স্বাগত ২৫৬১ বুদ্ধাব্দ

কিছুদিন আগে বাংলা সন প্রবর্তনের ১৪২৩ বছর পার হয়ে গেল। পয়লা বৈশাখে দেশব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষ ১৪২৪ বরণ করা হয়। বৈশাখ থাকতে থাকতে আজ ২৭ বৈশাখ বছর ঘুরে আবারও ফিরে এল শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা। রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ এবং বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লাভ এই তিনটি অনন্য ঘটনা শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সংঘটিত হয়েছিল বলেই বৈশাখী পূর্ণিমার অপর নাম বুদ্ধপূর্ণিমা। বুদ্ধাব্দ বা বুদ্ধবর্ষ গণনাকাল বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লাভের পরদিন থেকে শুরু হয়। যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৬২৩ বছর আগে রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্ম হয়। তিনি মাত্র ৩৫ বছর বয়সে বুদ্ধত্ব লাভ করেন। অর্থাৎ, তিনি (৬২৩-৩৫) খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দে বুদ্ধত্ব লাভ করেন। বুদ্ধ ৮০ বছর বয়সে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। অর্থাৎ, তিনি (৬২৩-৮০) খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। বর্তমান ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ হলে (২০১৭+৫৪৩) গৌতম বুদ্ধ আজ থেকে ২৫৬০ বছর আগে জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আজ থেকে নব বুদ্ধবর্ষ ২৫৬১ সন শুরু হলো।

সারা বিশ্বের বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা আজ যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় নানা আনুষ্ঠানিকতায় নব বুদ্ধবর্ষ ২৫৬১ বুদ্ধাব্দকে বরণ করবেন। জাতিসংঘের সদর দপ্তরেও ‘বেশাখ ডে’ উদ্‌যাপিত হবে। সেখানে অন্যান্য দেশের দূতাবাসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাসের স্থায়ী প্রতিনিধিও উপস্থিত থাকবেন। দিনটি উপলক্ষে বাংলাদেশে আজ সরকারি ছুটি।

বাংলায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অব্দের উদ্ভব ও প্রচলন দেখা যায়। যেমন মল্লাব্দ, শকাব্দ, কলাব্দ, লক্ষণাব্দ, পালাব্দ, চৈতনাব্দ, গুপ্তাব্দ, হর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ, ত্রিপুরাব্দ, বুদ্ধাব্দ, খ্রিষ্টাব্দ, হিজরিঅব্দ, বঙ্গাব্দ, মঘাব্দ, সর্বসিসিদ্ধি সন, জালালি সন, সেকান্দর সন ইত্যাদি। এর মধ্যে খ্রিষ্টাব্দ, বঙ্গাব্দ ও হিজরি সনের প্রচলন থাকলেও বুদ্ধাব্দের কোনো প্রচলন নেই।

বাংলা সাহিত্যের মধ্যে বৌদ্ধ সাহিত্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে বাংলা ভাষার ইতিহাস আজ অন্য রকম হতে পারত। তখন বাংলা ভাষার বয়স ১৪২৪ বছর না হয়ে হতো ২৫৬০ বছর। গৌতম বুদ্ধের বাল্যকালে বঙ্গলিপি বা বাংলা লিপি অধ্যয়ন করার কথা ইতিহাসে এখনো জ্বলজ্বল করছে। আর চর্যাপদ হলো বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন। বাংলা ভাষার প্রথম বই বৌদ্ধধর্মের চর্যাপদ এবং গৌতম বুদ্ধ বঙ্গলিপি অধ্যয়ন করার পরও বুদ্ধাব্দের প্রচলন হয়নি। বাংলা বিশ্বকোষের ১৩শ ভাগের ৬৫ পৃষ্ঠায় গৌতম বুদ্ধের বঙ্গলিপি অধ্যয়নের বিষয়ের উল্লেখ আছে। সেখানে বলা আছে, ‘কিয়ৎকাল পরে সিদ্ধার্থ গুরুগৃহে প্রেরিত হইলেন। সেখানে তিনি বিশ্বমিত্র নামক উপাধ্যায়ের নিকট নানা দেশীয় লিপি
শিক্ষা করেন। গুরুগৃহে গমনের পূর্বেই তিনি ব্রাহ্মীলিপি, খরোষ্ট্রী, পুস্করসারী, অঙ্গলিপি, বঙ্গলিপি, মগধলিপি, মাঙ্গল্যলিপি, মনষ্যলিপি, অঙ্গুলীলিপি, শকারিলিপি, ব্রহ্মলিপি, দ্রাবিড়লিপি, কিনারিলিপি, অর্দ্ধধনলিপি, দরদলিপি, খাস্যলিপি, চীনালিপি, হুনলিপি, মধ্যক্ষরবিস্তারলিপি, পুষ্পলিপি, দেবলিপি, নাগলিপি কিন্নরলিপি, মহোরগলিপি, অসুরলিপি, গরুড়লিপি, মৃগচক্রলিপি, চক্রলিপি, বায়ুমরুলিপি, ভৌমদেবলিপি, অন্তরীক্ষদেবলিপি, উত্তরকুরুদীপলিপি, অপরগৌড়লিপি, পূর্ববিদেহলিপি, উৎক্ষেপলিপি, অধ্যাহরিণীলিপি, বিক্ষেপলিপি, প্রক্ষেপলিপি, সাগরলিপি, বজ্রলিপি, লেখপ্রতিলেখলিপি, অনুদ্রুতলিপি, শাস্ত্রাবর্তালিপি, গণনাবর্তলিপি, উৎক্ষেপপাবত৴লিপি, সর্বরাত্রসংহারিনীলিপি, বিদ্যানুলোমালিপি, বিমিশ্রিতলিপি, ঋষিতপতস্তা, রোষত্রানা, ধরণী-প্রেক্ষণলিপি, সবৌর্ধিষ্যন্দালিপি, সর্বসারসংগ্রহণী ও সর্ব্বভূতরুতগ্রহণী প্রভৃতি চতুঃষষ্ঠী প্রকার লিপি অবগত ছিলেন।’ সিদ্ধার্থ গৌতমের বাংলা, ব্রাহ্মী এবং দেবনাগরি লিপিসহ ৬৪ প্রকার ভাষার লিপি অধ্যয়ন করার কথার ঐতিহাসিক প্রমাণ থাকলেও এর স্বীকৃতি মেলেনি।

