নীরবতা ভাঙাই বড় লড়াই

এক শ্রমজীবী বাবা তাঁর শিশুমেয়েটির ওপর পাড়ার ক্ষমতাবান ছেলেদের লোভী চোখ দেখে দিশেহারা হয়ে পড়েন, তাদের আগ্রাসী ভাবভঙ্গিতে সারা রাত দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারেন না। পরের দিন সকালে মেয়ের হাত ধরে তিনি যখন বাইরে যাচ্ছেন, তখন মেয়ের মা তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কই যান?’ বাবা বলেন, ‘মেয়েরে নিয়াই সব চিন্তা। কইতে পারি না কী করাম।’ তারপর তিনি রেলস্টেশনে যান। লোকে তাঁকে রেললাইন ধরে উদ্‌ভ্রান্তভাবে হাঁটাহাঁটি করতে দেখে। তারপর ট্রেন যখন কাছে আসে, মেয়েকে রেললাইনে ছুড়ে ফেলে সেই বাবা নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়েন। দুজনের এই মৃত্যু বিষয়ে পরে ওই মা কাঁদতে কাঁদতে জানান, ‘এই দুনিয়াতে বিচার নাই। আমার সরল মানুষ, তাই আল্লাহর কাছে বিচার দিত গেছে।’
বয়স, ধর্ম, ভাষা, জাতি, পরিচয়, পেশা, যা-ই হোক, নারীর রক্ষা নেই। ঘরে, বাইরে, পথে, কর্মস্থলে, বাসে, যেখানেই হোক, ভয়, সংকোচ, নিরাপত্তাহীনতার বোধ তার সঙ্গে সঙ্গেই চলে। কতিপয় পুরুষের জন্যই নারীর এই অবস্থা। এটাই আবার নারীর স্বজন পুরুষ, পিতা, ভাই, পুত্র, সঙ্গী, বন্ধুদের জীবনকে বিভীষিকাময় করে তোলে। যে সমাজে নারী নিরাপত্তা পায় না, সে সমাজে পুরুষও নিরাপদে স্বস্তিতে থাকতে পারে না।
সোনা চোরাচালানি ও খুনি বলে নিজেকে পরিচয় দেওয়া দুর্বৃত্ত অস্ত্র হাতে হুমকি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীকে বলে, সে ধর্ষণ করলে প্রশাসন তার কিছুই করতে পারবে না। এই ক্ষমতার বোধ, সমাজে বিত্ত উপার্জনের চোরাই পথ, রাজনীতির সন্ত্রাসী শক্তি ধর্ষণকাজকে স্বাভাবিক বলে মনে করে। আর যারা নিপীড়িত-সমাজ, তাদের মুখ লুকাতে বলে, মরে যেতে বলে। তার বিরুদ্ধে পুরুষতান্ত্রিক অভিযোগ তার পোশাক নিয়ে, তার শরীর, তার চলাফেরা নিয়ে।
একজন পুরুষ যে পোশাকই গায়ে দিক, দিনরাতের যেকোনো সময় সে রাস্তায় বের হোক, সে জন্য তার ওপর চড়াও হওয়ার, নির্যাতন করার অধিকার নারী-পুরুষ, পুলিশ, র‌্যাব, কারও নেই। একই কারণে কোনো নারীর পোশাক যা-ই থাকুক, দিনরাত যেকোনো সময়েই দরকারে বা অদরকারে সে ঘরের বার হোক কিংবা ঘরে বা যেখানেই থাকুক, কোনো অজুহাতে তার ওপর চড়াও হওয়ার, যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের যুক্তি বা অধিকার কারও তৈরি হয় না। পোশাক বা স্থান বা ‘চরিত্র’ নিয়ে কথা বানিয়ে যারা ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের পক্ষে যুক্তি সাজায়, বুঝে হোক বা না বুঝে, তারা আসলে নিপীড়ক ধর্ষকের শক্তিই বৃদ্ধি করে, নতুন নিপীড়ক ধর্ষক তৈরি করে। সমাজে নিপীড়নের পক্ষে এসব লোক থাকে বলেই নিপীড়নকারীরা টিকে থাকে। পুলিশের ভূমিকা রাষ্ট্রের নিপীড়ক-ধর্ষক পক্ষপাতের বহিঃপ্রকাশ, কারণ এরা ক্ষমতারই সম্প্রসারণ। এসবের বিরুদ্ধে ঘরে-বাইরে প্রতিবাদ প্রতিরোধ না ছড়ালে পথে, উৎসবে, কাজে, শিক্ষাঙ্গনে, বাসে, ঘরে, কোথাও নারী নিরাপদে মানসিক চাপমুক্ত হয়ে চলাফেরা করতে পারবে না।

নিপীড়নের জগতে নীরবতা ভাঙাই একটা বড় কাজ। মানুষের নীরবতা আর নিষ্ক্রিয়তাই দুর্বৃত্তদের রক্ষা করে, মুখোশ অটুট রাখে। নানা মাত্রায় যৌন হয়রানি, নিপীড়ন, এমনকি ধর্ষণের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার পরও ভুল সামাজিক মূল্যবোধ, লজ্জা আর অনুশাসনের কারণে বহুজন নিজের ভেতর যন্ত্রণা বহন করতে থাকেন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বা সে কাজে সমষ্টিকে যুক্ত করতে পারেন না। এসব ভুল ‘মানসম্মান’ অস্বীকার করে সর্বশেষ যাঁরা নীরবতা ভেঙেছেন, তাঁদের কারণেই সমাজ চিনছে আপন জুয়েলার্স, রেইনট্রি হোটেল, বনানী থানার দুর্বৃত্ত পালন কারখানা; মুখোশ খুলছে শয়তানদের। নীরবতা ভাঙতে গিয়ে এই নারীরা ঝুঁকি নিয়েছে, কিন্তু শক্তি জুগিয়েছে আরও বহুজনকে। তাদের সালাম জানাই। জানি তাদের জন্য আরও অনেক আক্রমণ অপেক্ষা করে আছে। মামলা, সাক্ষ্য, শুনানি, সবই একেকটি নির্যাতনপর্ব। তারপরও বলব, শুধু নিজেদের জন্যই নয়, আরও বহুজনের স্বার্থে এই নীরবতা ভাঙার জোয়ার তৈরি হলে ধর্ষক-নিপীড়ক-জালেমদের পালানোর পথ থাকবে না।