আবারও বোমাতঙ্কে বিলেত

বিবিসি রেডিও থেকে খবর পেলাম, পুলিশ ২৩ বছর বয়সী এক যুবককে দক্ষিণ ম্যানচেস্টার থেকে গতকাল মঙ্গলবারের বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার করেছে। ম্যানচেস্টারে এ হামলায় ঘটনাস্থলে ২৩ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ৫৯ জন। তাঁরা সবাই আমেরিকান পপশিল্পী আরিয়ানা গ্রান্ডির কনসার্ট শুনতে গিয়েছিলেন। এটি আয়োজিত হয়েছিল ভিক্টোরিয়া স্টেশনের কাছে একটি কনসার্ট হলে।

মানুষের জীবনের চেয়ে বড় কিছু নেই; সে যে বয়সেরই হোক না কেন। শিশু ও অল্পবয়সীর প্রাণ চলে গেলে সবার মনে অন্য রকম হাহাকার জাগে। গতকালের ঘটনায় তা-ই হয়েছে। শিশু ও কিশোরী মেয়েদের মৃত ও খণ্ডিত দেহ দেখে মানুষ চিৎকার করে জঙ্গিদের শাপশাপান্ত করেছে। বিশ্বজুড়েই আরিয়ানার ভক্তদের প্রায় সবাই কিশোর-কিশোরী ও শিশু। কনসার্টে ওরা সারাক্ষণ আনন্দে নেচেছে গেয়েছে। বাড়ি যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছিল। রাত ১০টা বেজে গেছে। সাড়ে ১০টার দিকে আরিয়ানা সবে গান গাওয়া শেষ করেছেন। দর্শকদের এবার বাড়ি ফেরার পালা। চ্যাঁচামেচি করে সবাই যখন একত্র হচ্ছে, তখনই প্রচণ্ড এক শব্দ। এমন শব্দ যে পুরো অ্যারেনা কেঁপে উঠল। মূল হলের সামনে ফুটল বোমা। প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা বলেন, চারদিকে ছিন্নভিন্ন দেহের সঙ্গে পড়ে থাকতে দেখা যায় লোহার পেরেক, নাট ও বল্টু। হুড়োহুড়িতে মাটিতে পড়ে যায় অনেক মানুষ। তারা জনতার পায়ের নিচে পড়ে থেঁতলে গেছে। অনেককে দেখা গেছে ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে চেয়ার বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। আবার অনেককে দেখা গেছে বন্ধ বেড়া গলিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। পুরো এলাকায় এক নারকীয় পরিবেশ।

ধারণা করা হচ্ছে, কোনো জঙ্গি ঘরে বসে এই পেরেকবোমা বানিয়েছে এবং একাই এখানে এসে এতগুলো সম্ভাবনাময় প্রাণ নাশ করেছে। তবে এখানে একা এলেও দলে সে একা নয়। ভীষণ এই শক্তিশালী বোমা বানানো ও ফাটানো তার একার পক্ষে শিখে করা সম্ভব না। এখন সিরিয়া হোক আর যা হোক, এদের দ্বিতীয় ঘাঁটি হয়ে উঠছে ইংল্যান্ড। এদের কর্মকাণ্ড এ দেশে বসবাসকারী অন্যান্য সাধারণ মুসলমানের জীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে দিনকে দিন। এযাবৎ যত টেররিস্ট ধরা পড়েছে বা মারা গেছে, তাদের সবাই এ দেশে জন্ম নিয়েছে বা তারা ধর্মান্তরিত মুসলিম। তারা এখানেই বড় হয়ে এ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে এবং এ দেশকেই তার শত্রু ও বিপক্ষ দল ভাবছে। ধ্বংস করে দিতে চাইছে এর সব। এখন এসবই মনোবিজ্ঞানী ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞের গবেষণার বিষয় হলেও সাধারণ জীবনযাপন অচল হয়ে যাচ্ছে। ট্রেনে এশিয়ান যুবকদের কাউকে পিঠে ব্যাগ দেখলে ভয় হচ্ছে, সন্দেহ হচ্ছে। বেশ কদিন আগে বোরকা পরে বিস্ফোরক নিয়ে ট্রেন স্টেশনের টিকিট গেটে ধরা পড়েছে একজন।

হামলার ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বৃহত্তর ম্যানচেস্টার থেকে বাংলাদেশি-অধ্যুষিত ওল্ডহ্যাম পর্যন্ত। এই ওল্ডহ্যামেই তৈরি হয়েছে দেশের বাইরের প্রথম শহীদ মিনার, প্রথম শাপলা চত্বর। গত বছর গিয়ে শুনলাম, এখানে আর একুশে ফেব্রুয়ারিতে কোনো অনুষ্ঠান হয় না। ভাবি আমাদের দেশের কথাও। কী করে ক্রমশ বদলে যাচ্ছে পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে সব আচার-অনুষ্ঠান!

ম্যানচেস্টারে এই সাংঘাতিক বোমা হামলা এমন সময় ঘটেছে, যখন সারা দেশ সাধারণ নির্বাচনের জন্য তৈরি হচ্ছিল। তবে এ সময় নির্বাচনের কথাও আগে কেউ ভাবেননি। ব্রেক্সিটের অপমান নিয়ে ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগ করলে থেরেসা মে তাঁর আরব্ধ কাজ অব্যাহত রাখতে নির্বাচিত হন। কিন্তু ব্রেক্সিটের দায় কাঁধে নিলেও ব্রিটেনের লৌহমানবী মার্গারেট থ্যাচারের ভাবসন্তান প্রকৃত কাজে হাত দিয়ে ব্যাপক সমালোচনা পাচ্ছেন। নিজের রক্ষণশীল দলের ভেতরও জুত করে উঠতে পারছিলেন না। অপ্রত্যাশিতভাবেই সবাইকে অবাক করে তিনি দুম করে ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে দিলেন। কী কাণ্ড! আমরা সাধারণ মানুষ তো বটেই, লেবার, লিবারেল ডেমোক্র্যাটস বা গ্রিন পার্টি কোনোভাবেই ভাবতে পারেনি তা সম্ভব হবে। কিন্তু থেরেসা সম্ভবত এ রকম সময়ই নির্বাচন দেওয়ার জন্য সুবিধজনক ভেবেছিলেন। অন্যদিকে, লেবার পার্টিতে জেরেমি করবিনকে নিয়েও সমালোচনার অন্ত নেই। কিন্তু সেখানে আবার তাঁর বিকল্পও নেই। থেরেসা হয়তো ভাবলেন, লেবার পার্টির এই নাজুক অবস্থা তাঁর পক্ষে আসবে। এখনই আঘাত করতে হবে, কারণ নেতৃত্বর প্রশ্নে লেবার পার্টি এখনো যূথবদ্ধ হতে পারেনি। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভেঙে বেরিয়ে আসার সময় যে দর-কষাকষির সময় আসছে, তখন হয়তো টোরির ওপর সাধারণ জনগণের যতটুকু মোহ আছে, তাও থাকবে না।

নির্বাচনী উত্তেজনা দানা বেঁধে উঠেছে যখন, তখনই বিলেতের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ম্যানচেস্টারে ইসলামি জঙ্গিরা ভীষণ এক আত্মঘাতী বোমা হামলা করে বসল। এটি এমন এক হামলা যে এর তুলনা শুধু চলে ২০০৫ সালের ৭ জুলাইয়ের লাগাতার হামলার সঙ্গে। ওই হামলায় ৫৫ জন মারা যান এবং ৭০০ জন আহত হন।

সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ব্রিটেন। হামলাকারীরা বিলেতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিতে বড় হওয়া এশীয় ছিল। প্রহসনের বিষয় হলো, এই সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ চর্চাকারী দেশ হওয়ার সুবাদেই হামলার এক দিন আগে অলিম্পিক ২০১২-এর দরপত্রে জয়ী হয়েছিল। সে সময় কয়েজন যুবক ঘরে বানানো অর্গানিক বোমা পিঠে করে তিন তিনটি আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে বোমা ফাটায় এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে একইভাবে টাভিস্টক স্কয়ারে বাসে বোমা ফোটায়। তখন আইএস ছিল না। কিন্তু ইসলামি জঙ্গিরাই এই জঘন্য কাজ করে বলে প্রমাণিত হয়।

ম্যানচেস্টারে হামলার পর সাধারণ মানুষের জীবন আরও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সবার মনে প্রশ্ন জেগেছে, প্রকৃত ইসলামপন্থীরা এ নিয়ে কী করছেন? কিছু করছেন কি?

শামীম আজাদ: কবি ও কলাম লেখক।