বাংলা ভাষা এবং বঙ্গের সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের সম্পর্ক এককথায় নাড়ির সম্পর্ক। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতে, ‘চর্যাপদ: বাঙলা সাহিত্যের প্রথম পরিচয়। চর্যাপদের কবিতাগুলোতে বাঙলা ভাষার আদিরূপ ধরা পড়েছে, বাঙলা সাহিত্যের প্রথম পরিচয় মেলে এখানে, আর এখান থেকেই বাঙলা লিরিকের যাত্রা।’ (বাঙলা সাহিত্যে বৌদ্ধ প্রভাব)। লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের মতে, ‘বাংলা ভাষা বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের হাত ধরে প্রাকৃতের আকর থেকে সৃষ্ট। প্রাচীন বাংলার পাল রাজাদের আমলে বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম গীত ও গীতি কবিতা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের দ্বারাই রচিত হয়।’ (বাংলা সাহিত্যে বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্মের প্রভাব)।

বুদ্ধাব্দ বা বুদ্ধবর্ষ উদ্‌যাপনে বাংলাদেশি বৌদ্ধরা ঐতিহাসিকভাবে অধিকার রাখে। শুধু তা-ই নয়, জাতি–ধর্মনির্বিশেষে সব মানুষ এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ভাগীদার হতে পারে। পরিশেষে কবিগুরুর একটি উদ্ধৃতি টেনে শেষ করছি—

‘বর্ণে বর্ণে, জাতিতে জাতিতে, অপবিত্র ভেদবুদ্ধির নিষ্ঠুর মূঢ়তা ধর্মের নামে আজ রক্তে পঙ্কিল করে তুলেছে এই ধরাতল; পরস্পর হিংসার চেয়ে সাংঘাতিক পরস্পর ঘৃণায় মানুষ এখানে পদে পদে অপমানিত। সর্বজীবে মৈত্রীকে যিনি মুক্তির পথ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন সেই তাঁরই বাণীকে আজ উৎকণ্ঠিত হয়ে কামনা করি এই ভ্রাতৃবিদ্বেষ কলুষিত হতভাগ্য দেশে পূজার বেদিতে আবির্ভূত হোন মানবশ্রেষ্ঠ, মানবের শ্রেষ্ঠতাকে উদ্ধার করবার জন্যে,...ভগবান বুদ্ধ একদিন রাজসম্পদ ত্যাগ করে তপস্যা করতে বসেছিলেন। সে তপস্যা সকল মানুষের দুঃখ মোচনের সংকল্প নিয়ে। এই তপস্যার মধ্যে কি অধিকারবোধ ছিল? কেউ ছিল কি ম্লেচ্ছ? কেউ ছিল কি অনার্য? তাঁর সেই তপস্যার মধ্যে ছিল নির্বিচারে সকল দেশের সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, তাঁর সেই এত বড়ো তপস্যা আজ কি ভারতবর্ষ থেকে বিলীন হবে?’ [বুদ্ধদেব, পৃ. ৮-৯]

জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবার প্রতি শুভ বুদ্ধপূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা রইল।

বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।

প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: সহকারী পরিচালক, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার