ফুলের দেশে ফুলের আকাল

পৃথিবীর অন্যতম উর্বর ভূখণ্ড এই বাংলাদেশে স্বাভাবিক উদ্ভিদের সংখ্যা অজস্র। সেই উদ্ভিদরাজ্যে ফুলেল বৃক্ষের সংখ্যাও অগুনতি। তাতে তৃণ থেকে মহিরুহের কমতি নেই, কিন্তু অপরিণামদর্শীদের কবলে পড়ে দেশ একেবারেই শ্রীহীন। পৃথিবীর যেকোনো দেশের রাজধানী ফুলেল বৃক্ষে শোভিত। সাধারণভাবে সেখানে দেশীয় বৃক্ষের প্রাধান্য থাকে। ব্যতিক্রম বোধ করি বাংলাদেশ। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করার পর কোনো বিদেশির বাংলাদেশি ফুলের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সম্ভাবনা কম। তারপরও বহু বছরে অভিযোজিত যেসব বৃক্ষকে আমরা সাদরে আপন করে নিয়েছি, সেসবের মধ্যে মাদাগাস্কার থেকে আসা কৃষ্ণচূড়া ছাড়া অন্য বৃক্ষের বিরল উপস্থিতি এটুকু জানান দেয়, এ বঙ্গ পুষ্পবৃক্ষে যেন নিতান্ত রিক্ত!
সেদিন পত্রিকায় দেখলাম, বিমানবন্দর সড়কজুড়ে অনেক পয়সা খরচ করে বিদেশ থেকে আনা বনসাই লাগানো হচ্ছে। কিছুদিন আগে প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক নিবন্ধে মোকারম হোসেন ঢাকা মহানগরের সৌন্দর্যায়ণে কিছু সমস্যার কথা আলোচনা করেছেন। যেমন পছন্দের বৃক্ষের অপ্রাপ্যতা, নার্সারিগুলোতে পছন্দের চারার মূল্য অস্বাভাবিক বেশি। আমি মনে করি, বন বিভাগ ও উদ্যান উন্নয়ন বিভাগ এগিয়ে এলে এ সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব। সিটি করপোরেশন সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানকে চারা তৈরি ও সরবরাহের দায়িত্ব দিতে পারে। রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেনও সহযোগী হতে পারে। সিটি করপোরেশনও নিজস্ব নার্সারি গড়ে তুলতে পারে। আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় থাকলে অতিরিক্ত মূল্যে প্রাইভেট নার্সারি থেকে চারা কেনার প্রয়োজন হবে না।
কিন্তু স্বল্প মূল্যে ও সহজলভ্য বৃক্ষের কি সত্যিই আকাল পড়েছে দেশে? গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সঠিক বৃক্ষ নির্বাচন। বসন্তে পল্লিবাংলা লাল শিমুলে ভরে উঠলেও নগরে তার যেন কোনো প্রবেশাধিকার নেই। নগরে পারিজাত তো ব্রাত্যই, গ্রামেও এখন এর কদর কম। শহর আলো করে তুলতে পারত অশোক। এই অসাধারণ সুন্দর উজ্জ্বল ফুল ও পল্লবশোভিত, ভেষজ তরুটিকেও আমরা নগরে লালন করতে চাই না। এককালে কুসুম ফুলে ভরে থাকত নদীবিধৌত বাংলা। এখন এর নামটিও হারিয়ে যাচ্ছে। পলাশ একে ক্ষণস্থায়ী, তাতে নগর সৌন্দর্যায়ণে তার তেমন কদর নেই, যতটা আছে কবিতায়, সাহিত্যে। প্রস্ফুটনের প্লাবন ও ঔজ্জ্বল্যে পলাশের সঙ্গে তুলনীয় এক বাসন্তিকা অপ্রিয় গন্ধি জংলি বাদাম। দ্বিজেন শর্মার ভাষায়, ‘শুধু প্রস্ফুটনের অপ্রিয় গন্ধের প্রসঙ্গ বাদ দিলে ঋজুতা, বলিষ্ঠতা ও সৌন্দর্যে ছায়ানিবিড় এই বৃক্ষটি আমাদের তরুরাজ্যের যোগ্য প্রতিনিধি।’
কাঞ্চনও কেন দুর্লভ এই মহানগরে? নানা রঙের কাঠগোলাপও কেন চোখ কাড়ে না? শীত-বসন্তে আলো ছড়ায় আফ্রিকান টিউলিপ, কিন্তু বাংলাদেশে যেন তার কারাবাস বলধা গার্ডেন আর রমনা পার্কে। কোনো বিলাসীর বাড়ির আঙিনায় হয়তো তার ঠাঁই আছে, কিন্তু নগরজীবনে এর কোনো উপস্থিতিই নেই। কলকাতা শহর আলো করে থাকে আফ্রিকান টিউলিপ। অথচ আফ্রিকান টিউলিপ যেন অচেনা মনে হয় এ দেশে। বন বিভাগ তো নয়ই, নার্সারিগুলোতেও আফ্রিকান টিউলিপ দুর্লভ।
জাকারান্ডা, নাগলিঙ্গম রাজধানীর প্রিয় তরু হবে না কেন? এর পাশে থাক বোতল ব্রাশও। আমাদের নগর সৌন্দর্যায়ণে বরফশুভ্র কুরচি কেন স্থান পাবে না? কুরচির সৌন্দর্যে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ঐশ্বর্যের ছদ্মবেশী ধূলির দুঃসহ অহংকারে/ হানিয়া মধুর হাস্য; শাখায় শাখায় উচ্ছ্বসিত/ ক্লান্তিহীন সৌন্দর্যের আত্মহারা অজর অমৃত/ করেছ নিঃশব্দে নিবেদন।’ কিন্তু না, রাজধানীসহ ছোট-বড় শহরে কুরচির সাদর রোপণ চোখে পড়ে না। নিতান্ত অবহেলায় সে জন্মে দেশের নানা প্রান্তে, থাকেও যেন অপরিচিত, বিশেষত ভদ্রসমাজে। বাংলা তো শাল-পিয়ালের দেশ। ১০ লাখ বছর আগে গঠিত বরেন্দ্র, মধুপুর, ভাওয়াল, সাভার, ময়নামতির লালমাটির আত্মজ ঋজু শালবৃক্ষ কেন নির্বাসিত থাকবে আমাদের প্রিয় রাজধানী থেকে? ফাল্গুনে নিষ্পত্র হয়ে কোমল, রোমশ সাদা দীর্ঘ মঞ্জরিতে আচ্ছন্ন হয়ে ‘সৌরভধনে তখন তুমি হে শালমঞ্জরী বসন্তে কর ধন্য।’
গ্রীষ্মে বাংলাদেশ পত্রপল্লবে সুশোভিত হয়। তপ্ত ধরণি নববর্ষায় সিক্ত হয়ে উদ্ভিদরাজ্যে নবজীবনের সঞ্চার করে। গ্রীষ্মের সবচেয়ে উজ্জ্বল পুষ্প নিঃসন্দেহে কৃষ্ণচূড়া। তার পাশেই আমাদের একান্ত দেশীয় পুষ্প জারুল আর সোনালু রাজধানীকে বর্ণিল করে তোলে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাড়া এই ত্রিরত্ন কেন রাজধানীর সর্বত্র সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়াবে না? কেরালা, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, হায়দরাবাদ যদি এই তিনের সমারোহে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে, ঢাকা পারে না কেন?
একসময় বনানী এলাকায় কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউজুড়ে হাজার হাজার অরুণাভ পত্রঘন নাগেশ্বরে ভরিয়ে তোলা হয়েছিল। চিরহরিৎ, নিশ্ছিদ্র ও ছায়ানিবিড় অপরূপ সৌন্দর্যময় এই দেশীয় তরু কী কারণে বৃক্ষ হন্তারকদের লোভ ও ক্রোধের শিকার হলো? উষ্ণায়ণ রোধে, সৌন্দর্যায়ণে কেন নাগেশ্বর আমাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে স্থান পাবে না? উষ্ণায়ণ রোধের কথাই যখন উঠল, তখন আমাদের বৃক্ষরোপণ পরিকল্পনায় কাঠবাদাম ও কদমকে অবশ্যই স্থান দিতে হবে। সেই সঙ্গে নিম, বকুলকেও। ঢাকা শহর কেন নিমের শহর হবে না? কেন আবর্জনায় ক্লিষ্ট, দুর্গন্ধময় এই শহরে প্রচুর ছাতিম থাকবে না? তেলশুর, পাদাউক প্রাধান্য পায় না কেন? মহাশিরীষ, গগনশিরীষ, হিজল, তমাল, দেবদারু, অশ্বত্থ, উদয়পদ্ম, গাব, গামারি, হরেক রকম চাঁপা, বরুণ, বুদ্ধনারকেল, মহুয়া, মুচকুন্দ, চন্দন ইত্যাদি বৃক্ষের ব্যাপক ও পরিকল্পিত রোপণ কাঙ্ক্ষিত।
তবে এখানেই শেষ নয়, এখানে প্রয়োজন অর্জুন, আমলকী, বহেড়া, খুদে জাম, টক আম, কালোজাম, ক্ষীর খেজুর, গোলাপজাম, চালতা, জলপাই, বাতাবি লেবু, আমড়া, তেঁতুলের মতো ভেষজ ও ফলদ বৃক্ষরোপণ। রাস্তার দুই পাশে গাছে গাছে শোভা পাক নানা রঙের অর্কিড, নাগানবিলাস, মধুমঞ্জরিসহ গোল্ডেন শাওয়ার, ঝুমকো লতা, হানিমুন ক্রিপার, আইভি লতা, টেকুমা ইত্যাদি। এভাবেই আমাদের প্রিয় রাজধানী সুন্দর হয়ে উঠতে পারে।
আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ, নিসর্গপ্রেমী।
[email protected]