আওয়ামী লীগের সামনে দুই চ্যালেঞ্জ

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

দশম জাতীয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তার জের কাটিয়ে ওঠার মতো যথেষ্ট যুক্তি বা অনুকূল পরিস্থিতি পাবে কি আওয়ামী লীগ? এই অভিযোগের বোঝা নিয়ে কত দিন চলতে পারবে ওরা? এটা ক্ষমতাসীন দলের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, পরবর্তী নির্বাচনের কী দশা হবে। কবে হবে, সেটা না হয় বাদই দিলাম। যখনই হোক, এমনকি যদি পাঁচ বছর পরেও হয়, তাহলেও কি বিএনপিকে নির্বাচনে আনা যাবে? বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলতে গেলে সাফ না করে দিয়েছেন। তিনি ‘প্রহসনের’ নির্বাচন বাতিল, সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে সবার অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে আরও কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেছেন। নির্বাচন-পরবর্তী নতুন সরকারকে ‘অবৈধ’ আখ্যায়িত করে তিনি কোনো রকম সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আমরা প্রথমে আলোচনা করব। এটা ঠিক যে দেশের ভেতর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট, বিশেষভাবে জামায়াতের সহিংস বিরোধিতা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সরকারের বিরোধিতা ততটা তীব্র নয়, যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা অন্যান্য দেশ নির্বাচনকে বাতিল করেনি বা অবৈধ বলে মনে করে না। কিন্তু স্বল্পসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিতে ওরা উদ্বেগ প্রকাশ করে ভবিষ্যতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় আসার তাগিদ দিয়েছে। ভারতের অবস্থান কিছুটা ভিন্ন। তারা মনে করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব গতিতেই চলতে দেওয়া উচিত।
এ পরিস্থিতি মনে রেখেই আওয়ামী লীগকে অগ্রসর হতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনোত্তর যেকোনো সন্ত্রাস ও সহিংসতা কঠোরভাবে দমনের ঘোষণা দিয়ে সঠিকভাবেই সরকারের কাজের অগ্রাধিকার স্থির করেছেন। বিরোধী দল বাছবিচারহীনভাবে হরতাল-অবরোধ ডেকে চলেছে আর জামায়াত-শিবির পেট্রলবোমা-ককটেল ছুড়ে মানুষ মারছে। জানমালের নিরাপত্তা বিধান যেকোনো সরকারের প্রথম কাজ। এটা তাদের করতেই হবে। কিন্তু কীভাবে? শুধু পুলিশি ব্যবস্থায়?
এখানে সরকারকে জন-আস্থা অর্জনে গুরুত্ব দিতে হবে। এর কিছু উপায় আছে। সরকার যে ভালো কিছু করতে চায় সেটা বোঝানোর একটি উপায় হলো নিজে ভালো কিছু করে মানুষের মনে আশা জাগানো। যেমন, হলফনামা অনুযায়ী সরকারের অনেক মন্ত্রী-সাংসদের বিরুদ্ধে শত গুণ, হাজার গুণ বেশি সম্পদ আহরণের যে অভিযোগ উঠেছে, তার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেওয়ার কথা বলেছেন। তাহলে তিনি এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের সামনে উদাহরণ স্থাপন করতে পারেন।
যেমন, বিষয়টা ‘যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনিই মোকাবিলা করবেন’ ধরনের হালকা কথায় শেষ না করে দেশের বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তিকে নিয়ে একটি কমিটি গঠনের আদেশ দিয়ে তিনি যদি বলতেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিন্দুমাত্র সত্যতা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে তাঁর নতুন সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে, তাহলে আরও ভালো হতো। অন্তত ১৫-২০ জনের বিরুদ্ধে এখনই তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে তিনি যে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবেন না, তার বাস্তব প্রমাণ মানুষ পাবে কীভাবে? মানুষ তো সবই জানে। বিগত পাঁচ বছরে ক্ষমতাসীনদের কয়েকজন কত সম্পদ বানিয়েছেন, তা জানার জন্য খবরের কাগজ পড়ার দরকার হয় কি?
জামায়াত-শিবির আগুন দিয়ে, বাস-ট্রাক পুড়িয়ে, গাছপালা কেটে অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। এই ক্ষতি সামাল দেওয়ার জন্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা তো নিশ্চয়ই নেওয়া হবে। কিন্তু এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী যদি বলেন, তিনি ও তাঁর সরকার সমস্ত বিলাসিতা ত্যাগ করে দেশের সম্পদ সাশ্রয়ের উদ্যোগ নেবেন, তাহলে ভালো হয়।
মন্ত্রীদের সব বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ি বাদ দিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যদের মতো মধ্যম মানের গাড়ি ও বাড়ি ব্যবহারের আহ্বান জানাতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি নিজেও মোটামুটি মানের একটা গাড়ি নেন না কেন? যদি তিনি তা করেন, অন্যরাও তা করবেন। কৃচ্ছ্রসাধনের কাজটি ওপর থেকে শুরু করলে আর কারও কোনো কথা থাকে না।
জানি অনেক আপত্তি উঠবে। উঠবে নিরাপত্তার প্রশ্ন। সবই মানলাম। কিন্তু তার পরও কি কিছু করা যায় না? ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দৈনন্দিন জীবনাচারের একটা বিবরণী চোখের সামনে রাখলে হয়তো অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী আগে থাকতেন ‘১০ ফুট বাই ১০ ফুট’ ঘরে। এখন সেটা না হয় ৩০ ফুট বাই ৩০ ফুটই হবে। তার বেশি কী?
সবাই হয়তো বলবেন, এসব আজগুবি কথা। কিন্তু দেশের নেতা যদি ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তাতে খারাপ কী? প্রধানমন্ত্রী তো সব সময় সাদাসিধা জীবন যাপন করেন। তাঁর তেমন কোনো বিলাসিতাও নেই। জাঁকজমকও পছন্দ করেন না। তাঁর পক্ষে এ ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপন কোনো লোক দেখানো ব্যাপার হবে না, বা এর আন্তরিকতা নিয়েও কেউ প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাবে না।
এরপর প্রধানমন্ত্রী বিগত দিনে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতাদের ধরেন। হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, রানা প্লাজা ধসের পেছনে দায়ীদের ধরেন, যেভাবে বিশ্বজিৎ হত্যার আসামিদের ধরেছেন, ঠিক সেভাবেই বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির মূল হোতাদের ধরেন।
এরপর সরকার জামায়াত-শিবিরের নাশকতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলে দেশের মানুষ ভরসা পাবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার ও রায় কার্যকর করে এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটানো দরকার। আমরা যেন বলতে পারি, একাত্তরের অভিযুক্ত মানবতাবিরোধীদের যথাসম্ভব বিচার করেছি, এখন আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব।
এবার দেখা যাক পরবর্তী নির্বাচনের প্রশ্ন কীভাবে মীমাংসা করা যায়। সমঝোতার জন্য সরকারের দিক থেকে একটি সুস্পষ্ট প্রস্তাব দেওয়া দরকার। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া গত ২৪ ডিসেম্বর ভাষণে বলেছিলেন, ‘পলিটিক্স ইজ দ্য আর্ট অব কম্প্রোমাইজ’ (রাজনীতি হলো আপসের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কৌশল)। বিগত শতাব্দীতে রুশ বিপ্লবের নেতা লেনিনও এ কথা বলেছিলেন এবং ওই নীতি অবলম্বন করে সফল রাজনীতি করেছেন। এটা মানতে হলে বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উভয়কেই ছাড় দিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।
এর প্রধান বিষয় হবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। আওয়ামী লীগের শর্ত মানলে ওই সরকারকে হতে হবে নির্বাচিত। আর বিএনপির শর্ত মানলে তাকে হতে হবে নির্দলীয়। এই দুই শর্ত পূরণ করে, এমন সমাধান খুবই সম্ভব। যেমন, সংসদে স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি দল থেকে পদত্যাগ করবেন। পরবর্তী নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হবেন সেই স্পিকার, যিনি নির্দলীয়। তিনি সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করবেন। এই সরকারের প্রধান কাজ হবে দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা করা, ইত্যাদি। এই সরকারপ্রধান নিজে নির্বাচন করবেন না। তবে, তিনি যদি নির্বাচনে দাঁড়ানোর সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে চান, তাহলে বিধান করতে হবে যে স্পিকারের এলাকায় অন্য কোনো প্রার্থী থাকবে না, তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন। এটা নির্বাচনকালীন সরকারের একটি মডেল হতে পারে।
এ ধরনের, একটি স্থায়ী সমাধান বের করাই হবে আওয়ামী লীগের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
এ জন্য সরকার বিএনপির সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেবে আর একই সঙ্গে বিএনপি হরতাল-অবরোধ ও সহিংস আন্দোলন আগামী বেশ কিছুকালের জন্য ত্যাগ করবে।
দেশের জন্য ভালো কিছু যদি করতে হয়, তাহলে এভাবেই চিন্তা করতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
[email protected]