বিএনপির ভিশন নিয়ে বিতর্ক ও কুতর্ক

কিন্তু ভিশনটি নিয়ে ইতিমধ্যে কিছু কুতর্কও শুরু হয়েছে। যেমন ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এটিকে নকল, এমনকি আওয়ামী লীগের ‘রূপকল্প ২০২১’ থেকে ‘নির্লজ্জ চুরি’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তারা বিএনপির বিরুদ্ধে তামাশা ও প্রতারণার অভিযোগও তুলেছে।

আসলেই কি বিএনপির ভিশন নকল? কী ছিল আওয়ামী লীগের রূপকল্পে?

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ‘দিনবদলের সনদ’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৮টি বিষয়ে ১৫ দফার ‘সংকট মোচনে ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে’র লক্ষ্যে একটি রূপকল্প ঘোষণা করা হয়। এতে ৮টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল: ১. তত্ত্বাবধায়ক সরকার, গণতন্ত্র ও কার্যকর সংসদ; ২. রাজনৈতিক কাঠামো, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও গণ-অংশায়ন; ৩. সুশাসনের জন্য আইনের শাসন ও দলীয়করণ প্রতিরোধ; ৪. রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন; ৫. দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন; ৬. নারীর ক্ষমতায়ন ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা; ৭. অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উদ্যোগ; এবং ৮. বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার, গণতন্ত্র ও কার্যকর সংসদ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়: ‘একটি নির্ভরযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা, নিয়মিত নির্বাচন, সরকারের জবাবদিহি, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হবে। সংসদকে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’

এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যতীত অন্য প্রায় সব ক্ষেত্রেই মহাজোট সরকার গত প্রায় নয় বছরে তেমন কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে আমরা যেন বিপরীত দিকে যাচ্ছি। বস্তুত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে জলাঞ্জলি দেওয়ার যুক্তি হিসেবে মহাজোট সরকার ‘উন্নয়ন বনাম গণতন্ত্রে’র এক আত্মঘাতী বিতর্কের সূচনা করেছে।

বিএনপির রূপকল্পেও গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার তথা শাসনকাঠামোতে আমূল পরিবর্তন, কার্যকর সংসদ, বিকেন্দ্রীকরণ, দুর্নীতি দূরীকরণ ও নারীর ক্ষমতায়নের কথা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপরও বিএনপির রূপকল্পে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপির রূপকল্পে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, সংসদের উচ্চকক্ষ স্থাপন ও গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার করা হয়েছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রূপকল্পে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। তাই বলে কি বিএনপিকে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায়?

গণতন্ত্র, সুশাসন, বিকেন্দ্রীকরণ, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির ধারণা আওয়ামী লীগ উদ্ভাবন করেনি। এগুলো বহু শতাব্দীর অভিজ্ঞতার আলোকে পণ্ডিতেরা উদ্ভাবন করেছেন। এগুলো নিয়ে বহু দেশে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয়েছে, যার মাধ্যমে এসব ধারণা পরিশীলিত ও যুগোপযোগী হয়েছে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কারোরই এগুলোর ওপর মেধাস্বত্ব নেই। এ ছাড়া এটি সুস্পষ্ট যে বিএনপির ভিশন ২০৩০ ঘোষণার মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর করা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে সুদূরপ্রসারী সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি বহু কাঙ্ক্ষিত ঐকমত্য সৃষ্টি হলো, যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কীভাবে হলো, তার ওপর আলোকপাত করা যাক।

বহুদিন থেকেই বাম রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের দাবি করে আসছে। আমাদের রাজনীতি পরিশীলিত ও কলুষমুক্ত করার লক্ষ্যে অনেক চিন্তাশীল ব্যক্তিও বিভিন্ন সময়ে নানা প্রস্তাব দিয়ে আসছেন। ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) দ্য ডেইলি স্টার-এর সঙ্গে যৌথভাবে ‘পলিটিক্যাল রিফর্মস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের এক গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংস্কারের একটি নিবিড় আলোচনা শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালের ১০ এপ্রিল প্রথম আলোদ্য ডেইলি স্টার-এর সঙ্গে যৌথভাবে আরেকটি গোলটেবিল বৈঠকে সংস্কারের প্রস্তাবগুলো আরও সুস্পষ্ট করা হয়। পরবর্তী সময়ে সুজন-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত স্বেচ্ছাব্রতীদের উদ্যোগে সারা দেশে অনেক আলাপ-আলোচনা, গোলটেবিল বৈঠক ও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই নিবন্ধের লেখকও প্রস্তাবগুলো নিয়ে সংবাদপত্রে অনেক লেখালেখি করেন। ২০০৭ সালে আমাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলোর ভিত্তিতে আরপিওর একটি খসড়া তৈরি করে আমরা হুদা কমিশনের কাছে প্রদান করি, যার প্রায় সবগুলোই আইনে পরিণত হয়েছে।

সংস্কার প্রস্তাবগুলো এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় মাইলফলক ছিল ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে ১৪ দলের পক্ষ থেকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের রূপরেখা’ উপস্থাপন। এ অভিন্ন রূপরেখায় ‘নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে’ পরিণত করার লক্ষ্যে ১৫টি সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। একই সঙ্গে নির্বাচনী আইন ও বিধিবিধানের সংস্কারের লক্ষ্যে ১১টি শিরোনামে আরও ৩০টি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এই প্রস্তাবগুলো পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা সংসদেও উত্থাপন করেন। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এসব প্রস্তাবের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেননি।

এরপর ২০০৫ সালের ২২ নভেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় ১৪ দলের পক্ষ থেকে ‘একটি অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি’ ঘোষণা করা হয়। এতে বলা হয়: ‘১৫ জুলাই, ২০০৫ ঘোষিত অভিন্ন রূপরেখার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কারসহ কালোটাকা, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা হবে এবং তার মধ্য দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে।’

সংস্কার আলোচনার ক্ষেত্রে আরেকটি মাইলফলক ছিল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), প্রথম আলোদ্য ডেইলি স্টার-এর যৌথ উদ্যোগে ২০০৬ সালের ২০ মার্চ ‘জবাবদিহিমূলক উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সুশীল সমাজের উদ্যোগ’ শীর্ষক আলোচনা ও পরবর্তী সময়ে নাগরিক কমিটি গঠন। এই কমিটির উদ্যোগে ও চ্যানেল আইয়ের সহযোগিতায় সারা দেশে ১৫টি নাগরিক সংলাপের আয়োজন করা হয় এবং এর মাধ্যমে সংস্কার বিষয়ে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি হয়।

এ পর্যায়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সর্বস্তরের অনেক নাগরিক সংস্কার আলোচনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ফলে দেশব্যাপী এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে এবং রাজনৈতিক সংস্কার একটি গণদাবিতে পরিণত হয়। এটি একটি আন্দোলনে রূপ নেয়, যা অনেকেরই সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল। এরই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ তার ২০০৮ সালের দিনবদলের সনদে ‘রূপকল্প ২০২১’ উপস্থাপন করে, যদিও তখন পর্যন্ত বিএনপির এ বিষয়ে কোনো আগ্রহই ছিল না। তাই দেরিতে হলেও একটি সংস্কার প্রস্তাব জনগণের সামনে হাজির করার জন্য আমরা বিএনপিকে সাধুবাদ জানাই।

আরেকটি কারণেও আমরা বিএনপির ভিশনকে ইতিবাচকভাবে দেখছি। আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বহুদিন থেকেই পরস্পরকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। আশা করি, তারা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে যে কেউ কাউকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না; বরং অন্যকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টায় নিজেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। তারা যেন উপলব্ধি করতে পারছে যে অতীতের আত্মঘাতী পথ থেকে সরে আসতে হবে, বুদ্ধিভিত্তিক বিতর্ক শুরু করতে হবে এবং পরিবর্তনের পথে হাঁটতে হবে।

তবে বড় প্রশ্ন হলো সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার। আসলেই কি ঘোষিত ভিশনটি বিএনপির গভীর উপলব্ধির ফসল? নাকি নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার লক্ষ্যে ভোটারদের মন ভোলানোর জন্য একটি ঘুমপাড়ানি গান মাত্র। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আশাবাদী হওয়া এবং বিএনপিকে বিশ্বাস করা দুরূহ। শুধু বিএনপিই নয়, আমাদের দুটি প্রধান দলের ক্ষেত্রেই বিষয়টি সত্যি। অতীতে দলগুলো অনেক অঙ্গীকার করেছে, মনে হয় যেন ভঙ্গ করার জন্য; বাস্তবায়নের জন্য নয়। এ ছাড়া বিরোধী দলে থাকার সময়ই তারা রূপকল্প ঘোষণা করে থাকে।

আর বিএনপির এবং একইভাবে আওয়ামী লীগের রূপকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। সে
জন্য প্রয়োজন হবে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা। বিরাজমান সংকটের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সত্যিকারের ঐকমত্য প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রয়োজন হবে সব কুতর্কের অবসান এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন।

. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)