গুলশানের গুঞ্জন চিৎকার হয়ে উঠছে না কেন?

প্রতিবাদের গুঞ্জন-ফিসফাস চিৎকার হয়ে ফেটে পড়ছে না কেন গুলশান অ্যাভিনিউতে?
প্রতিবাদের গুঞ্জন-ফিসফাস চিৎকার হয়ে ফেটে পড়ছে না কেন গুলশান অ্যাভিনিউতে?

গুলশানের হৃদয় কি বারবার ক্ষতবিক্ষত হতেই থাকবে? হলি আর্টিজানের ঘটনার পর সারা দেশ, এমনকি পৃথিবীও মানবতার এ করুণ ট্র্যাজেডিতে আলোড়িত হয়েছিল। ধ্বংস মুছে আবার চালু হয়েছে হলি আর্টিজান; কিন্তু গুলশানের হৃদয়ের শূন্যতা কি কেটেছে? এই গুলশান তো মানবিক সাহসে উজ্জীবিত তরুণ ফারাজেরও। এই গুলশান তো সেদিন নিহত ইশরাতেরও। তাদের নিয়ে যে কোনো পরিবার গর্বিত হতে পারে। সেই গুলশান ছিল শোকাহত, বিমর্ষ এবং আতংকিত। সেই ব্যথার সমব্যথী হয়েছিল দেশের সকল মানুষ। আর জোড়া ধর্ষণের ঘটনায় সেই গুলশান হয়েছে বিব্রত, বিপর্যস্ত। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, ফারাজ-ইশরাতের স্মৃতির মধ্যেই রয়ে গেছে গুলশানের প্রাণভোমরা। কয়েকজন জঙ্গি কিংবা বর্বর ধর্ষক কোনো সমাজের প্রতিচ্ছবি হতে পারে না। কোনো পাড়া, মহল্লা, বসতি, বস্তিকে এভাবে এক রংয়ে দাগানো যায় না।
গুলশানের ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছুও নয়। সারা দেশে যা হচ্ছে, তার বাইরে গুলশানই বা যাবে কী করে? গুলশান বাংলাদেশেরই অংশ। এ ঘটনার সংকেত একটাই, সারা বাংলাদেশের ব্যথা ও বিপদ থেকে গুলশানও মুক্ত নয়। নগর পুড়লে সেই আগুন দেবালয়কেও ছাড় দেয় না। সেবারের নাশকতার প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ বাস-রিকশা বাদ দিয়ে বিশেষ পাবলিক যানবাহন চালু হয়। এবারে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা কি নেওয়া হবে? সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সদরে নাহয় পাহারা বসানো গেল, কিন্তু অন্দরের বিকাশের জন্য অন্য কিছু চাই। ধানমণ্ডির মতো গুলশানের আবাসিক চরিত্র বদলে দিচ্ছে ‘ব্যবসা’। অথচ আবাসিক এলাকায় যা থাকা জরুরি ছিল তা এখানে খুমই কম বা নেই বললেই চলে। গুলশানে কেন নেই সিনেমা হল, কেন নেই পাঠাগার-বইয়ের দোকান, কেন নেই নাটকের মঞ্চ? শপিং মল আছে, ক্লাব আছে, বিনোদনকেন্দ্র আছে, তরুণদের সপ্রাণ-সাবলীল যোগাযোগের সুযোগ আছে কি? রেস্টুরেন্ট ছাড়া রাজধানীতে কি মানুষের আর মিলবার জায়গা থাকবে না?
হালিম ওরফে নাঈম আশরাফের মতো যে লোকেরা হোটেল ব্যবসার নামে প্রমোদ বাণিজ্য চালিয়ে ধনীর দুলালদের বিপথে নিচ্ছিলেন, কীভাবে তার প্রতিষ্ঠা হলো গুলশানে? তার যে ইতিহাস জানা যাচ্ছে, তার ষোলো আনাই প্রতারণার। গুলশান তো কোনো প্রমোদপল্লি নয়। সেখানে যা খুশি তা করা বন্ধে নজরদারি কি দরকার ছিল না? প্রতিবেশী মানে তো শুধু কিছু ভবন নয়; প্রতিবেশী মানে সমাজ, পাশাপাশি বসবাসের ভরসা। আশপাশে কতিপয় ধর্ষক-নির্যাতক রেখে গুলশানবাসী কি ভরসা পাবেন?
জোড়া ধর্ষণের ঘটনায় শাহবাগে প্রতিবাদ হয়েছে; কিন্তু গুলশানে কিছু হয়নি। সহপাঠীকে ধর্ষণের প্রতিবাদে স্কুলের মেয়েরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের ছাত্রীরা বখাটে খুনীর শাস্তির দাবিতে সড়ক অবরোধ করেছিল। গ্রাম-মফস্বলের মানুষও প্রায়ই সপরিবারে রাস্তায় নামেন। গুলশানের ছেলেমেয়েরা কি সেরকম কিছু ভাববে? ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের প্রতিবাদে তীব্র আন্দোলন হয়েছিল। সেই আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে জানি, ক্যাম্পাসের অনেক শিক্ষার্থীর মনে জেদ চেপে গিয়েছিল; হয় ধর্ষকেরা থাকবে, নাহয় আমরা থাকব। সেই অদম্য জেদ জয়ী হয়েছিল। জাবির সেই ছাত্রছাত্রীরা ছিল সামান্য লোক। কিন্তু তারা অসামান্য হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের দৃঢ়তা আর ঐক্যের জোরে। বিশেষ করে মেয়েদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল আসলেই ঐতিহাসিক। সরকারি সংগঠনের শক্তির বিরুদ্ধে তারা যদি পারে, প্রতাপশালী গুলশান কেন পারবে না? গুলশানের কিছু তরুণ বন্ধুদের মাধ্যমে জানি, তাদের মধ্যেও প্রতিবাদের গুঞ্জন-ফিসফাস আছে। কিন্তু সেটা চিৎকার হয়ে ফেটে পড়ছে না গুলশান অ্যাভিনিউতে। নীরবতার বরফ গলে শতজলঝর্ণার ধ্বনি উঠুক। গুলশানের তারুণ্য তার ক্ষোভ-দুঃখ নিয়ে কথা বলে উঠুক। দাঁড়াক নির্যাতিত ছাত্রীদের পাশে। দেশটাকে বাসযোগ্য রাখতে হলে এটা আমাদের করতে হবে।
সময়টাই রাগী ছেলেদের। কিশোর বয়সীরা খুন করছে কিশোরকে। কিশোরী নির্যাতিত হচ্ছে সহপাঠী-বন্ধুদের হাতে। সমাজটাই হয়ে উঠছে মাইনফিল্ড। কখন কোথায় কে তার শিকার হবে; আগাম বলা যায় না। রাগী তরুণেরা সব শ্রেণিতেই আছে। ধনীর বখাটে যুবকের রাগ আরো তেজষ্ক্রিয় ও মারাত্মক। তিনটি ঘটনা আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। গুলশানের রাস্তায় রেসিং কার ছুটিয়ে মা ও শিশুকে ধাক্কা দিল ধনীর দুই দলাল। যানজটে বিরক্ত এক সাংসদতনয়ের পিস্তলের গুলিতে নিহত হয়েছিল দুজন গরিব মানুষ। এক গডফাদারের পুত্রের নির্দেশে মেধাবী কিশোর ত্বকীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এসব ঘটনার তদন্ত চলছে তো চলছেই। শেষ হচ্ছে না। আইনের হাত সম্ভবত ক্ষমতার মগডাল স্পর্শ করতে পারে না।
ওপরে বলা ঘটনা তিনটি তিন জায়গায় ঘটেছে। গুলশানে, মগবাজারে আর নারায়ণগঞ্জে। খাদিজা কোথায় কোপ খেয়েছিল, কোথায় পড়ে ছিল তনুর লাশ? দেশময় মানুষ মার খাচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে। সব দায় একা গুলশান কেন নেবে?
ওইসব রাগী তরুণ-যুবারা জানেন, টাকা ও ক্ষমতার লীলায় তাঁরা পার পেয়ে যাবেন। বিচারহীনতার বিজয়ের দেশে তা ভাববেনই না কেন? সবই তো ফান। ধর্ষকের কাছে ধর্ষণও একটা ফান। আর হাউ ফানি আমরা আমজনতা, হাউ ফানি আমরা যারা ধর্ষিতার পক্ষের লোক, হাউ ফানি তাদের মর্মাহত পরিবার! গতির নেশা, তরলের নেশা, ফুর্তির নেশা মিলেছে ক্ষমতার নেশার সঙ্গে। গবেষণায় দেখা গেছে, ক্ষমতা মস্তিষ্কের এমন রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায়, তখন আর হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এদের সামলানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। নইলে তারা আমাদের সকল আবাসিকতা, পারিবারিকতা এবং প্রতিবেশিতার মধ্যে বিষ ঢোকাবে। নিজের আনন্দ ছাড়া যারা আর কিছু ভাবতে পারে না, তারা সকল সমাজের জন্যই বিপজ্জনক। যে পরিবার থেকেই তারা আসুক, তাদের শাস্তি না হলে, সমাজ নিরাপদ হবে না। পুরনো কথা আবারো বলি, ধর্ষকের তালি এক হাতে বাজে না। এক হাত যদি হয় অপরাধীর, আরেক হাত বিচার না-করার ক্ষমতার। কীভাবে অভিযুক্তরা ‘নিরাপদে’ পালিয়ে যেতে পারল, তার জবাবদিহি তো ক্ষমতার কাছেই চাইতে হবে।
চার্লি চ্যাপলিনের ‘সিটি লাইটস’ ছবিতে একটা অসাধারণ পরিস্থিতি আছে। এক ভদ্রলোক ভুল করে একটা হুইসেল বাঁশি গিলে ফেলে। সেটা আটকে থাকে শ্বাসনালিতে। ফলে তার হিক্কার দমক শুরু হয়। হিক্কা ওঠে আর বাঁশির দরজায় বাতাস লাগে। বেচারা যতবার হিক্কা দেয় ততবার তার ভেতর থেকে হুইসেলটি বেজে ওঠে। যতই শব্দটি লুকাতে চায়, ততই বাঁশিটা বেজে ওঠে। বিব্রত হয়ে আশেপাশের সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করে, যেটা বাজছে সেটা তার শরীরের অংশ নয়, ওটা পেটে ঢুকে পড়া বহিরাগত জিনিস। কিন্তু লাভ হয় না। বাঁশিটার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই, অতএব কেলেঙ্কারির বাঁশিটা বাজতেই থাকে।
যতই ভাবি না কেন, ধর্ষকেরা সমাজের বাইরের বিকারগ্রস্ত পুরুষ; তা ঠিক নয়। তারা কিন্তু আমাদেরই বন্ধু, পরিজন, প্রতিবেশী। রসু খাঁর মতো সে এ সমাজেরই লোক এবং আমাদের ভেতরে বসেই তারা নির্যাতনের বাঁশি বাজিয়ে যায়। কেউ শুনি কেউ শুনি না। বিরাট টাইটানিক ডুবে গিয়েছিল ডুবো পাহাড়ের ধাক্কায়, কারণ ক্যাপ্টেন তা দেখতে পাননি। দেশের নৈতিক অবক্ষয়, বিচারহীনতা পাহাড়সমান হয়ে গেছে। একজন-দুজন ধর্ষক হলো সেই পাহাড়ের একটি-দুটি পাথর। এসব পাথর হয়তো আমরা ভাঙতে পারব। কিন্তু পাহাড়টা সরাব কী করে, যদি সমাজের, পরিবারের, ব্যক্তিমানুষের জাগরণ না ঘটে? ডুবন্ত জাহাজের নাবিক বার্তা পাঠায়: SOS। সেইভ আওয়ার সৌলস, আমাদের প্রাণ বাঁচাও। আমাদেরও এখন সব নাগরিকের কাছে বার্তা পাঠাতে হবে: সেইভ আওয়ার সোসাইটি, আমাদের সমাজটা বাঁচাও।