হবে। অন্যদিকে আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে বিরোধী দলকে হরতাল-অবরোধসহ সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতে হবে; নিজস্ব সামর্থ্য, সমর্থন ও সম্ভাবনার প্রতি আস্থা অর্জন করে উগ্র, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক সহিংস অগণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করতে হবে এবং একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচার সস্পর্কে দলীয় অবস্থান স্বচ্ছ করতে হবে।
সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে ক্ষমতাকেন্দ্রিক নির্বাচন, কিন্তু শুধু নির্বাচন সংকটের সমাধান দিতে পারবে না। এ জন্য রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের লক্ষ্যে কিছু মৌলিক ক্ষেত্রে ঐকমত্য অর্জন অপরিহার্য। এর মধ্যে রয়েছে বর্তমান নির্বাচনপদ্ধতি পরিবর্তন করে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির প্রবর্তন, একই সঙ্গে একদিকে ‘না’ ভোটের পুনঃপ্রবর্তন এবং নির্বাচনী জোটের রাজনীতি বন্ধ করা। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতার সীমারেখা নির্ধারণ করতে হবে। দুই মেয়াদের বেশি এক ব্যক্তি সরকারপ্রধান হতে পারবেন না। দলীয় প্রধান হয়েও একই সঙ্গে সরকারপ্রধানের পদাসীন হওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি আইন করে বন্ধ করতে হবে, একই সঙ্গে সাংসদদের নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন ও কার্যকর করতে হবে। সংসদে বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করতে হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধনীসহ রাজনৈতিক দলে গণতান্ত্রিক চর্চা বিকাশের পথ প্রশস্ত করতে হবে। হরতাল-অবরোধসহ সব রাজনৈতিক কার্যক্রম ও আন্দোলনের আচরণবিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে যেন এরূপ কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করার অপসংস্কৃতির অবসান হয়। সর্বোপরি ক্ষমতার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে যে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে যে গগনচুম্বী সম্পদ আহরণের সুযোগ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে, তা নির্মূল করতে হবে। প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচারব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ করতে হবে।
পরিবর্তনের এরূপ তালিকা যত দীর্ঘই হোক এবং আপাতদৃষ্টিতে যত অবাস্তবই মনে হোক না কেন, গণতন্ত্র ও জনস্বার্থ যেভাবে ব্যাপক ঝুঁকির সম্মুখীন, সে কারণে এসব কর্মকাণ্ড শুরু করতে হবে এখনই, কালক্ষেপণের সময় আর নেই।

ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।