দক্ষিণ কোরিয়ায় গণতন্ত্রের জয়

দক্ষিণ কোরিয়ার সোমবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দেশটির গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রায় আরও এক ধাপ সাফল্যের প্রমাণ আন্তর্জাতিক সমাজের সামনে তুলে ধরছে। দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্র বাংলাদেশের প্রায় সমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও জনগণের ম্যান্ডেট লাভের সঙ্গে জড়িত দায়-দায়িত্বের বেলায় দেশটি যে আমাদের অনেকটাই পেছনে ফেলে দিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন ঘটনা এর শক্ত প্রমাণ নিয়ে উপস্থিত।

চলতি বছর নির্বাচিত একজন প্রেসিডেন্টকে বিদায় নিতে হয়েছে পেছনের দরজার ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে নয়, বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ঠিক করে নেওয়া পদক্ষেপ অনুসরণ করে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে। পাশাপাশি গত শতকের প্রায় অর্ধেক সময়জুড়ে যে দেশটিতে দাপটে রাজত্ব করে গেছে সামরিক আমলাতন্ত্র, সম্প্রতি দেশের কঠিন অবস্থা পার করে যাওয়ার সময় সেই একই গোষ্ঠীর মুখ থেকে এ রকম কোনো কথা শোনা যায়নি যে তারাই হচ্ছে সবচেয়ে সংগঠিত শক্তি হিসেবে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের নিয়ামক শক্তি, যেমনটা আমরা শুনে আসছি আমাদেরই দক্ষিণ এশিয়ার এক ‘গণতান্ত্রিক’ প্রতিবেশী দেশের সমরনায়কদের মুখে। উল্টোভাবে বরং নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়ে যাওয়ার ঠিক পরপর দেশের সামরিক বাহিনীর প্রধান নতুন প্রেসিডেন্টের দপ্তরে উপস্থিত হয়ে শুধু নিরাপত্তা পরিস্থিতির ব্যাখ্যা তাঁর সামনে তুলে ধরেছেন।

অন্যদিকে আবার গণতন্ত্র হচ্ছে সমষ্টির শাসন এবং নির্বাচনে পরাজিত বিভিন্ন পক্ষও যে সমষ্টিগত সেই হিসাবের অন্তর্ভুক্ত, দক্ষিণ কোরিয়ার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনও কিন্তু বিজয়ের সূচনালগ্নে ভুলে যাননি গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয়টি। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের প্রথম মুহূর্তে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল পরাজিত প্রার্থীদের দপ্তরে নিজে উপস্থিত হয়ে আগামী দিনগুলোতে রাষ্ট্রশাসন প্রক্রিয়ায় তাঁদের সহযোগিতা কামনা করা। যে সত্য তিনি ভুলে যাননি তা হলো সংখ্যাগত হিসাবে দেশের নাগরিকদের মধ্যে যতজন তাঁর পক্ষে ভোট দিয়েছেন, বিপক্ষের সম্মিলিত ভোট হচ্ছে এর চেয়ে বেশি। ফলে তাঁদের সবাইকে গণনার মধ্যে রাখলে আগামী পাঁচ বছরে তাঁর নিজের প্রশাসনকেই তা আরও শক্তিশালী করে তুলবে।

এসব কিছুর বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও যেসব বার্তা প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন পৌঁছে দিচ্ছেন, সেগুলোও গণতন্ত্রের বিজয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার আজন্ম শত্রু হিসেবে যে দেশটির নাম বিশ্বের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম নিয়মিতভাবে আমাদের সামনে বলে যাচ্ছে, সেই উত্তর কোরিয়া বিষয়েও খুবই যুক্তিসংগত বক্তব্য তিনি দিয়েছেন, যে বক্তব্য অন্যদিকে আবার তাঁর নির্বাচনী প্রচারের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তিনি উল্লেখ করেছেন, প্রয়োজন হলে উপযুক্ত সময় ও পরিবেশে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে মিলিত হতে তিনি প্রস্তুত আছেন। অর্থাৎ যুদ্ধ–উন্মাদনার বাগাড়ম্বর থেকে দেশকে তিনি অনেকটাই এই এক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সরিয়ে এনেছেন।

তবে সেই পথে কতটা তিনি অগ্রসর হতে পারবেন তার অনেকটাই নির্ভর করবে উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে কী রকম সাড়া তিনি পাবেন এবং সেই সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘বরাবরের মিত্র’ যুক্তরাষ্ট্র নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য নিজের ভাবনাচিন্তা অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ কতটা করে দেবে, গুরুত্বপূর্ণ সেসব বিষয়ের ওপর। ওয়াশিংটন যে জলপাই পল্লব উত্তরের দিকে তুলে ধরার এতটা দ্রুত পদক্ষেপে সন্তুষ্ট হতে পারছে না, তারও ইঙ্গিত ইতিমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে ওয়াশিংটনের বিলম্বিত প্রতিক্রিয়ার মধ্যে। দক্ষিণ কোরিয়ার ভূখণ্ডে অগ্রসর থাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আন্তরিকভাবে আলোচনা চালানোর উল্লেখ নতুন প্রেসিডেন্ট তাঁর প্রথম ভাষণে করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এখনো কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ওয়াশিংটন সম্ভবত ভবিষ্যতে ঘোষিত হতে যাওয়া নীতিগত অবস্থানের অপেক্ষায় আছে।

অন্যদিকে চীন ও জাপান উভয় দেশের নেতারা নতুন প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানালেও স্বাগত অভিনন্দনের ভাষা ছিল ভিন্ন। জাপান যেমন নতুন প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি আভাস দিয়েছে যে টোকিও আশা করছে দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন নির্বাচিত নেতা ২০১৫ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির শর্তাবলি মেনে চলবেন। দক্ষিণ কোরিয়ার পূর্ববর্তী প্রশাসন যুদ্ধকালে যৌনদাসী সমস্যা সমাধান করে নেওয়ার সেই চুক্তি স্বাক্ষর করলেও দেশের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে চুক্তিটি নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল এবং প্রেসিডেন্ট মুন নির্বাচনী প্রচারকালে চুক্তির শর্তাবলি নতুনভাবে নির্ধারণ করে নিতে জাপানের সঙ্গে পুনরায় আলোচনা শুরুর অঙ্গীকার করেছিলেন। ফলে নতুন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতেই অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি চুক্তি মেনে চলার দাবি টোকিওর উত্থাপন করা স্পষ্টতই জাপানের অসন্তুষ্টির ইঙ্গিত দিচ্ছে। অন্যদিকে চীন সরাসরি উল্লেখ না করলেও আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে যে বেইজিং থাড মোতায়েন নিয়ে ইতিবাচক অগ্রগতির আশায় আছে। প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় থাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েন নিয়ে চীন শুরু থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিল এবং নির্বাচনের ফলাফলকে চীনা নেতৃত্ব অনুকূল হিসেবেই দেখছে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনের এ রকম বহুবিধ এবং বিপরীতমুখী প্রত্যাশার পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ যে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে তা হলো, রাজনীতিতে বাণিজ্যের জগতের প্রভুদের অনাহূত হস্তক্ষেপের অবসানে দেওয়া প্রতিশ্রুতি নতুন প্রেসিডেন্ট পূরণ করবেন এবং দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ একটি প্রশাসন তিনি উপহার দেবেন। বলা যায় নতুন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে প্রত্যাশার কোনো কমতি দেশে এবং বিদেশে নেই। গণতন্ত্রের বিজয় পতাকা আরও একটু ঊর্ধ্বে তুলে ধরে সবার প্রত্যাশা তিনি নিশ্চিতভাবেই অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে কঠিন পথে এখন থেকে তাঁকে যে হাঁটতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সময় এবং পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে থাকুক—এটুকুই শুধু বিজয়ের এই মুহূর্তে আমরা কামনা করতে পারি।

মনজুরুল হক: শিক্ষক  সাংবাদিক