ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট নির্বাচনের নয়া মডেল

.
.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি গণতন্ত্রের সূতিকাগার হয়, তাহলে সেই সূতিকাগারে আজ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি অভাবনীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সরকার–সমর্থক ৩৫ বৈধ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র অস্বীকার করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালের আইনের কোন ধারা বলে ব্যালট পেপারে তাঁদের নাম থাকবে না, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ১০৬ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন, যাঁরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি, তাঁরা প্রত্যেকে বৈধ প্রার্থী। কিন্তু বৈধ প্রার্থীর তালিকায় ওই ৩৫ জনের নাম নেই।

১৯৭৩ সালের আইনের ২০ ধারার ৩ উপদফা বলেছে, সংবিধিতে বর্ণিত উপায়ে সিনেট সদস্যরা নির্বাচিত হবেন। আর সংবিধির (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফার্স্ট স্ট্যাটিউট) ৪৮(১) বিধি বলেছে, সিনেটের ৩৫ শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের তারিখ উপাচার্য নির্ধারণ করবেন। তবে এই সংবিধি আপনাআপনি মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের ব্যবস্থা রেখেছে। এটা কোনোভাবেই ভিসি, রিটার্নিং অফিসার বা কোনো নির্বাচন পরিচালনাকারীর মর্জির ওপর রাখা হয়নি। ৪৮ বিধির ৩ উপবিধি বলেছে, ‘উপাচার্য কর্তৃক অনুমোদিত ফরমে সিনেটের সদস্য নির্বাচনের জন্য প্রত্যেক প্রার্থী একজন শিক্ষক দ্বারা প্রস্তাবিত এবং অন্য একজন শিক্ষক দ্বারা সমর্থিত হবেন। এবং মনোনয়নকালে প্রত্যেক প্রার্থী মনোনয়নপত্রে লিখিতভাবে তাঁর সম্মতি জ্ঞাপন করবেন। একজন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র অবৈধ হবে যদি প্রার্থী তাঁর সম্মতি লিখিতভাবে না দিয়ে থাকেন।’ কিন্তু নীল দলের ৩৫ বিদ্রোহী প্রার্থী আইনে নির্দিষ্ট করে দেওয়া এই শর্ত লঙ্ঘন করেননি।

১৭ মে পত্রপত্রিকায় নীল দলের একটি প্যানেল ‘বাতিলের’ খবর ছাপা হয়েছে। ১৭ মে প্রথম আলোর শিরোনাম ছিল ‘নীল দলের একটি প্যানেল বাতিল, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সমঝোতা।’ এ খবর পড়ে হাঁড়ির খবর জানতে গিয়ে নিশ্চিত হলাম যে নীল দলের কোনো ‘প্যানেল বাতিল’ হওয়ার ঘটনাই আইনসম্মতভাবে ঘটেনি। কারণ, আইনে কাউকেই মনোনয়নপত্র বাতিল করার সুযোগ দেয়নি। একটি মাত্র শর্ত যে মনোনয়নপত্রে প্রার্থীর লিখিত সম্মতি থাকবে না, সেটাই শুধু স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘ইনভ্যালিড’ হবে। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামালের নেতৃত্বাধীন নীল প্যানেলের সবার মনোনয়নপত্র বাতিল করে দেওয়ার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে দলীয়করণ, দলদূষণ, শিক্ষকদের দলাদলি, সংঘাত নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু সেসব ঘটনা থেকে আজকের একটি আইনবহির্ভূত নির্বাচনী যজ্ঞ একেবারেই আলাদা। আজকের নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কতিপয়তন্ত্র বা অলিগার্কির একটি তমসাচ্ছন্ন পর্বের সূচনা ঘটাবে। কতিপয় ব্যক্তি মিলে ঠিক করেছেন, তাঁদের মুখের কথাই আইন হবে। তবে এর দায়দায়িত্ব প্রধানত উপাচার্যকেই নিতে হবে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক কামাল উদ্দীন বলেছেন, ‘নীল দলের আহ্বায়কের প্যানেলের শিক্ষকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্রোহী নীলদের প্রার্থিতা তিনি বাতিল করেছেন। আবার বলেছেন, নীল কাগজ ছাড়া মনোনয়নপত্রে অন্য কোনো রং ব্যবহার করতে বললেও তাঁরা তা করেননি। তাই তিনি বাতিল করেছেন। উল্লিখিত বিধি মানলে বলতে হয় যে তিনি যা করেছেন, এটা গুরুতর অন্যায়, অনৈতিক। তাঁর মন্তব্য জানতে ফোন করেছিলাম, কিন্তু কথার মাঝে লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে তিনি আর ফোন ধরেননি। বারবার মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। জানতে চেয়েছি, তিনি কোন ক্ষমতাবলে নির্বাচন করছেন। উত্তরে বলেছেন, ৪০ বছর ধরে যেভাবে চলেছে, সেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর ইঙ্গিত যদি এই হয় যে নীল দলের একটি প্যানেল হয়েছে, আগে কখনো দুটি হয়নি। তাই দুটিকে একটি করার দায় উপাচার্য ও তাঁর ওপর বর্তেছে, তাহলেও অলিগার্কির উদাহরণ তৈরি হয়। রেওয়াজ দেখিয়ে তিনি নির্দিষ্ট আইন ভাঙতে পারেন না। আর কোনটি বিশুদ্ধ নীল দলীয় প্যানেল ছিল, তা নির্ধারণের কোনো নিক্তি তাঁর এবং উপাচার্যের হাতে ছিল না। যে নাটকীয়তায় তালিকা ঝোলানো হয়েছে, সেটা একটা সিনেটীয় ক্যু। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদীয় ক্যু কথাটির প্রচলন আছে। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক সিনেটীয় ক্যু করার নজির স্থাপন করছেন।

আমরা এটা জেনে স্তম্ভিত যে নীল-দলীয় শিক্ষকদের নিয়মিত সভায় ১০ মে সর্বসম্মতক্রমে যে প্রায় ৪০ জনের নামের তালিকা চূড়ান্ত হয়েছিল, সেখানেও ক্যু করে বাতিল করে দেওয়া ৩৫–এর মধ্যে ১৪ নীল প্রার্থীর নাম ছিল। তাহলে কে বা কাদের স্বার্থে নীল দলের মধ্যে এত বড় একটা সর্বনাশা বিভাজনকে অনিবার্য করার দরকার পড়ল। সংবিধান ও সংসদ যেভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি চেনে না, কোনো দল চেনে না, সেভাবে তিয়াত্তরের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ কোনো প্যানেল বা রং চেনে না। সবাই আলাদা মানুষ। আলাদা প্রার্থী। নির্বাচন কমিশনার তফসিল দিলেন। যাঁর ইচ্ছা তিনি প্রার্থী হলেন। বৃহস্পতিবার (১১ মে) প্রার্থিতা পেশ করা হলো। রোববার (১৪ মে) ছিল প্রার্থিতা তুলে নেওয়ার শেষ দিন। চূড়ান্ত বৈধ প্রার্থীর তালিকা প্রকাশের কোনো তারিখ তফসিলে ছিল না। সাধারণত প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনে বেলা একটার পরে চূড়ান্ত তালিকা টাঙানো হয়। আশা করা হয়েছিল, রোববার এটা আসবে। কিন্তু আসেনি। ১৫ মে সোমবারও তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।

পরদিন মঙ্গলবার (১৬ মে) প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকেনীল দলের ১০ বিদ্রোহীকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানানো হলো। তাঁরা ১৪ জন যাবেন বলে স্থির করলেন। একাধিক নীল বিদ্রোহী দাবি করেছেন, গণভবনে যাওয়ার পথে তাঁদের বহনকারী গাড়িবহর যখন কলাবাগানে, তখনই তাঁরা প্রথম জানলেন ৬৯ জন প্রার্থীর তালিকা রেজিস্ট্রারের সইয়ে টাঙানো হয়েছে। সেখানে তাঁদের কারও নাম নেই। তার মানে এই ১৪ জন আগেই জেনে গিয়েছিলেন তাঁরা বাতিল হচ্ছেন। এক প্রশ্নের জবাবে রেজিস্ট্রার জানালেন, তালিকায় উপাচার্যেরও সই ছিল। তার মানে দাঁড়ায় উপাচার্যও একটি পক্ষ। তিনি একটি আইনবহির্ভূত তালিকা প্রকাশ করেছেন। সুতরাং তাঁর নৈতিকতা এখন আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি ১৯৭৩ সালের আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান যে করতে পারেননি, অন্তত এই একটি ঘটনায় তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচন শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিচ্ছিন্ন কোনো আটপৌরে নির্বাচন বলে গণ্য হওয়া উচিত নয়। এটি বাঙালি জাতির মৌলিক নৈতিক নির্বাচনী দর্প। কারণ, এটা জাতির শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় মোনায়েম খানরা হস্তক্ষেপ করতেন বলেই স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরালো হয়েছিল। ছয় দফার স্বায়ত্তশাসন ছিল দেশের জন্য। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন না পাওয়া পর্যন্ত সন্তুষ্ট হতে পারেননি। সেই স্বায়ত্তশাসন লাভের ৪৪ বছর পূর্তিতে দেশের প্রধান নির্বাহীর হস্তক্ষেপে একটি নির্বাচন হচ্ছে। কবি অধ্যাপক আবদুস সামাদ, যিনি অন্যতম নীল বিদ্রোহী তাঁর কথায়, ‘এটি আইনগতভাবে মোকাবিলা করার সুযোগ ছিল, কিন্তু মাননীয় অভিভাবকের (সরকারপ্রধানের) আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলের স্বার্থে আমরা সে পথে অগ্রসর হচ্ছি না।’ কিন্তু প্রলয় বন্ধ হয় না অন্ধ হলেই।

সিনেটের মূল কাজ হলো উপাচার্যের জন্য তিনজনের প্যানেল নির্বাচন এবং বাজেট পাস করা। একাদিক্রমে তিন মেয়াদে ভিসি থাকা যাবে না। আইন বলেছে, চার বছর মেয়াদে দুবার থাকা যাবে। আট বছরের বেশি কাউকে ভিসি রাখতে তিয়াত্তরের আইন উপাচার্যের হাত বেঁধেছে। বর্তমান ভিসি ২০০৯ সালে সম্পূর্ণ অস্থায়ীভাবে তিন মাসের মধ্যে সিনেট নির্বাচন করার শর্তে ভিসি হন। কিন্তু পরের চার বছরেও তিনি সিনেট নির্বাচন দেননি। ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতেও তিনি ব্যর্থ হন। সরকারের সিদ্ধান্তের কাছে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনকে বিকিয়েছেন, আর এটাই এখন নিয়তি।

তবে সবচেয়ে ভয়ানক হলো, এত অঘটন, সম্ভবত তিনি নিজে আরও চার বছরের মেয়াদে ভিসি থাকতে চান সেই কারণেই। অনির্বাচিত হিসেবে চার বছর এবং নির্বাচিত হিসেবে চার বছর পার করছেন তিনি। তাঁর আমলে সাফল্য-ব্যর্থতা (বিশেষ করে নিয়োগে) আছে। তেমন কোনো সহিংসতা হয়নি ক্যাম্পাসে, আরও অনেক কিছুর জন্য তিনি প্রশংসার যোগ্য হতে পারেন। কিন্তু যোগ্যতর বা শ্রেয়তর বলেই কেউ আইন ভাঙতে পারেন, এটা মানা যাবে না। বৈধতার প্রশ্ন গণভবনে উঠেছিল বলে জানা যায়। সেটা এড়াতে ভোট পেছানোর প্রস্তাব ছিল। তখন নাকি যুক্তি দেওয়া হয়েছে সামনে রমজান, আর তারপরেই সিনেটকে বাজেট পাস করতে হবে। তাই এই তারিখে নির্বাচন না হলে কোন্দল আরও প্রকাশিত হবে, আর বাজেট পাসের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তাই এভাবেই আইন ভঙ্গ করাই সমীচীন বলে মনে হলো।

 আজকের নির্বাচনের বৈধতার প্রশ্ন কিছুটা প্রশমিত হতে পারে যদি উপাচার্য এখনই পরিষ্কার করেন যে তিনি ভিসি হতে চান না। আজকের সরকার-অনুগত নীল প্যানেল জয়ী হলে ভবিষ্যতে তাঁদের সমন্বিত সিনেট যে তিনজনের ভিসি প্যানেল করবে, তাতে যদি বর্তমান ভিসির নাম তৃতীয় মেয়াদে রাখা হয়, তখন অন্তত হাইকোর্টে একটি রিটে বৈধতার প্রশ্ন চ্যালেঞ্জের সম্ভাবনা আমরা দেখি। তবে তা হোক বা না হোক, এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ধূলিসাৎ করার মতো একটি ঘটনা।

পাদটীকা: লেখাটি শেষ করার পরে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে ফোন করি। তিনি স্বীকার করেন যে প্রার্থী তালিকা তিনি অনুমোদন করেছেন। তৃতীয় মেয়াদে উপাচার্য হতে চান কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সিনেটের বিষয়। আর আইনের সুনির্দিষ্ট লঙ্ঘনের বিষয়ে তাঁর যুক্তি: আইনের বিষয় আইন দেখবে। আমরা নৈতিকতা দেখেছি। নীল কাগজ নীল দলের প্রতীক। এক দলের প্রতীক অন্য দল ব্যবহার করতে পারে না।’ তখন বলি, এ কথা আইন সমর্থন করে না। তাঁর উত্তর, ‘আমি আইনের ইয়েতে যাচ্ছি না। আমাদের একটা নৈতিক অবস্থান আছে। সেখানে শিক্ষকদের একটি গোষ্ঠী যদি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, সেটা তো গ্রহণযোগ্য হয় না।’ 

 ২০০৩ সালের ১২ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ ঢাকা িবশ্ববিদ্যালয় সিনেট–সংক্রান্ত নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নে একটি রায় দিয়েছিলেন। সেই রায়ের আলোকে বলব, উপাচার্যের নৈতিকতার যুক্তি অসার। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, ‘যখন ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সিনেটের কোনো নির্বাচন হয়, তখন সেই নির্বাচন আইনের চোখে কোনো নির্বাচন নয়। আর হলেও তার ফলাফল রিটে চ্যালেঞ্জযোগ্য।’

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]