বিচারপতিরা কেন কথা বলবেন না?

প্রধানমন্ত্রী সোমবার রাতে সংসদে বলেছেন, ‘আমি জানি না আমাদের চিফ জাস্টিস কীভাবে বললেন, আইনের শাসন নেই? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই?’ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট নিয়ে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান মামলার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘একজন নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলায় ১৪০ দিন সময় চায় আর সেটা দেওয়া হয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আছে বলেই তো এই সময়টা দিতে পারছে। না হলে তো দিতে পারত না। আমরা তো সেটা করিনি। ইচ্ছামতো সময় দিয়ে গেছেন, দিয়েই যাচ্ছেন।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘কথায় কথায় রিট। একই মামলায় যদি ৪০-৫০ বার রিট হয় আর যদি সেই রিট নিষ্পন্ন হয়, তাহলে স্বাধীনতা নেই কীভাবে? এই একটা দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। যাঁরা এই সুযোগ নিচ্ছেন, তাঁরাও একসঙ্গে তাল মেলাচ্ছেন আইনের শাসন নেই।’

প্রধানমন্ত্রীর কথায় যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তা হচ্ছে, আদালত একজন নেত্রীকে অন্যায় সুবিধা দিচ্ছেন।এ ধরনের মন্তব্য বিচারব্যবস্থা ও আদালতের প্রতি মানুষের আস্থায় চিড় ধরানোর জন্য যথেষ্ট। আবার এর বিপরীতে তাঁর বক্তব্যকেই আদালতের ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা হিসেবে অভিযোগ উঠতে পারে। এখন যদি আদালত ওই বিচারাধীন নেত্রীর মামলার শুনানি শেষ করার জন্য একটু বেশি উদ্যোগী বা তৎপর হন, তাহলেই ‘সরকারি চাপের’ অভিযোগ অনেকের কাছেই হয়তোবিশ্বাসযোগ্যতা পেতে শুরু করবে। বিচারাধীন মামলার বিষয়ে যেকোনো ধরনের মন্তব্য বিচার–প্রক্রিয়ার জন্য ক্ষতিকর এবং আইনে একে আদালত অবমাননা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা আছে। সংসদীয় কার্যক্রমের দায়মুক্তির বিধানের কারণে তাঁদের এ ধরনের মন্তব্য করায় বাধা নেই ঠিকই; কিন্তু এতে আদালতের নিরপেক্ষতা ও ভাবমূর্তি অযথা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। আর যে বিচারাধীন মামলাটির কথা তিনি উল্লেখ করলেন, সেটি যাঁর বিরুদ্ধে তিনিও এর আগে তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং দেশের বড় একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। ফলে মামলাটির বিচারের প্রক্রিয়া যে দেশে-বিদেশে নিবিড় পর্যালোচনার বিষয় হবে, তাতে সন্দেহ নেই। বিচারটি যদি কোনো কারণে বিতর্কিত হয়, তবে সরকারের চেয়ে তার প্রতিপক্ষেরই লাভ বেশি।

প্রসঙ্গত, প্রায় তিন বছর আগে ব্রিটেনের একটি মামলার কথা স্মরণ করি। ডেভিড ক্যামেরন তখন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা অ্যান্ডি কুলসনের বিরুদ্ধে ফোন হ্যাকিংয়ের মামলা চলছে আদালতে। সেটি আমাদের এখানকার দায়রা জজ বা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সমতুল্য। ব্রিটিশ ফৌজদারি আদালতের বিচারকাজে জুরি হিসেবে সাধারণ নাগরিকদের দায়িত্ব পালন করতে হয় এবং ওই মামলায়ও অ্যান্ডি কুলসন দোষী না নির্দোষ—সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছিল জুরিদের ওপর। অ্যান্ডি কুলসন অনেক দিন ধরেই বিতর্কিত। বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকা নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর সম্পাদক ছিলেন তিনি। তারকা-রাজনীতিক ও নানা ধরনের মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়ায় ফোন হ্যাকিংয়ের মতো বেআইনি পন্থা অনুসরণে উৎসাহ বা প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য বেশ কিছুদিন ধরে তিনি বিপুলভাবে সমালোচিত হচ্ছিলেন। তো মামলাটির শুনানি চলার সময় প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন অ্যান্ডি কুলসনকে চাকরি দেওয়ার জন্য পার্লামেন্টে ক্ষমা চাইলেন। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে এমন ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক যে অ্যান্ডি কুলসন আলোচিত অপরাধে অপরাধী। ফলে অ্যান্ডি কুলসনের আইনজীবীরা আদালতে আবেদন করলেন মামলাটি বাতিলের। কেননা, ক্যামেরনের মন্তব্যে জুরি সদস্যরা প্রভাবিত হবেন এবং তাঁদের মক্কেল ন্যায়বিচার পাবেন না। দিনটি ছিল ২০১৪ সালের ২৪ জুন। ওই আদালতের বিচারক সেদিনই প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের কাছে তাঁর মন্তব্যের ব্যাখ্যা চান। ক্যামেরনের ব্যাখ্যা বিচারক স্যান্ডার্স প্রত্যাখ্যান করেন এবং আদালত তাঁকে তিরস্কার করেন। তবে মামলাটি খারিজ না করে তিনি তাঁর কার্যক্রম চালিয়ে নিয়েছিলেন।

২.

প্রধান বিচারপতির যে উদ্ধৃতি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, সেটি আদালতের প্রকাশ্য বিচারিক কার্যক্রমের অংশ। অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট প্রকাশের বিষয়ে আপিলে সরকার আবারও সময় চাইলে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে বলেছেন, মনে হয় সুপ্রিম কোর্ট থেকে বঙ্গভবন বা গণভবনের দূরত্ব কয়েক লাখ কিলোমিটার! ফাইল চলাচলে সময় লাগে আড়াই বছর। স্পষ্টতই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগকে একধরনের কঠিন ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। ১৮ বছর আগে মাসদার হোসেন মামলা হিসেবে খ্যাত এক মামলার রায়ে অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধি তৈরির আদেশ হয়েছিল। ১৬ বছর পর ২০১৫ সালের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় একটি বিধিমালার খসড়া তৈরি করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়। সুপ্রিম কোর্ট সেটিতে যেটুকু কাটাছেঁড়া করে সংশোধন করে দিয়েছেন, সেটিকে সরকার যে মানতে চাইছে না, তা মোটামুটি স্পষ্ট। ফলে ফাইলটি দুই (গুগল ম্যাপের হিসাবে বঙ্গভবনের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের দূরত্ব) থেকে সাত (গণভবন থেকে) কিলোমিটার দূরত্ব গত দুই বছরেও অতিক্রম করতে পারেনি। এখন সুপ্রিম কোর্ট যদি অধস্তন বিচারকদের মধ্যে শৃঙ্খলাবিধানের কাজটিও করার স্বাধীনতা না পান, তাহলে তাঁদের তরফে এই প্রসঙ্গটি তোলা অস্বাভাবিক কিছু নয়

প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে এর আগেও অনেকবার কথা বলেছেন। বিভিন্ন জেলা আদালত পরিদর্শনের সময়, কিংবা আইনজীবী সমিতির অনুষ্ঠানগুলোতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। নাকি আমরা চাই আমাদের বিচারপতিরা আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থার বাইরে অন্যান্য বিষয়ে কথা বলুন। তাঁদের কাছ থেকে নিশ্চয়ই কেউ নিত্যপণ্যের বাজারদর অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা শুনতে চাইবেন না।

৩.

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রধান বিচারপতির খোলামেলা কথাবার্তায় বিব্রত (নাকি ক্ষুব্ধ?) আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কয়েক
দিন আগে (২৬ এপ্রিল, ২০১৭) সাংবাদিকদের কাছে অনেকটা ক্ষোভের সুরে বলেছেন, বিশ্বের আর কোনো দেশের প্রধান বিচারপতিরা প্রকাশ্যে এত কথা বলেন না। আনিসুল হক সেদিন বলেছেন, ‘মাননীয় প্রধান বিচারপতির প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল হয়ে বলব, কোনো দেশে কিন্তু বিচারকার্য ছাড়া মাননীয় প্রধান বিচারপতিরা এত উষ্মা, এত কথা পাবলিকলি বলেন না।’ আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্যের ঠিক আগের দিন প্রধান বিচারপতি হবিগঞ্জে জেলা আইনজীবী সমিতির সভায় বলেছিলেন, সরকার বিচার বিভাগের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। স্পষ্টতই, প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগ বা আদালত-সম্পর্কিত বিষয়ে কথা বলেছেন এবং তা-ও আইনজীবীদের সভায়।

অনেকের কাছে মনে হতে পারে যে বিচারপতিদের প্রকাশ্যে বক্তব্য দেওয়ার বিষয়টি শুধু বাংলাদেশেই ঘটে থাকে, অন্য কোথাও নয়। বিষয়টি মোটেও তা নয়। বিচারপতিরা আইন, আইনের শাসন ও আদালত-সম্পর্কিত বিষয়ে অনেক দেশেই খোলামেলা কথা বলে থাকেন। এখানে সাম্প্রতিক দুটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। দুটিই ব্রিটেনের, যেটা আমাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। কেননা, আমরা আইন-আদালত ও বিচার-আচারের ক্ষেত্রে ব্রিটিশদেরই বেশি অনুসরণ করি। ব্রেক্সিট বিষয়ে সরকারকে পার্লামেন্টের অনুমোদন নিতে হবে বলে দেশটির হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রায় দেওয়ার পর ওই বেঞ্চের সদস্য-বিচারপতিদের ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে অভিহিত করে। সরকার ও পার্লামেন্ট তখন আদালতের ভাবমূর্তি রক্ষায় ওই সব বিচারপতির পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে ভূমিকা না নেওয়ায় বিচারপতিরা রাজনীতিকদের সমালোচনা করেন। বিশেষভাবে সমালোচিত হন আইনমন্ত্রী লিজ ট্রাস।

ব্রিটেনের বর্তমান প্রধান বিচারপতি হলেন ডেভিড ন্যুবার্গার। তিনি গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বিবিসিকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা যদি বিচার বিভাগকে খাটো করি, তাহলে আইনের শাসনকে খাটো করব।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতি নিশ্চিতভাবেই সুবিচার করা হয়নি [উই (জাজেস) ওয়্যার সার্টেনলি নট ওয়েল ট্রিটেড]।’ তিনি বিচারকদের আইনের শাসনের চূড়ান্ত (আলটিমেট) অভিভাবক হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগের অন্যায় সমালোচনা আমাদের সমাজকেই খাটো করে ফেলতে পারে।’

বিচারপতি ন্যুবার্গারের অবসরে যাওয়ার কথা আগামী সেপ্টেম্বরে। সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে আরও দুজন অবসরে যাবেন। শূন্য হওয়া তিনটি পদে নিয়োগের জন্য বিচারক নিয়োগ কমিশন ইতিমধ্যে আবেদন নিতে শুরু করেছে। কিন্তু কট্টর ব্রেক্সিটপন্থী এক টোরি নেতা ইয়ান ডানকান স্মিথ প্রস্তাব দিয়েছেন যে যাঁরা নতুন বিচারপতি নিযুক্ত হতে যাচ্ছেন, তাঁদের মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গিগুলো একটি পার্লামেন্টারি কমিটির নিরীক্ষা করে দেখা উচিত। প্রধান বিচারপতি ন্যুবার্গার এরপর ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকাকে বলেছেন, দেশের বিচারকদের নিয়োগ যদি রাজনৈতিক যাচাই-বাছাইয়ের বিষয় হয়, তবে তা হবে খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়। ব্রিটেনে সুপ্রিম কোর্ট একটি নতুন সংযোজন এবং ওই আদালতে বিচারপতি নিয়োগের আইনটিও নতুন। সেখানে এ কাজটি করে একটি কমিশন, যাতে রাজনীতিক কাউকে রাখা হয়নি। তবে কমিশন আইনমন্ত্রী এবং স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসের মুখ্যমন্ত্রীদের (ফার্স্ট মিনিস্টার) সঙ্গে পরামর্শ করে নেয়।

বিচারপতিদের নীতি-নৈতিকতার বিষয়ে ব্রিটেনে আলাদা যে নির্দেশনা আছে (গাইড টু জুডিশিয়াল কনডাক্ট, মার্চ ২০১৩), তাতে (অষ্টম অধ্যায়ে) স্পষ্ট করে বলা আছে যে বিচারকেরা সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে গণমাধ্যমে মন্তব্য করার স্বাধীনতা ভোগ করবেন। তবে কোনো রায়ের বিষয়ে সমালোচনার জবাব দেবেন না। কোনো বিচারিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে ভিন্নমত প্রকাশ করবেন না। ওই আচরণবিধিতে এটিও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে বিচারাধীন কোনো নির্দিষ্ট মামলার বিষয়ে বিচারকেরা কথা বলবেন না। আর গণমাধ্যম মামলার খবর প্রকাশে ভুল করে থাকলে সেখানে করণীয়ও আলাদাভাবে নির্দেশ করা আছে। ওই নীতিমালায় আরও বলা হচ্ছে, সংবাদমাধ্যম, আইনবিষয়ক প্রকাশনা, সেমিনার, প্রকাশ্য সভার মতো ফোরামে যেহেতু বিচার প্রশাসন, বিচার বিভাগের কার্যক্রম একটি প্রয়োজনীয় ও বৈধ বিতর্কের বিষয়, সেহেতু সেসব ক্ষেত্রে বিচারকদের উপযুক্ত অবদান প্রত্যাশিত।

সরকারের দাবি অনুযায়ী বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করলেই সেই স্বাধীনতার আরও উন্নয়নের কথা বলা যাবে না—এমন যুক্তি যথাযথ নয়। সুতরাং রাজনীতিকদের উচিত হবে বিচার বিভাগের প্রত্যাশাগুলো কী, তা অনুধাবনে আন্তরিক হওয়া এবং যৌক্তিক পদক্ষেপ নেওয়া। ৩৫০ জন সাংসদের পাস করা আইন দুজন বিচারপতির কলমের খোঁচায় নাকচ হতে পারে না—এটা দুর্বল যুক্তি। এ ধরনের যুক্তি বিবেচনায় নিলে সংবিধানের যেসব সংশোধনী আদালত এর আগে বাতিল করেছেন, সেসব সিদ্ধান্ত নিয়েও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।