নির্বাচনবাজি

এ দেশে একসময় টেন্ডারবাজি ছিল বহুল আলোচিত একটি বিষয়। টেন্ডারবাজি হতো সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নির্মাণ, মেরামত ও সরবরাহের কাজে। দেখা যেত সরকারি দলের মাস্তানদের ভয়ে সেখানে কাজ পাওয়ার জন্য দরপত্র দাখিলের সাহসই পেত না অন্য কেউ। সাহস করে কেউ দরপত্র দাখিল করতে গেলে ফিরে আসত বোমা বা বন্দুক দেখে, কখনো নির্যাতিত হয়ে। গডফাদার আর মাস্তানেরা অনেক বেশি খরচের দরপত্র দাখিল করে বিনা প্রতিযোগিতায় কাজ বাগিয়ে নিতেন। এটাই ছিল টেন্ডারবাজি।

এমন টেন্ডারবাজদের মতো ভাঁওতাবাজ, তদবিরবাজ, ধোঁকাবাজদের দৌরাত্ম্যও ছিল সমাজে। এদের দেখে শ্রদ্ধেয় বিচারপতি হাবিবুর রহমান মন্তব্য করেছিলেন, দেশ এখন ‘বাজিকরদের’ হাতে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আমলে এই মন্তব্য করার কারণে তিনি দলটির কিছু লোকের বিরূপ মন্তব্যের শিকার হলেও প্রশংসিত হয়েছিলেন অন্য সবার কাছে।

ডিজিটাল যুগে দেশ প্রবেশ করার পর অস্ত্র আর বোমা উঁচিয়ে টেন্ডারবাজির প্রকোপ কমেছে। কিন্তু সরকারি কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম কমেছে বলে মনে হয় না। কমলে সরকারি ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষমতাসীনদের লোকজনের হাতে অব্যাহত থাকার ঘটনাগুলো ঘটত না। টেন্ডারবাজি তাই অন্য রূপে এখনো প্রচলিত সমাজে।

বিচারপতি হাবিবুর রহমান অন্য যেসব বাজিকরের কথা বলেছেন, তারাও অব্যাহত বা বলবান রয়েছে নানা অবয়বে। তিনি প্রয়াত হওয়ার পর বরং আরেক ধরনের ‘বাজি’ বা ব্যাধি এই সমাজে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তা হচ্ছে নির্বাচনবাজি।

নির্বাচনের নামে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে যে একতরফা ব্যবস্থার সূচনা করা হয়, তাকেই আমরা নির্বাচনবাজি বলতে পারি। টেন্ডারবাজির মতো এই নির্বাচনবাজিতেও কোনো সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নেই, আইন-নৈতিকতা মানার বালাই নেই। নির্বাচনবাজিতে নির্বাচন হবে, তবে তা জনগণের পছন্দের লোককে নির্বাচিত করার জন্য নয়, বরং সরকারের পছন্দের লোককে নির্বাচিত করিয়ে আনার জন্য। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের পর এই নির্বাচনবাজি আমরা উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দেখেছি। দেখেছি এমনকি ব্যবসায়ী ও প্রেসক্লাবের মতো সাংবাদিক সংগঠনের নির্বাচনে। সর্বশেষে আমরা এক অভিনব নির্বাচনবাজি দেখলাম গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ সিনেট নির্বাচনেও।

২.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচনের নৈতিক ও আইনগত বৈধতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন ইতিমধ্যে উচ্চারিত হয়েছে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগপন্থী নীল দলের প্রার্থী মনোনয়নের সময়ে বিরোধ থেকে দুটো প্যানেল জমা দেওয়া হয়। একটি প্যানেল ভিসিপন্থী, অন্যটি বিদ্রোহী প্যানেল হিসেবে অভিহিত হয়। একদিকে ভিসির ব্যক্তিগত প্রভাব, অন্যদিকে বিদ্রোহী প্যানেলে বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় শিক্ষক থাকার কারণে দুই প্যানেলই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে নীল দলের ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ার এবং সে কারণে অনেক নীল প্রার্থীর পরাজয়ের আশঙ্কা দেখা দেয়।

এই আশঙ্কা এড়ানোর জন্য (নীল দলের সব প্রার্থী নির্বাচনী বিধি অনুসারে মনোনয়নপত্র প্যানেল জমা দেওয়া সত্ত্বেও) শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে নীল দলের বিদ্রোহী প্যানেলের সবার প্রার্থিতা বাতিল করা হয় তাঁদের নির্বাচনী প্রচারপত্রে নীল রঙের কাগজ ব্যবহার করার অজুহাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচনে প্রচারণার জন্য বা প্রার্থীদের আচরণবিধি সম্পর্কিত কোনো নির্দিষ্ট আইন, বিধি বা সিদ্ধান্ত নেই। সে অবস্থায় নীল রঙের কাগজ ব্যবহার বিদ্রোহী নীল প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিলের কারণ কীভাবে হতে পারে, তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি এই নির্বাচনের নির্বাচন কমিশন (ঢাবির কোষাধ্যক্ষ)।

নীল দলের বিদ্রোহী প্যানেলটি বাতিল হওয়ার বেআইনি পদক্ষেপটি আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যেত, এর প্রস্তুতিও সংক্ষুব্ধ শিক্ষকদের ছিল। কিন্তু এটি করতে তাঁদের বিরত থাকার জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করানো হয়। এই নির্বাচন শুধু ঢালাওভাবে ৩৫ জন প্রার্থীকে বাতিল করার কারণে এমনিতেই বিতর্কিত ছিল। তারপরও প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে একদল প্রার্থীকে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণে বিরত রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ও শিক্ষকদের মর্যাদা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।

প্রশ্নবিদ্ধ এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভিসিপন্থী নীল দলের প্রার্থীরা প্রায় সব আসনে (মাত্র দুটো আসনে সাদা দল বিজয়ী) জয়ী হয়েছেন। নীল দলের দুই প্যানেলে নির্বাচন হলে বিএনপিপন্থী সাদা প্যানেলের আরও বেশিসংখ্যক প্রার্থী বিজয়ী হতে পারতেন, নীল দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের অনেকেও তাতে বিজয়ী হতে পারতেন। তাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগপন্থীদের প্রভাব কিছুটা হ্রাস পেত। কিন্তু বিজয়ী হতো গণতান্ত্রিক চর্চা, অক্ষুণ্ন থাকত বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনগুলোর বহু বছরের অর্জিত শুদ্ধতা, গুণগতভাবে অনেক বেশি সমৃদ্ধ হতো সিনেট।

মনে রাখতে হবে যে বিদ্রোহী প্যানেলে বাতিল ৩৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বর্তমান সভাপতিসহ বিভিন্ন সময়ে নির্বাচিত অন্তত ২৫ জন শিক্ষক। অন্যদিকে নির্বাচিত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন এমন কয়েকজন অনভিজ্ঞ প্রার্থী, যাঁরা বিদ্রোহের আগে নীল দলের সর্বশেষ সভায় প্রার্থী হিসেবে বিবেচিতই হননি। বিদ্রোহী প্যানেলের কারণে তড়িঘড়ি করে মনোনয়ন পাওয়া এই শিক্ষকেরা সিনেটে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখার ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতা রাখেন কি না, তা নিয়ে তাই প্রশ্ন তোলা যায়।

৩.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে এই নির্বাচনবাজি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০১৪ সালের একতরফা সংসদ নির্বাচনের পর আরও বহু ক্ষেত্রে আমরা এমন নির্বাচনবাজি দেখেছি। এসব নির্বাচনবাজির প্রক্রিয়া যেমন খারাপ, এর প্রতিক্রিয়াও তেমনি মন্দ, কখনো ভয়াবহ।

নির্বাচনবাজিতে প্রার্থীদের একটি অংশকে নির্বাচনে দাঁড়াতেই দেওয়া হয় না প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থাকে একতরফাভাবে পরিবর্তন করে (যেমন তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচনব্যবস্থা বাতিল) বা নির্বাচনী অফিসকে অপব্যবহার করে (যেমন ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এবং ঢাবির নির্বাচনে নীল দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল)। অবাধ অংশগ্রহণকে বিঘ্নিত করা হয় কখনো একদল প্রার্থীর মধ্যে ভয়-ভীতি সৃষ্টি করে (স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে বিএনপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা) বা নিরুৎসাহিত করে (যেমন এবারের এফবিসিসিআই নির্বাচনে)।

নির্বাচনবাজিতে বিপক্ষ প্রার্থী সব ভীতি জয় করে দাঁড়ালে তাঁর বিপক্ষে বিভিন্ন অন্যায় ব্যবস্থা নেওয়া হয় (যেমন ইউপি নির্বাচনে তাঁর পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া বা তাঁর পক্ষের এলাকায় ভোটারদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করা), সব প্রতিকূলতা জয় করে জিতে এলে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হয় (যেমন বিভিন্ন মেয়রকে প্রশ্নবিদ্ধ মামলায় গ্রেপ্তার করা)। সব প্রক্রিয়ার লক্ষ্য থাকে একটাই: তা হচ্ছে ভোটারের প্রকৃত প্রতিনিধি নয়, বরং ক্ষমতাসীনদের পছন্দের লোককে জিতিয়ে আনা।

নির্বাচনবাজিতে তাই শুধু প্রার্থী ও ভোটারদের অধিকার ক্ষুণ্ন হয় না, এতে স্বেচ্ছাচারী একটি একতরফা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। জনগণ বা ভোটারের মন জয়ের তাড়না এবং তার প্রতি দায়বদ্ধতাবোধ বিপন্ন হয়, প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ক্ষমতাসীনদের মনোতুষ্টিতে পরিচালিত হয়। নির্বাচনবাজিতে জিতে আসার প্রক্রিয়ায় নানা বাইরের শক্তির (যেমন ঢাবির সিনেট নির্বাচন ও এফবিসিসিআই নির্বাচনে সরকারের) সাহায্য নেওয়া হয় বলে এসব শক্তির অন্যায় খবরদারির সুযোগ বৃদ্ধি হয়।

নির্বাচনবাজি এমনকি নির্বাচনহীনতার চেয়েও খারাপ। নির্বাচন না হলে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের প্রতি অভিযোগের আঙুল তোলা যায়, নির্বাচনবাজিতে নির্বাচনের বাতাবরণ থাকে বলে তা তোলাও সহজ হয় না। জনগণ ও ভোটারের ভোটে নির্বাচিত না হয়ে অন্য প্রক্রিয়ার সাহায্যে নির্বাচিত হলে নির্বাচিত ব্যক্তিরা ওই প্রক্রিয়ার কুশীলবদের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করেন, জনগণ বা ভোটারের প্রতি নয়।

৪.

নির্বাচনবাজি এ দেশে এখন নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায় পুরোপুরি গ্রাস করতে চলেছে। নির্বাচনবাজি আমরা সামরিক সরকারগুলোর আমলে দেখেছিলাম শুধু জাতীয় নির্বাচনগুলোতে। পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানগুলোতে তখন প্রকৃত নির্বাচন হয়েছিল বলে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ ছিল বলে আমরা সামরিকতন্ত্রকে পরাজিত করে দেশে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলাম। পরে বিএনপির সরকার আবারও সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনবাজি চালু করায় আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামে তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো একটি নির্বাচনী ব্যবস্থার জন্ম দিতে পেরেছিলাম।

এখনকার নির্বাচনবাজির পরিসর আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। জাতীয় নির্বাচনের মতো বিভিন্ন পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনেও এখন তা জেঁকে বসছে। ছাত্র সংসদের নির্বাচন ১৯৯১ সালের পর থেকে এ দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই নির্বাচনবাজি থেকে আমরা কখনো মুক্তি পাব কি? এ দেশে নির্বাচনবাজি না হয়ে প্রকৃত নির্বাচনের সংস্কৃতি আবার গড়ে উঠবে কি?

ইতিহাস বলে, আমাদের হতাশ হওয়ার কারণ নেই। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর সবচেয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে এ জাতি সুষ্ঠু নির্বাচনের আন্দোলনই করেছে এবং এতে প্রতিবারই বিজয়ী হয়েছে।

আমরা তাই আশা করতে পারি যে ‘নির্বাচনবাজি’ বন্ধ করে এ দেশে নির্বাচন চালু করার লড়াইও হবে এবং তাতে জনগণ একসময় অবশ্যই বিজয়ী হবে। তবে এতে যত দেরি হবে, জনগণ ও দেশের স্বার্থ ততই বিপন্ন হবে।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।