খুনখারাবি এখন 'কমন' ব্যাপার?

১৮ মের প্রথম আলোয় খবরটি ছাপা হয়েছে। খবরটি এ রকম: রাজধানীর ইব্রাহিমপুরে রোজিনা আক্তার মিতু নামের এক গৃহবধূকে হত্যার দায়ে আহমেদ শরিফ নামের ২৭ বছর বয়সী এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শরিফ সম্পর্কে রোজিনার স্বামীর ভাগনে। অর্থাৎ রোজিনা হচ্ছেন শরিফের মামি।

গ্রেপ্তার হওয়ার পর শরিফ পুলিশকে বলেছেন, রোজিনার স্বামী, অর্থাৎ তাঁর মামা মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। সেখান থেকে মামার পাঠানো টাকা থেকে মামি তাঁকে হাতখরচ দিতেন। সম্প্রতি একটি বিষয় নিয়ে মামির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং মামি তাঁকে হাতখরচ দেওয়া কমিয়ে দেন। এসব ক্ষোভ থেকে মামিকে হত্যা করেন তিনি।

শুধু হাতখরচ কমিয়ে দেওয়ায় এই হত্যাকাণ্ড, এটুকুই আমরা এখন পর্যন্ত জানি। তা যদি হয়, ভাবি, আহা, রোজিনা কেন শরিফের হাতখরচের টাকাটা কমিয়ে দিলেন? টাকার পরিমাণ না কমালে তাঁকে আজ বেঘোরে প্রাণ হারাতে হতো না। আবার ভাবি, শরিফ তাঁর মামিকে খুন না করে তাঁর প্রয়োজনটা বুঝিয়ে বললেই পারতেন। হয়তো তাঁর মামি বিষয়টা বুঝতেন। কিন্তু এসব ভাবাভাবিতে এখন আর কিছু যায়-আসে না। তবে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। টাকা চেয়ে না পাওয়ার কারণে খুন করা হয়েছে—আমাদের দেশে এমন আরও বহু ঘটেছে।

২০১৫ সালের আগস্ট মাসের ঘটনা। রাজধানীর বংশালে খুন হন আসমা আক্তার (৫৫) নামের এক নারী। আসমার কাছে টাকা ধার চেয়ে না পেয়ে তাঁকে শ্বাসরোধে খুন করেন তাঁর ছোট ভাই।

একই বছরের মার্চ মাসের ঘটনা। কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় সিগারেট কেনার জন্য মা রোকেয়া বেগমের কাছে টাকা চান ছেলে রেজাউল। কিন্তু মা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। আর এতে ভয়ানক খেপে যান রেজাউল। রান্নাঘর থেকে বঁটি এনে মাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করেন।

গত এপ্রিল মাসের ঘটনা। কেরানীগঞ্জে তমিজ উদ্দিন নামে এক মাদকাসক্ত যুবক মাত্র ৫০০ টাকার জন্য তাঁর বাবাকে গুলি করে খুন করেন। গত বছর ফরিদপুরে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনার কথা পাঠক নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। ফারদিন হুদা নামের ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর আগুনে পুড়িয়ে বাবাকে হত্যা করে। নতুন মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় ফারদিন রাগে-ক্ষোভে উন্মত্ত হয়ে এ ঘটনা ঘটায়।

কেন এই অসহিষ্ণুতা? ব্যাপারটা এখন এমন যে আমি যা চাই, তা আমাকে পেতে হবে। সবকিছু আমার ইচ্ছানুযায়ী হবে। আর যখনই তা হবে না, তখন আমার ইচ্ছাপূরণের পথে যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাকে আমি খুন করব। তাই তুচ্ছ সব কারণেই একে অপরকে খুন করছে। খুন করা এখন আর কোনো বড় ব্যাপার নয়। যে-কেউ যে-কাউকে খুন করছে অবলীলায়। খুন করা এখন ‘কমন’ ব্যাপার।

স্বামীর হাতে স্ত্রীর খুন হওয়াটাও যেন অতি অতি ‘কমন’ বা ‘সাধারণ’ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এর বেশির ভাগই ঘটে যৌতুক চেয়ে না পেয়ে। নেশার জিনিস কেনার জন্য টাকা না পেয়ে নেশাগ্রস্ত সন্তানদের হাতে বাবা-মায়ের খুন হওয়ার ঘটনাও হরহামেশাই ঘটছে। পত্রিকার পাতায় এমন ঘটনার খবর প্রায়ই ছাপা হচ্ছে। চাঁদার টাকা না পেয়ে খুন করা বা মুক্তিপণের টাকা না পেয়ে শিশু খুনের ঘটনাও ঘটছে আকছার। এগুলো এত বেশি ঘটছে যে দু-একটি ছাড়া এসব ঘটনায় কাউকে আর তেমন বিস্মিত বা ক্ষুব্ধ হতে দেখা যায় না। অর্থাৎ কারও মনে কোনো রেখাপাত করে না। আজ শুনলে কাল ভুলে যাচ্ছি। কী ভয়ানক ব্যাপার!

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের মতে, এসব খুনের কারণ একাধিক। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক বৈষম্য, প্রযুক্তির প্রতি অনিয়ন্ত্রিত মনোনিবেশ, ধর্মের অপব্যাখ্যা, ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা, প্রতিহিংসা, মাদকের প্রভাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর উদাসীনতার কথা বলা যায়। আরও অনেক কারণ রয়েছে নৃশংসতার নেপথ্যে।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। দেশে এত খুনখারাবি হচ্ছে, লুটতরাজ হচ্ছে, নারী ধর্ষণ হচ্ছে। কয়টা ঘটনার আমরা বিচার হতে দেখি? কোনো সমাজে যদি অপরাধীদের বিচার না হয়, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেওয়া হয়, তাহলে সে সমাজে আরও অপরাধের ঘটনা ঘটবে—এটাই স্বাভাবিক। সুষ্ঠু ও কঠোর বিচারব্যবস্থাই পারে সমাজ থেকে সব ধরনের অপরাধ দূর করতে। অপরাধীদের এই বার্তা দিতে হবে, অপরাধ করলে সাজা নিশ্চিত। এ ছাড়া অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। তা না হলে সব ধরনের অপরাধই ‘কমন’ ঘটনায় পরিণত হবে।

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক