সংকটে জাপান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার

সম্রাট আকিহিতো
সম্রাট আকিহিতো

জাপানের মন্ত্রিসভা সম্রাটের সিংহাসন ত্যাগের বিল অনুমোদন করেছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম অনুসরণ করে বিলটি এখন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের নিম্নকক্ষে পাঠানো হবে এবং সেখানে অনুমোদিত হয়ে উচ্চকক্ষের অনুমোদন লাভের পর এটি আইনে পরিণত হবে। যেহেতু সংসদের উভয় কক্ষে উদার গণতন্ত্রী দল এলডিপি এবং দলের কোয়ালিশন অংশীদার কোমেই পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, তাই ধারণা করা যায়, দ্রুতই বিলটি অনুমোদিত হবে এবং সম্রাট আকিহিতোর নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী সিংহাসন ত্যাগের পথ এর মধ্য দিয়ে সুগম হবে।

গত বছরের আগস্ট মাসে সম্রাট আকিহিতো বিরল এক টেলিভিশন ভাষণে নিজের সেই ইচ্ছার কথা তুলে ধরে নিয়মতান্ত্রিক পথে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার উপায় খুঁজে পাওয়া যায় কি না, সেই অনুরোধ দেশবাসীর কাছে করেছিলেন। ৮৩ বছর বয়সী সম্রাটের স্বাস্থ্য ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। ক্যানসারের চিকিৎসায় আরোগ্য লাভ সত্ত্বেও সম্রাট মনে করছেন তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা এখন কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই তিনি চাইছেন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী, জ্যেষ্ঠ পুত্র যুবরাজ নারুহিতোর হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে জীবনের অবশিষ্ট সময় ভারমুক্ত কাটাতে। জাপানের সংবিধান এবং সম্রাট-বিষয়ক আইনের কোথাও সম্রাটের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পথের কোনো নির্দেশিকা না থাকায় শেষ পর্যন্ত জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সেই আকাঙ্ক্ষা তাঁকে ব্যক্ত করতে হয়।

জাপানের সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাজসিংহাসন হবে সংসদের অনুমোদিত সম্রাট-পরিবারবিষয়ক আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকার-ভিত্তিক।’ অন্যদিকে ইম্পিরিয়াল হাউস ল বা সম্রাট-পরিবারবিষয়ক আইনের প্রথম ধারায় উল্লেখ আছে, ‘বংশানুক্রমিকভাবে সম্রাট-পরিবারের পুরুষ উত্তরসূরি রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবেন।’ দুই আইনের কোথাও মৃত্যুর আগে সম্রাটের সিংহাসন ত্যাগের উল্লেখ নেই। ফলে সম্রাটকে নাগরিকদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সিংহাসন ত্যাগের আরজি পেশ করতে হয়।

ভাষণের পর অনেকেই ভাবছিলেন, সম্রাট স্বাস্থ্যগত কারণের উল্লেখ করলেও এর পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে কি না। তাঁর পিতা সম্রাট হিরোহিতো ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে গেছেন। জাপানের কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে এ রকম মন্তব্যও দেখা গেছে যে সম্রাট দেশের বর্তমান প্রশাসনের কিছু কিছু উদ্যোগ নিয়ে সন্তুষ্ট নন বলে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করছেন। তবে তিনি নিজে এ রকম কথা বলেননি।

সম্রাট আকিহিতোর ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাতে জাপানের মন্ত্রিসভা সিংহাসন ত্যাগের বিল সংসদে উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে যেহেতু নিকট অতীতে এ রকম কোনো দৃষ্টান্ত নেই, ফলে এককালীন ব্যবস্থা হিসেবে সিংহাসন ত্যাগের পথ করে দেওয়ার উপায় মন্ত্রিসভা এখন খুঁজে নিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বিলটি দ্রুত আইনে পরিণত হলে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে সম্রাটের বয়স ৮৫ হয়ে যাওয়ার পর অবসর নেওয়ার সুযোগ তাঁর জন্য করে দেওয়া হবে এবং যুবরাজ নারুহিতো জাপানের পরবর্তী সম্রাটের দায়িত্ব নেবেন।

অন্য যে সমস্যার কথা অনেকেই বলছেন, কিন্তু সরকার কোনো উচ্চবাচ্য করছে না, বিষয়টি হচ্ছে সিংহাসনে নারীর উত্তরাধিকার। সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, একমাত্র পুরুষ উত্তরসূরি সিংহাসনে আসীন হওয়ার যোগ্য। অন্যদিকে সংবিধানের চতুর্দশ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘আইনের অধীনে সকল মানুষ সমান এবং জাতি, গোত্র, লিঙ্গ, সামাজিক অবস্থান কিংবা পারিবারিক অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্কের বেলায় কোনো রকম বৈষম্য থাকবে না।’

লিঙ্গের বিষয়টির পরিষ্কার উল্লেখ চতুর্দশ অনুচ্ছেদে আছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে শুধু পুরুষকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় কোনো কোনো আইন বিশেষজ্ঞ দুই অনুচ্ছেদকে পারস্পরিক সাংঘর্ষিক উল্লেখ করছেন। সম্রাটের সিংহাসন ত্যাগের বিষয়টি উত্থাপিত হওয়ার পর এঁদের অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে সিংহাসনের উত্তরাধিকারের বেলায় যে লিঙ্গবৈষম্য, সেটারও নিষ্পত্তি হয়তো একই সূত্র ধরে করে নেওয়া যাবে। তবে সরকার সেই পথে অগ্রসর হয়নি।

অনেকটা একই সময়ে সম্রাটের পরিবারের সঙ্গে জড়িত আরেকটি বিষয় সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হওয়ায় সিংহাসনে
নারীর উত্তরাধিকারই কেবল নয়, একই সঙ্গে সম্রাটের বৃহত্তর পরিবারে নারীর অধিকার সমুন্নত রাখার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।

সম্রাটের পরিবারসংক্রান্ত আইনে উল্লেখ করা আছে যে সম্রাটের পরিবারের কোনো নারী সাধারণ নাগরিকের পর্যায়ভুক্ত কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে সম্রাট পরিবারের সদস্য হিসেবে ভোগ করা সব রকম সুযোগ-সুবিধা তাঁকে ছেড়ে দিতে হবে এবং সেই নারী সাধারণ নাগরিকের দলে অন্তর্ভুক্ত হবেন। তবে পুরুষ সদস্যদের বেলায় হয়ে থাকে ঠিক উল্টো। অর্থাৎ, সম্রাটের পরিবারের সদস্যই যে তাঁরা কেবল থেকে যান তা-ই নয়, সেই সঙ্গে যে নারীকে সম্রাট পরিবারের পুরুষ বিয়ে করেছেন, সেই নারীও সম্রাটের পরিবারের সদস্যদের দলে অন্তর্ভুক্ত হন, যেমনটা দেখা গেছে বর্তমান সম্রাট ও তাঁর দুই পুত্রের স্ত্রীদের বেলায়।

সম্রাট আকিহিতোর কনিষ্ঠ কন্যা কয়েক বছর আগে টোকিওর নগর সরকারের এক কর্মকর্তাকে বিয়ে করার পর সম্রাটের পরিবারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক তাঁর ছিন্ন হয়ে যায়, যদিও পারিবারিক সম্পর্কের বেলায় এর কোনো প্রভাব পড়েনি। সম্রাটের দ্বিতীয় পুত্র, রাজকুমার আকিশিনোর জ্যেষ্ঠ কন্যা রাজকুমারী মাকোর সঙ্গে তাঁর এক স্কুল সহপাঠী সাধারণ নাগরিকের বিয়ের প্রসঙ্গটি আলোচিত হতে থাকায় তাঁকেও এখন সম্রাটের পরিবার ত্যাগের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে।

রাজপরিবারের মেয়েদের সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পেছনে বড় এক কারণ হচ্ছে সম্রাট পরিবার সংকুচিত হয়ে আসা। রাজকুমারী মাকো তাঁর স্কুল সহপাঠীকে বিয়ে করার মধ্য দিয়ে রাজকীয় মর্যাদা হারালে রাজমর্যাদা যাঁরা ভোগ করছেন, তাঁদের মোট সংখ্যা দাঁড়াবে ১৮। এর মধ্যে ১৩ জনই নারী। আর অবশিষ্ট পুরুষ সদস্যদের মধ্যে একমাত্র অবিবাহিত যিনি থেকে যাবেন, তিনি হলেন ১০ বছর বয়সী রাজকুমার হিসাহিতো। ফলে সম্রাটের পরিবারের মেয়েরা বিয়ে করতে চাইলে সাধারণ নাগরিকদের মধ্য থেকেই তাঁদের পাত্র খুঁজে নিতে হচ্ছে এবং বিয়ে করার পর রাজকীয় মর্যাদা তাঁরা হারাচ্ছেন।

ফলে সেই মেয়েদের জন্য সম্রাটের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মতো একই অধিকার নিশ্চিত করা যায় কি না, সেই দাবি এখন বিভিন্ন মহল থেকে উঠছে। জাপানের বৃহত্তম বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টিও বলছে সম্রাটের সিংহাসন ত্যাগের সঙ্গে এই বিষয়টিরও নিষ্পত্তি করা দরকার। অন্যরা আরও এক ধাপ এগিয়ে বলছেন, সিংহাসনের উত্তরাধিকারেও নারীর জন্মগত অধিকার মেনে নেওয়ার এখনই সময় এবং এটা বিলম্বিত করা হলে সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার সংকটের মুখে পড়বে। সম্রাটের পারিবারিক বৃক্ষের দিকে নির্দেশ করে তাঁরা বলছেন, ১০ বছর বয়সী রাজকুমার হিসাহিতো এখন সিংহাসনের তিন নম্বর উত্তরাধিকারী এবং ভবিষ্যতে ঘর-সংসার শুরু করার পর তাঁর পরিবারে যে পুত্রসন্তান জন্ম নেবে, সে রকম কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর পুত্রসন্তানের জন্ম না হলে সম্রাটের পরিবারে আর কোনো উত্তরাধিকারী থাকবে না এবং সে রকম অবস্থায় আড়াই হাজার বছরের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা পরিবারের সমাপ্তি সূচিত হলে সাংবিধানিক এক সংকটের মুখে জাপানকে পড়তে হবে।

একুশ শতকে পদার্পণের পর সংবিধানে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও সম্রাটের পরিবারের সদস্য হওয়ায় নারীরা সম-অধিকার ভোগ করতে পারবেন না, সে রকম বাস্তবতা জাপানের পিছিয়ে থাকার ইঙ্গিতই কেবল দিচ্ছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের পছন্দের একটি উক্তি—রমণীরা যে দেশে হাস্যোজ্জ্বল, সেটাকে বাস্তব অর্থে দেখিয়ে দিতে হলেও সম্রাট পরিবারের নারীদের পরিপূর্ণ অধিকার এখনই নিশ্চিত করা দরকার।

মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক