উদারনৈতিকদের হাতে ক্ষমতা

ইয়ুন ইয়ুং-কোয়ান
ইয়ুন ইয়ুং-কোয়ান

দক্ষিণ কোরিয়ার ডেমোক্রেটিক পার্টির মুন জে-ইন দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসে এই দ্বিতীয়বারের মতো রক্ষণশীলদের হাত থেকে উদারনৈতিকদের হাতে ক্ষমতা গেল। গত বছরের অক্টোবর মাসে হঠাৎ করেই এর সূত্রপাত হয়। দেশটির তখনকার প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন–হের বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। ফলে তাঁকে অভিশংসিত করে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এতে বোঝা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্রের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা আছে। মুন এমন এক সময় ক্ষমতা নিতে যাচ্ছেন, যখন উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দক্ষিণের উত্তেজনা চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। তিনি কোন নীতিতে চলবেন, সেটা বোঝার জন্য ১৯৯৮-২০০৩ মেয়াদে কিম দে-জুংয়ের জমানার উদারনৈতিক পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে পরিচয় থাকা দরকার।

কিম ইউরোপে স্নায়ুযুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধান দেখেছেন। একইভাবে তিনি নিজ দেশের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার দ্বন্দ্ব-বিবাদের অহিংস সমাধান খুঁজছিলেন। সে কারণে তিনি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতে চেয়েছেন। আর তিনি যে ‘সানশাইন পলিসি’ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর উত্তরসূরি রোহ মু-হিয়ানও সেটা গ্রহণ করেছিলেন। রোহ ২০০৯ সালে মারা যান। তিনি ছিলেন মুনের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

কিমের কাছে জার্মানির একীভবন ছিল গভীর উৎসাহের উৎস, যার আগে দুই জার্মানির মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ শুরু হয়—অস্টপলিটিক। সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ড ১৯৭০-এর দশকে ঐকান্তিকভাবে এটি শুরু করেন। এরপর হেলমুট কোহল ১৯৮২ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই নীতি চালিয়ে যান। এই অস্টপলিটিকের মাধ্যমে পূর্ব জার্মানির প্রকৃতি না বদলালেও পূর্ব জার্মানি পশ্চিম জার্মানির ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে পুনঃ একীভবনের সময় কোহল রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক জায়গায় চলে যান। অধিকাংশ কোরীয় উদারনৈতিক স্বীকার করেন, উত্তর কোরিয়া পূর্ব জার্মানির মতো নয়। মুন ও তাঁর সমর্থকদের কাছে ব্যাপারটা তখন দুঃখজনক মনে হবে, যখন তাঁরা দেখবেন, দক্ষিণ কোরিয়ার রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট লি মিয়ুং-বাক সানশাইন পলিসি মেনে চলেননি, যেখানে কোহল অস্টপলিটিক চালিয়ে গেছেন। তাঁরা যদি এটা করতেন, তাহলে উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়ত, চীনের ওপর নয়। সে ক্ষেত্রে আজ দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে উত্তর কোরিয়ার রাশ টেনে ধরার জন্য চীনের কাছে দেনদরবার করতে হতো না।

দক্ষিণ কোরিয়ার উদারনৈতিকেরা এটাও স্বীকার করেন, কিম ও রোহের জমানার শুরুর দিকের তুলনায় আজকের ভূকৌশলগত অবস্থানের তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। ওই সময় উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠেনি। জাতির একীভবনের উদার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য মুনকে আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে, যেটা তাঁর পূর্বসূরিদের করতে হয়নি। তারপরও মুন স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন। তিনি সেটা বিজ্ঞতার সঙ্গেই করবেন, আর তাঁর চোখ থাকবে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায়। সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার যে সম্পর্ক, সেটাই তাঁর দেশের কূটনীতির ভিত্তি। তিনি অঙ্গীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রথমে কথা না বলে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনা করবেন না।

গত নয় বছরে দক্ষিণ কোরিয়ার রক্ষণশীল প্রেসিডেন্টরা, বিশেষ করে পার্ক গিউন–হে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। তিনি দেশটিকে বিপারমাণবিকীকরণের চেষ্টা করেছেন। তবে দেশটির উদারনৈতিকেরা বলেন, এর মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে একীভবনের লক্ষ্য বিনষ্ট হয়েছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন, এই সম্পর্ক বজায় রাখাটা উপদ্বীপের পুনঃ একীভবনের ভিত্তি তৈরি করবে। জার্মানির বেলায় অস্টপলিটিক ঠিক যা করেছে। রক্ষণশীল পূর্বসূরিদের চেয়ে মুন আরও নমনীয় হতে পারেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমের যে চুক্তি হলো, তার আদলে কিছু করার চেষ্টা করতে পারেন; যার লক্ষ্য হবে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি স্থগিত করা। কিন্তু ট্রাম্প যদি থাড ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের বিনিময়ে মুনের কাছ থেকে কিছু চান, তাহলে মুনকে না বলতে হবে। তা না হলে দেশের ভেতর বাম ও ডান উভয় তরফই তাঁর সমালোচনা করবে।

শেষ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে চীন, যার সঙ্গে কোরিয়ার ইতিহাস বড়ই তিক্ত। চীন যখনই মনে করেছে, কোরীয় উপদ্বীপের ভূমি ব্যবহার করে তার ওপর হামলা হতে পারে, তখনই তারা সেখানে হস্তক্ষেপ করেছে। ১৫৯২ সালে জাপান যখন চোসন রাজবংশকে পদানত করে মিং রাজবংশকে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিয়েছে, তখন চীন হস্তক্ষেপ করেছে। ১৮৯৪ সালে চীন-জাপান যুদ্ধের সময় এটি হয়েছে, এরপর ১৯৫০-এর দশকের শুরুর দিকে কোরীয় যুদ্ধের সময়ও চীন হস্তক্ষেপ করেছে।

এই ইতিহাস সত্ত্বেও কোরীয় উদারনৈতিকেরা স্বীকার করেন, এই পুনঃ একীভবনের জন্য চীনাদের সহায়তা জরুরি। একইভাবে মুনের সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মজবুত সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, একই সঙ্গে তাকে চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন থাড ক্ষেপণাস্ত্র আসার পর চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে গেছে। মুন হয়তো এই বলে চীনকে আশ্বস্ত করতে পারেন যে এই ব্যবস্থা ক্ষণস্থায়ী।

যাঁরা বলছেন, মুনের জমানায় যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্ক খারাপ হবে, তাঁরা নিশ্চিতভাবেই ভুল করছেন। সর্বোপরি উদারনৈতিক রোহের জমানায় দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দেশের ভেতরে তারা মার্কিন সেনা পুনরায় মোতায়েনের অনুমতি দেয়। এরপর ইরাকে যুদ্ধ করার জন্য নিজের সেনা পাঠায়। মুন এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন, এর সঙ্গে তিনি সানশাইন পলিসির নতুন ও নব রূপ তৈরির চেষ্টা করবেন, যার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার একদম গোড়ার ও দীর্ঘমেয়াদি আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকবে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ইয়ুন ইয়ুং-কোয়ান: দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী।