চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড': বাংলাদেশের লাভক্ষতি ১

>চীনের উদ্যোগে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআইকে বলা হচ্ছে এশীয় বিশ্বায়নের কর্মসূচি। সবচেয়ে বেশি দেশ, বিপুল বিনিয়োগ এবং বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যাকে জড়িত করার এ পরিকল্পনা নিয়ে এটিই একুশ শতাব্দীর বৃহত্তম উন্নয়ন প্রকল্প। অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন সুযোগের পাশাপাশি বিআরআই দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। গত ১৪-১৫ মে বিআরআইয়ের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে। বাংলাদেশও এই প্রকল্পের অংশীদার। এ নিয়ে প্রথম আলোর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব আজ।
১৪-১৫ মে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে বিআরআই ফোরামের শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিশ্বনেতৃবৃন্দ
১৪-১৫ মে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে বিআরআই ফোরামের শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিশ্বনেতৃবৃন্দ


বুনো রাজহাঁসের বৈশ্বিক উড়াল


বিংশ শতক ছিল আমেরিকার, একবিংশ শতক হবে কার? তা নির্ভর করছে যে প্রকল্পের সম্ভাবনার ওপর, তার অনেক নাম। একে প্রথমে ডাকা হচ্ছিল নয়া রেশমপথ (সিল্ক রোড) নামে। পরে বলা হলো ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবর)। কিন্তু ‘ওয়ান’ বা ‘একক’ কথাটার মধ্যে একাধিপত্যের লক্ষণ থাকায় এর সর্বশেষ নাম দেওয়া হয়েছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, সংক্ষেপে বিআরআই। একুশ শতাব্দী চীনা শতাব্দী হবে কি না, তা নির্ভর করছে এই বৈশ্বিক বাণিজ্য অবকাঠামো নির্মাণে সফলতার ওপর। তিনটি বৃহৎ এখানে এক হয়েছে: সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্র, সবচেয়ে বড় অর্থায়ন ও সবচেয়ে বেশি জনসমষ্টি। বলা হচ্ছে, এটিই হতে যাচ্ছে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রকল্প। ৬৮টি দেশ, ৬০ শতাংশ বিশ্ব জনসংখ্যা এবং ৪০ শতাংশ উৎ​পাদন নিয়ে এই নয়া রেশমপথ রচনা করছে এশীয় আদলের নতুন বিশ্বায়ন।

চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ডাকে ১৪-১৫ মে–তে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিআরআই ফোরামের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন। উদ্বোধনী ভাষণে তিনি এ প্রকল্পকে ‘বুনো রাজহাঁসের’ সঙ্গে তুলনা করেন। এই পাখি কেবল এশিয়াতেই পাওয়া যায়, ইউরোপে নয়। সি চিন পিং তাঁর বক্তৃতায় বলেন, বুনো রাজহাঁস ঝড় ও বাতাসের মধ্যে অনেক দূর পর্যন্ত নিরাপদে উড়তে পারে। কারণ, তারা ওড়ে ঝাঁক বেঁধে এবং একটা দলের মতো একে অন্যের পাশে থাকে। চীনের দাবি, এটা সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথভাবে লাভবান হওয়ার নতুন এক মডেল। ভারত অবশ্য অভিযোগ করেছে, এটা নতুন ধরনের উপনিবেশবাদ, এটা দুর্বল রাষ্ট্রকে ঋণের জালে বেঁধে ফেলবে। তবে সবাই স্বীকার করছেন, এই শতাব্দীর সব থেক বড় উন্নয়ন প্রকল্প এটাই।

পুরোদমে বাস্তবায়িত হওয়া শুরু হলে বিআরআই হয়ে উঠবে বিশ্বায়ন ২.০। তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৯০ দশকের গোড়ার বিশ্বায়নকে বলা হচ্ছে বিশ্বায়ন ১.০। আর এটা ঘটছে এমন সময়ে, যখন পশ্চিমা বিশ্বায়ন নিজের ভেতর থেকেই বাধার মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ব্রিটেনে ব্রেক্সিটের বিজয় বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের ধারণার সমালোচনা করে আবার ফিরিয়ে আনছে জাতিরাষ্ট্র ও জাতীয় বাজারের ধারণা। এ রকম সময়ে চীনা বিশ্বায়ন বিশ্বের সামনে নিয়ে এসেছে নাটকীয় সম্ভাবনার চ্যালেঞ্জ। চীনের নেতৃত্ব কতটা উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছে, এই কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রকল্প তার প্রধান উদাহরণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত ইউরোপকে পুনর্গঠনে ‘মার্শাল প্ল্যান’ যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছিল পৃথিবীর শীর্ষ শক্তির স্বীকৃতি। সে সুবাদেই আমেরিকা বলতে ভালোবাসে, বিশ শতক হলো আমেরিকান শতক। কিন্তু মার্শাল প্ল্যান ছিল কেবল ইউরোপের বিষয়, আর বেল্ট অ্যান্ড রোড এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাকে ধারণ করলেও এর আওতায় আসবে সারা পৃথিবীর বাণিজ্যই।

বিআরআই দৃশ্যত যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অঞ্চল ও করিডর প্রতিষ্ঠার প্রকল্প। সমালোচকদের মতে, তা আসলে চীনা পুঁজিবাদের বৈশ্বিক বিস্তারের পদক্ষেপ। এটা নেওয়া হয়েছে চীনের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে। একদিকে শতবর্ষের নীরবতা ভেঙে চীন আপন সীমানার বাইরে ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের নীতি নিয়েছে, অন্যদিকে কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে দেখা দিয়েছে ধীরগতির লক্ষণ। পাশাপাশি দেশটির উৎপাদনক্ষমতা যত বেশি, তত বেশি রপ্তানি না হওয়ার সংকটও ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। বিআরআই হয়তো এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠারই চেষ্টা। পাশাপাশি তা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতির জন্য হাজির করেছে অভূতপূর্ব সম্ভাবনাও।

বিআরআইয়ের মূল চাবিশব্দ হলো কানেকটিভিটি। এর উদ্দেশ্য এশিয়াকে বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রীয় ইঞ্জিন করে তোলা। এ পরিকল্পনায় থাকছে সমুদ্রপথে একগুচ্ছ আন্তর্জাতিক বন্দর, ভূমিতে আন্তসীমান্ত সড়ক, উচ্চগতির রেলপথ, বিমানবন্দর এবং ডিজিটাল যুক্ততার অবকাঠামো নির্মাণ। এর সমান্তরালে থাকবে বিদ্যুতের গ্রিড, গ্যাসের পাইপলাইন এবং বাণিজ্য–সহায়ক আর্থিক কার্যক্রম। এই বাণিজ্যপথ এশিয়ার বিস্তৃত এলাকায় জালের মতো ছড়িয়ে থাকবে, এশিয়াকে ভূমি-সমুদ্র-আকাশ ও ডিজিটাল মাধ্যমে ইউরোপ ও আফ্রিকার সঙ্গে যুক্ত করবে। চীনা রাষ্ট্রের সব স্তর, সব প্রাদেশিক সরকার এবং গণমাধ্যম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মহলকে এই মহাপরিকল্পনা তৈরি ও তার বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত করা হয়েছে। প্রধান প্রধান রাষ্ট্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংক নিচ্ছে এর অর্থায়নের মূল দায়িত্ব।

বিশ্ববাণিজ্যের নয়া রেশমপথের বৈশ্বিক পথরেখা
বিশ্ববাণিজ্যের নয়া রেশমপথের বৈশ্বিক পথরেখা

৩০টি দেশের সরকারপ্রধানসহ ১০০ দেশের প্রতিনিধির যোগদানের ঘটনায় বেইজিংয়ের দুদিনব্যাপী বিআরআই ফোরামের সম্মেলন হয়ে উঠেছিল নতুন সিল্ক রোড জাতিসংঘ। গোলটেবিলের আসন এবং সবার জন্য মাইক্রোফোন খোলা রেখে প্রেসিডেন্ট সি বোঝাতে চেয়েছেন, উদ্যোগ চীনের হলেও অংশীদারত্ব সবার, লাভের ভাগও সবার। চীনের তিন প্রতিদ্বন্দ্বীর দুটি, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান বেইজিংয়ে প্রতিনিধি পাঠালেও অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত অনুপস্থিত ছিল। এ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক সম্মেলনে ভারতের না থাকা বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে অনেকের কাছে। বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার এই সম্মেলনে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠালেও ভারতের বিরাগ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে সৃষ্টি করছে নতুন উদ্বেগ।

ভারতের আপত্তির কারণ হিসেবে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকির কথা। ভারত মনে করে, বিআরআইয়ের অংশভুক্ত চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরে (সিপিইসি) পাকিস্তানের অংশভুক্ত কাশ্মীর থাকায় তা ভারতের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। উল্লেখ্য, ভারত সমগ্র কাশ্মীরকেই তার সার্বভৌম অধিকারের অংশ বলে মনে করে। জবাবে ভারতের চীনা দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন লিউ জিংসং বলেন, সিপিইসির কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে যাওয়াই যদি ভারতীয় বন্ধুদের বেল্ট অ্যান্ড রোডে যোগদানের ইচ্ছার বাধা হয়, তাহলে তাঁদের এই উদ্বেগ দূর করা যেতে পারে। ভারতের আরও ভয়, বিআরআই বাস্তবায়িত হলে ভারত-নিয়ন্ত্রিত ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব অনেক বাড়বে।

অনেক ভারতীয় বিশ্লেষকও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই ‘একলা চলো’ নীতির সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। দেশটির প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং বিজেপির সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির (১৯৯৯-২০০৪) উপদেষ্টা সুধীন্দ্র কুলকার্নি মনে করেন, ভারতের এই সিদ্ধান্ত ‘অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও আত্মঘাতী’। তিনি মনে করেন, বিআরআই ভারতের ব্যবসা, কর্মসংস্থান ও আন্তর্জাতিক অবস্থানকে শক্তিশালীই করবে। সুধীন্দ্র কুলকার্নি ভারতের বেসরকারি প্রতিনিধি হিসেবে বিআরআই সম্মেলনে অংশ নেন।

ইতিহাসে দেখা গেছে, পরাশক্তি হয়ে ওঠার কালে কোনো কোনো দেশের বিশেষ কোনো সুবিধা বা ক্ষমতার জন্ম হয়েছে, তা দিয়ে ওই সব দেশ বিশ্বকে দীর্ঘ সময়জুড়ে প্রভাবিত করতে পেরেছে। ব্রিটেন জাহাজ নির্মাণ ও নৌচালনা জ্ঞান দিয়ে সাম্রাজ্য গড়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজি ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতা দিয়ে ইউরোপ পুনর্গঠন করে পাশ্চাত্যের নেতা হয়েছিল। পাশ্চাত্য তার অর্থনৈতিক ও প্রাযুক্তিক ক্ষমতা দিয়ে বিশ্বায়নের প্রথম পর্বের বাস্তবায়ন করেছিল। চীনের সেই বিশেষ সুবিধার দুটি দিক হলো, অবকাঠামো নির্মাণে চীনের বিশ্বসেরা দক্ষতা এবং বিরাট অঞ্চলজুড়ে অবকাঠামো নির্মাণে তাদের আর্থিক সামর্থ্য। চীন গত চার বছরে প্রকল্পভুক্ত দেশগুলোয় ইতিমধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে এবং বাড়তি আরও ৮৯০ বিলিয়ন ডলার ধাপে ধাপে ব্যয় করা হবে। এর বড় অংশটাই বিনিয়োজিত হবে উন্নয়নশীল দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণে।

উদীয়মান অর্থনীতি এবং জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ ক্ষুধার্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এর দ্বারা কতটা উপকৃত হবে, কীভাবে ভূরাজনৈতিক জটিলতা ও বাধাগুলোকে কূটনৈতিক কৌশল ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে সমাধান করা হবে; এসবই আজকের বাংলাদেশের সামনে বড় প্রশ্ন হিসেবে হাজির হয়েছে।