ওরা পারে আমরা কেন পারি না?

এশিয়ায় মালয়েশিয়া অন্যতম উন্নত দেশ
এশিয়ায় মালয়েশিয়া অন্যতম উন্নত দেশ

কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আকারে বিশাল। এক টার্মিনাল থেকে আরেক টার্মিনালে যেতে হয় ট্রেন দিয়ে। আমরা আবার উঠব পেনাংয়ের বিমানে। নানা রকম দিকনির্দেশনা দেখে বোঝা গেল, নির্দিষ্ট পিন্টু মানে বিমানে ওঠার গেট অন্য টার্মিনালে। চলে এলাম ট্রেনের কাছে। ট্রেন আসছে তিন-চার মিনিট পর পর। থামছে, দরজা খুলছে—মানুষজন উঠছে, ট্রেন চলছে। এক সহযাত্রী বললেন, এই ট্রেনে চালক নেই।
বিমানবন্দরের ট্রেন, অল্প দূরত্ব—চালকহীন বিষয়টা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু কুয়ালালামপুর শহরে এলআরটি (লাইট রেল ট্রানজিট) নামে যে চার-পাঁচ বগির রেলগাড়ি চলাচল করছে, সেটারও তো চালক নেই। চালক নেই বিমানবন্দর থেকে কেএল সেন্ট্রালগামী রেলগাড়িরও। এগুলো বেশি গতির বিদ্যুৎ-চালিত ট্রেন। কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত ট্রেনগুলো প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে যায় দাগ কাটা ঘরে, একেবারে কাঁটায় কাঁটায় মিলে গিয়ে দরজা খুলে যায়। কম্পিউটার চিপ লাগানো টিকিট স্ক্যান করে ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে হয় আবার গন্তব্যে নেমে ওই টিকিট স্ক্যান করে বের হতে হয়। তাই ট্রেনে টিকিট চেকারও নেই।
এশিয়ায় মালয়েশিয়া অন্যতম উন্নত দেশ। পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার তো বটেই, কুয়ালালামপুরে এমন আরও অনেক ঝাঁ চকচকে দালান আছে, যেগুলো তাকিয়ে দেখতে ঘাড় ব্যথা হয়ে যায়। উন্নতির ছোঁয়া সর্বত্র। আরও দালান হচ্ছে। দ্রুতগতির রেল যোগাযোগের বিস্তৃতি ঘটছে। এমআরটি (মাস র‌্যাপিড ট্রান্সপোর্ট) করপোরেশন কুয়ালালামপুর শহর থেকে শুরু করে আরও অনেক দূরে রেল যোগাযোগ তৈরি করছে। কখনো তা ভূতলে, কখনো তা মাটির ওপরে। এই এমআরটি প্রকল্পের বেশির ভাগ শ্রমিক বাংলাদেশের। এই দেশ আর আমাদের বাংলাদেশের অনেক কিছুই শুরু হয়েছে একসঙ্গে। মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের বিমানে ঢুকে স্টার পত্রিকা পড়েই জানা গেল মালয়েশিয়ান টেলিভিশনের ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে ২০১৩-এর শেষ দিকে। বাংলাদেশ টেলিভিশনও পা দিল সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে।
এবার মালয়েশিয়ায় প্রথম গন্তব্য ছিল পেনাং। ছোট ছিমছাম সুন্দর এক দ্বীপ। এ জায়গাটাকে শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। পরিকল্পনা করে প্রযুক্তি শিল্পকারখানাই স্থাপন করা হয়েছে বেশি। সেমি-কন্ডাকটর থেকে শুরু করে কম্পিউটার—নানা রকম প্রযুক্তি পণ্যের কারখানা পেনাং। এখানে ডেল কম্পিউটারের কারখানার ভেতরটাও দেখা হলো আমাদের। ছয় ঘণ্টা করে কর্মদিবস শ্রমিকদের। বেতন দুই থেকে আড়াই হাজার রিঙ্গিত। যেহেতু কম্পিউটার সংযোজনের কারখানা, তাই দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। বাংলাদেশি শ্রমিক এ কারখানায় আছে, তবে সংখ্যায় খুব কম। কিন্তু পেনাংয়ে মালয়ি, চীনা, তামিলদের পাশাপাশি বাংলাদেশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমিকদের সংখ্যা অনেক। বাতু ফিরিঙ্গি সমুদ্রসৈকতে দেখা হলো হাবিবুর রহমান নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। বাড়ি সিরাজগঞ্জ। সৈকতে ঢোকার মুখের রাস্তার ফুটপাতেই তাঁর দোকান। আছেন ১০ বছর। জানালেন, শুধু পেনাংয়ে দুই লাখের মতো বাংলাদেশি বসবাস করেন। এখানে যা আয় হয় তাতে তাঁর ভালোই চলে যায়। পেনাংয়ে জীবনযাপনের খরচ তুলনামূলক অনেক কম। একই তথ্য মিলল পেনাংয়ের জমজমাট এলাকা জর্জটাউনেও। রাতে জেগে ওঠে জর্জটাউন। এখানকার মূল আকর্ষণ খানাপিনা। আর ৩১ ডিসেম্বর রাতে তো ফুড কোর্টে উপচে পড়া ভিড়। প্রতিটি খাবারের দোকানেই, তা সেটি জাপানি হোক আর কোরীয় হোক—কাজ করছেন বাংলাদেশি শ্রমিকেরা। মুন্সিগঞ্জের বেলায়েত জানালেন, ‘আমরা দ্রুতই এদের রান্নাগুলো শিখে ফেলতে পারি। তাই কাজও জোটে দ্রুত।’ কুয়ালালামপুর তো বটেই, বিনোদনের অভাব নেই পেনাংয়েও। পর্যটকদের টানার সব উপাদানই আছে। নাইট ক্লাব, ম্যাসাজ পারলার তো আছেই। আছে প্রাপ্তবয়ষ্ক বিনোদনও। তবে আইন আছে, ম্যাসাজ পারলারে কোনো মুসলিম যেতে পারবে না। সেই আইন ভঙ্গের রাস্তাও আছে।
১ থেকে ৪ জানুয়ারি ছিলাম কুয়ালালামপুরে। সহযাত্রী কমপিউটার বিচিত্রার লেনিন ভাই। আর আমাদের গাইড অনুজপ্রতীম শেখ মামুন। কুয়ালালামপুরের ব্যস্ত এলাকা বুন্তিক বিতানে আমরা ঘুরছি ২ জানুয়ারি সন্ধ্যায়। রাস্তায় পুলিশের টহল দেখা গেল। মামুন বলল, ‘আজ এরা ঝামেলা করবে’। মানে টাকা সংগ্রহ করবে। বলতে বলতেই দেখলাম চীনা এক লোক তাঁর গাড়ি উল্টো দিক দিয়ে এক গলিতে ঢোকাচ্ছেন। পুলিশ গাড়ি আটকাল। দুই মিনিট পর চালক-পুলিশের করমর্দন। রিঙ্গিত গুঁজে দেওয়া হলো পুলিশের হাতে।
আমি মামুনের দিকে তাকাই। সে বলে, ‘এখানে পুলিশ বাকিতেও ঘুষ খায়।’ আঁতকে উঠে লেনিন ভাই জিজ্ঞেস করেন, ‘মানে?’ আরেক প্রবাসী আবদুল্লাহ আল রাশেদ জানান, বাংলাদেশ থেকে যাঁরা কাজের জন্য মালয়েশিয়ায় আসেন, তাঁদের অনেকেরই কাগজপত্র ঠিক থাকে না। বিমানবন্দরেই পুলিশ তাঁদের কাছে ঘুষ চান। সে সময় টাকাপয়সা কম থাকে। যা থাকে তা নিয়ে পুলিশ বলে, ‘বাকি টাকা বেতন পাওয়ার পর দিবি।’ পরে ওদের খুঁজে পাবে কই? মামুন জানায় ও তো ভুলে যায়, কিন্তু পুলিশ ভোলে না। ও বেতনের টাকা নিয়ে অফিস বা কাজের জায়গা থেকে বের হয়ে দেখে সামনে পুলিশ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। পুলিশ তখন ওর কাছ থেকে প্রতিশ্রুত ঘুষের বাকি টাকা নিয়ে নেয়।
চমকে উঠি। প্রবাসীরা জানায়, মালয়েশিয়া খুবই দুর্নীতিগ্রস্ত একটা দেশ। তবে এরা অবৈধভাবে যে অর্থ কামায় সেটা দেশেই বিনিয়োগ করে বা দেশের ব্যাংকে রাখে। বাংলাদেশের মতো বিদেশি ব্যাংকে টাকা রাখে না। ‘জানেন, বাংলাদেশের কতজন রাজনীতিবিদের ফ্ল্যাট আছে এখানে? অনেক।’
মারদেকা স্কয়ারে যাওয়া হলো একদিন। মারদেকা শব্দটা শুনলেই মনে পড়ে মারদেকা কাপ ফুটবলের কথা। মসজিদ জামেকের (মসজিদ ইন্ডিয়া নামেও পরিচিত) কাছেই এই মারদেকা চত্বর। অনেক উঁচুতে উড়ছে জাতীয় পতাকা। ‘ওয়ার্ল্ড আন্ডার ওয়ান রুফ—ওয়ান মালয়েশিয়া’ মনুমেন্ট এখানে। স্কয়ারের পাশের প্রশস্ত রাস্তা বন্ধ করে চলছে ‘ভিজিট মালয়েশিয়া ২০১৪’ প্রচারণার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মহড়া। এরাও রাস্তা বন্ধ করে? সরকার বা বিরোধী দলের দরকার পড়লে রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ বা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ছাত্র ভিসায় আসা সাইফ বলল, এখানে থার্টি ফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠান হয় প্রতিবছর। কিন্তু এবার হয়নি। কেন? ‘সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে মারামারি লেগে গিয়েছিল। তাই অনুষ্ঠান স্থগিত।’
আমাদের যা যা নেতিবাচক সেসবের অনেক কিছুই তো আছে দেখছি মালয়েশিয়ায়। তবে আমরা কেন পারি না? একই রকম অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে শুরু করেও ওদের তুলনায় উন্নয়নে আমরা কেন পিছিয়ে?
বেশ কয়েকজন প্রবাসী জানালেন, এখানে নাগরিক সেবা অনেক উন্নত। পর্যটনবান্ধব দেশ। নিজেদের মেলে ধরতে পেরেছে সারা বিশ্বের কাছে।
কুয়ালালামপুর থেকে বেশ অনেকটা দূরে থাকেন নিভেল পারভেজ। দেখা করতে এসে বললেন, ‘দেশে ফিরি না সাত বছর। নিজের কাজ গুছিয়ে স্থিতিশীল একটা অবস্থায় এসেছি। কয়েক মাস হলো দেশে যাব যাব ভাবছি। কিন্তু অবরোধ-হরতালের মধ্যে গিয়ে কী করব?’ অবশেষে এ মাসে আসার জন্য টিকিট কিনেছেন। তবে চিন্তায় আছেন, দেশে ফিরে কি দিনাজপুরে তাঁর বাড়িতে যেতে পারবেন নাকি ঢাকাতেই বন্দী হয়ে থাকতে হবে?

পল্লব মোহাইমেন: সাংবাদিক।
[email protected]