মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম কারও একার নয়

যেভাবে নির্বাচন হলো, তা নিয়ে আর কি কথা বলার কিছু আছে? ১৯৮৮, ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের সব উপাদানই এ বছর আরও বেশি করে ছিল। আগের ওই দুই বছরের মতো এবারও কাগজপত্রে সংখ্যার জালিয়াতি পাওয়া যাবে অনেক। এর মধ্য দিয়ে ২০০১ সালে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব ঢাকা পড়ে গেল। ইতিহাসে এরশাদ ও খালেদার সঙ্গে জাল নির্বাচনের একই ধারায় হাসিনার নামও যুক্ত হলো। এ রকম একটি নির্বাচনের পক্ষে মন্ত্রী-সাংসদ ও কতিপয় বুদ্ধিজীবী যেভাবে মুখর, তাতে দুই কান কাটা-সম্পর্কিত গল্পই মনে পড়ে। এবারের এই নির্বাচনে সবচেয়ে বড় আপত্তির বিষয়, সবই হচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নামে।
আওয়ামী লীগ সরকার তার যাবতীয় কাজের ব্যানার হিসেবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে। যে সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা আপ্তবাক্য হিসেবে ব্যবহার করে, তার ভূমিকার বিশিষ্টতা কী হবে? বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের দুর্নীতি, দখল, সন্ত্রাস, স্বেচ্ছাচারিতা, দলীয়করণ—এসব মহাজোট সরকারের মধ্যে কোনোভাবেই কম ছিল না, বরং অনেক ক্ষেত্রে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত নির্বাচনের হলফনামা থেকে বাংলাদেশের মানুষ জেনেছে, এই সরকারের মন্ত্রী-সাংসদেরা গত কয়েক বছরে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন, চার বছরে দুই গুণ থেকে এক হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে সম্পদ। কীভাবে বৃদ্ধি পেল, তার ব্যাখ্যা স্পষ্ট নয়। তা ছাড়া এই ঘোষিত সম্পদের তথ্য যে খুবই অসম্পূর্ণ, সেটাও সবাই জানে। হল-মার্ক, শেয়ারবাজারসহ হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের খবর ঢাকা দেওয়া যায়নি। কেন সরকারি দল একতরফা নির্বাচন-প্রশ্নে অনমনীয়, কেন ক্ষমতা যেকোনো মূল্যে আঁকড়ে ধরে রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তার ব্যাখ্যা এই সম্পদ উপার্জনের প্রক্রিয়া ও তার নিরাপত্তার প্রশ্ন থেকেই বোঝা সম্ভব। ক্ষমতার কারণে যে বিপুল সম্পদ এসেছে, ক্ষমতায় না থাকলে তার নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হবে? এ ছাড়া আরও বড় বড় প্রকল্প, বড় বড় কমিশনের হাতছানি। এগুলো ঢাকতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর একাত্তরকে ব্যবহার।
মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান দিলেই কি যা খুশি তা-ই করার এখতিয়ার তৈরি হয়? না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল স্বৈরতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, আধিপত্য আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে; মানুষের মুক্ত একটি ভূখণ্ডের জন্য, গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে কখনোই মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার বিসর্জন দেওয়া হতে পারে না। গণতন্ত্রের সঙ্গে কখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কখনোই নিপীড়ন, প্রতারণা, বর্বরতা, বৈষম্য, আধিপত্য সমর্থন করতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কখনোই অপরাধীদের অপরাধের বর্ম হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চিহ্ন ব্যবহার অনুমোদন করতে পারে না।
প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের জন্য বিএনপির দুর্বৃত্ত শাসনকাল আর জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধ আশীর্বাদ হিসেবেই কাজ করছে। কেননা, এগুলো দেখিয়েই আওয়ামী লীগ তার সব জনস্বার্থবিরোধী তৎপরতার বৈধতা তৈরি করতে চেষ্টা করে। মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ মানেই মুক্তিযুদ্ধ নয়, জামায়াত মানেই ইসলাম নয়। বর্তমান সংঘাত আর সহিংসতা তাই মুক্তিযুদ্ধ আর ইসলামের নয়, অথচ সেভাবেই রং দেওয়ার চেষ্টা হয়। বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ আল্লাহর নাম নিয়েই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, আর জামায়াত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়ংকর গণহত্যা আর নির্যাতনের প্রধান শরিক হয়েছে ইসলামের নাম ব্যবহার করে। প্রকৃতপক্ষে, জামায়াতবিরোধিতা মানে একটি যুদ্ধাপরাধী ফ্যাসিবাদী দল ও মতাদর্শের বিরোধিতা। তারা নিজেদের অপকর্মের বর্ম হিসেবে ‘ইসলাম’ ব্যবহার করে, আর আওয়ামী লীগের আছে মুক্তিযুদ্ধ, বিএনপি সুবিধামতো সবকিছুতেই ভাগ বসাতে চেষ্টা করে, জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত থেকে নিজেদের জাতীয়তাবাদী নামে প্রচার করে।
১৯৭১ সালে পরাজিত হওয়ার পর জামায়াত বাংলাদেশে আর কখনো খুঁটি গাড়তে পারত না, যদি এ দেশে লুটেরা শক্তির অনুকূল রাজনীতি ও অর্থনীতি বিকশিত না হতো। স্বৈরতন্ত্র আর শ্রেণী-সমঝোতার মধ্য দিয়ে জামায়াতের পুনর্বাসন আর বিকাশ ঘটেছে। জিয়াউর রহমান এই কাজের সূচনা করেন। আশির দশকে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি-আওয়ামী লীগ উভয়ই জামায়াতকে অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করে। নব্বইয়ের দশক থেকে ধাপে ধাপে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নিজেদের ভোট ও ক্ষমতার বিবেচনায় জামায়াতকে জায়গা দিয়েছে, পরের দশকে বিএনপি তাদের মন্ত্রী বানিয়েছে। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলনে বিপর্যস্ত জামায়াতকে বড় উদ্ধার করেছে আওয়ামী লীগ, ১৯৯৬ সালে। ইতিহাস সাক্ষী, প্রশাসনের সমর্থন ও দুই দলের ভোটের রাজনীতির কূটকৌশলই জামায়াতকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তার শক্তি বৃদ্ধি করেছে।
জামায়াতের ভয়ংকর অতীত আর সন্ত্রাসী শক্তি বৃদ্ধির ভবিষ্যৎ আশঙ্কা থেকে অনেকে আওয়ামী লীগের ওপর ভর করা অনিবার্য মনে করে। কিন্তু লুটেরা অগণতান্ত্রিক সন্ত্রাসী তৎপরতাকে বৈধতা দিয়ে কি ধর্মভিত্তিক ফ্যাসিবাদী তৎপরতা মোকাবিলা করা সম্ভব? মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কলঙ্কিত করে কি দেশের কোনো অগ্রসর ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব? না।
২০০৮ সালের নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুর ওপর দাঁড়িয়েই আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করে। ক্ষমতায় আসার পর এ বিষয়ে পদক্ষেপও নেয়। বহুপ্রতীক্ষিত এই বিচার সবাইকে আশাবাদী করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের সব রকম তৎপরতা প্রমাণ দিচ্ছে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের এই ইস্যুটিকে এখন তারা বরং তাদের নানা অপকর্ম ও ব্যর্থতাকে বৈধতা দেওয়ার কাজে ব্যবহার করতে চাইছে। ক্ষমতা ধরে রাখার লক্ষ্যের অধীনে রেখেছে এই গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যকে। এবারের ক্ষমতাকালে অনেক কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ, আর তার সর্বশেষ একতরফা নির্বাচন। কৌশলচর্চা এত বেশি হয়েছে যে এর ফলে প্রথমত, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে সক্রিয় প্রায় সব গ্রুপের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এটাই প্রতিষ্ঠা করেছে যে যারা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র কথা বলে ক্ষমতায় থাকতে চায়, তারা গণতন্ত্রচর্চায় বিশ্বাসী নয়, দখল-লুণ্ঠনে মোটেই বিচলিত নয়। তৃতীয়ত, অর্থনীতির শক্তির জায়গাগুলো চরম সংকটের মধ্যে পড়েছে। চতুর্থত, সংকট আর অনিশ্চয়তায় বাংলাদেশের অস্তিত্বই নাজুক অবস্থায় পড়েছে।
সরকারি দলের সীমাহীন লোভ ও যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টায় ২০১৩ সাল পরিণত হয়েছে লাশের বছরে। রক্ত, কান্না, নিপীড়ন, আগুন, অনিশ্চয়তার কাল হিসেবেই ভবিষ্যতে এই বছর চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তার ধারাবাহিকতাতেই ২০১৪ শুরু হলো। যারা কিশোর ত্বকীর ক্ষতবিক্ষত লাশ তৈরি করেছিল, তারা এখন আরও ক্ষমতাধর, প্রহসনের নির্বাচনে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আরও উদ্ধত, তাদেরই একজন এখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের বিচার হলো না। বিশ্বজিৎ হত্যার বিচারের গতি দেখে এটা বোঝা যাচ্ছে যে ভিডিও প্রমাণ এবং মিডিয়ায় প্রত্যক্ষ প্রমাণ বারবার প্রচারিত না হলে কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার সরকার করবে না। সংঘাত-সহিংসতায় যত লাশ জমল, যারা নিহত হলো, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই জমিদারি নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত বিভিন্ন দলের বাইরের মানুষ। পুলিশের গুলি, ক্রসফায়ার, নাশকতা, বোমাবাজি, পিটিয়ে হত্যা, আগুন দিয়ে হত্যা—সবই ঘটল। ক্ষমতার খেলা কতটা হিংস্র, কতটা স্বৈরতন্ত্রী হতে পারে, সেটা দেখিয়েছে এই বছর। যুদ্ধাপরাধীরা রাজনৈতিক খেলার মধ্য দিয়ে কীভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, তারও বহিঃপ্রকাশ ঘটল এ বছরই। কত মানুষ সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হলো, কত মানুষের জীবনের আশা-ভরসা শেষ হলো, কত মানুষের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত হলো, বৃক্ষরাজিসহ কত সম্পদ বিনষ্ট হলো, তার কোনো হিসাব কখনো পাওয়া যাবে না। রানা প্লাজার সহস্রাধিক শ্রমিকের লাশের হাড়গোড়ের টুকরা এখনো আমাদের সামনে হাজির হয়। এখনো নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণের ঘোষণাও শোনেনি। শুধু ভবন নয়, দুর্নীতি আর ভুল নীতির কারণে পুরো দেশই এখন ধসে পড়ার মুখে।
বাংলাদেশ ও তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কে সিদ্ধান্ত নেবে? বাংলাদেশের নির্বাচিত সংস্থা, রাজনীতিবিদ ও নাগরিকেরা, নাকি ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা জাতিসংঘ? দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি যখন ক্ষমতার জমিদারি বা গোত্রীয় সংঘাতে পুরো দেশকে ডোবাচ্ছে, তখন বাইরের দেশ ও সংস্থা বা ‘তৃতীয় শক্তির’ প্রত্যাশা করার বিষয়টি কাম্য হতে পারে না। দলের স্বার্থে অন্ধ না হলে যে কেউ স্বীকার করবেন, এটি খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দরকার দলীয় অন্ধত্ব ছেড়ে দেশ ও মানুষের দিকে তাকানো, ১৯৭১ সালসহ এ দেশের মানুষের দীর্ঘ লড়াইয়ের অন্তর্গত শক্তিতে স্বাধীন অবস্থান তৈরি করা, দাসত্বের শৃঙ্খল বোঝানোর মতো স্বাধীনতার বোধে উত্তীর্ণ হওয়া। এই কাজে জনপন্থী রাজনীতির ভূমিকাই প্রধান, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের দায়িত্বও কম নয়।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।