আমজনতার জন্য কোনো সুসংবাদ থাকবে কি

.
.

গেল সপ্তাহে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেছে। প্রতিটি নিয়েই আলোচনা করা কিংবা কলাম লেখা যায়। যেমন নিশুতি রাতে বিএনপির গুলশান অফিসে পুলিশের হানা, আগামী নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করা কিংবা না-করা নিয়ে দুই প্রতিবেশীর বাদানুবাদ, এয়ারপোর্ট রোডে বামন বৃক্ষ লাগানোর খেয়াল, অজানা চিকুনগুনিয়া জ্বরের হঠাৎ হামলা, সুপ্রিম কোর্টের আঙিনা থেকে ভাস্কর্য গায়েব করা ইত্যাদি। ইতিমধ্যে রেইনট্রি হোটেল এবং আপন জুয়েলার্স খবর হিসেবে কোণঠাসা হয়ে গেছে। রামপালের আলোচনাও থমকে গেছে। ধারণা করছি, এ সপ্তাহে আরও দু-চারটি ঘটনা ঘটবে এবং আমরা নতুন কিছুর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ব।

ইতিমধ্যে আমাদের বায়তুল মালের রক্ষক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর পরবর্তী অভিযানটি প্রায় সাজিয়ে এনেছেন। জুনে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশনে তিনি গেল বছরের অর্থনীতির সুরতহাল রিপোর্ট এবং আগামী বছরের জন্য নতুন হিসাব খুলতে যাচ্ছেন। এ নিয়ে আমাদের গণমাধ্যম, সেমিনার রুম এবং রাজপথ মাসজুড়ে গরম থাকবে। জ্যৈষ্ঠের দাবদাহের সঙ্গে বাজেটের উত্তাপ মিলেমিশে মধ্যবিত্তের ব্রহ্মতালু জ্বলবে। নিম্নবিত্তের কথা ভেবে লাভ নেই। তারা শুধুই একটি সংখ্যা।
অর্থমন্ত্রী এবার তাঁর ১৩তম বাজেটটি দিতে যাচ্ছেন। এটা বাংলাদেশের জন্য নাকি একটা রেকর্ড। সুতরাং, আকারে এবং প্রকারে তিনি আরও কিছু রেকর্ড করতে চান। তাঁর প্রশ্রয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দেশের ১৬ কোটি মানুষের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে। কারণ একটাই। খাজনা বেশি বেশি আদায় করতে হবে। পদ্মা সেতুর মতো কিছু মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তহবিলে টান পড়েছে। তার জোগান আসবে কোথা থেকে?
বিএনপির সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত সাইফুর রহমান এ দেশে প্রথমবারের মতো ভ্যাট চালু করেছিলেন। তখন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ থেকে শোরগোল হয়েছিল, অনেক আওয়ামী নেতা এর বিরুদ্ধে পথেঘাটে এবং সংসদে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন। এখন বোঝা যাচ্ছে, বিএনপি সব কাজ খারাপ করেনি। বাজেটের নানান কিছু, বিশেষ করে ভ্যাটের ব্যাপারটি বর্তমান সরকারের খুবই পছন্দ। তারা এর ছিদ্রহীন জালে পুরো দেশটাই ঢেকে দিতে চাচ্ছে।
খাজনা আদায়ের চল আছে প্রাচীনকাল থেকেই। খাজনা আদায়ের পেছনে যে মানসিকতা এবং আদায়ের যে পদ্ধতি, তাতে সামন্ত প্রভুদের আমল থেকে হাল আমলের ফারাক অতি সামান্যই। কাগজে-কলমে এবং চলনে-বলনে দেশ যতই আধুনিক হোক না কেন, এ দেশে সরকার মানেই খাজনা আদায়কারী এবং জনগণ মানেই খাজনা দেনেওয়ালা।
এ দেশের মানুষ সহজে খাজনা দিতে চান না বলে সরকারি মহলে অভিযোগ আছে। একজন নাগরিক কেন খাজনা দিতে আগ্রহী হন না বা কম দিতে চান, তার পেছনে নিশ্চয় কারণ আছে। এখানে রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্কটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিকেরা যদি মনে করেন, তাঁরা রাষ্ট্র তৈরি করেছেন এবং এর দেখভাল করার দায়িত্ব তাঁদের, তাহলে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই তাঁদের খাজনা দেওয়ার কথা। নাহলে রাষ্ট্র কীভাবে চলবে? কিন্তু নাগরিকেরা যদি মনে করেন, তাঁদের দেওয়া খাজনার অনেকটাই লোপাট হয়ে যাচ্ছে এবং রাষ্ট্রের ওপর তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তাহলে তাঁরা প্রশ্ন করতেই পারেন—খাজনা দেব কেন?
ইদানীং পত্রপত্রিকায় আমরা বেশ কিছু রোমহর্ষ খবর দেখেছি। দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বাইরে পাচার হয়ে গেছে এবং এই ধারা এখনো জারি আছে। ব্যাংকগুলোতে রীতিমতো ডাকাতি হচ্ছে। সরকারি দালান তৈরি করতে রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার করা হচ্ছে। ছয় মাসের কাজ ছয় বছরেও শেষ হচ্ছে না, দফায় দফায় তার খরচ বাড়ছে। সোজা কথা, সাধারণ মানুষের কষ্টে আয় করা টাকা নিয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ড হচ্ছে এবং এ ক্ষেত্রে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির যথেষ্ট ঘাটতি আছে। আমরা অনেক বয়ান শুনছি যে দেশ অনেক বছর অনুন্নয়নের চোরাগলিতে আটকে পড়ে ছিল। এখন আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে আছি। দেশটা ২০২১ সালের মধ্যে তো বটেই, তার আগেই মধ্য আয়ের দেশ হয়ে যাচ্ছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ‘উন্নত’ (উচ্চ আয়ের কথা বলা হচ্ছে না) দেশ হয়ে যাবে। এ জন্য চাই বিপুল আয়োজন, প্রচুর বিনিয়োগ। সে জন্য প্রকল্পের পর প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এসব বিনিয়োগের জোগান আসবে কোথা থেকে? সুতরাং, গেরস্তের কোঁচড়ে হাত দিতেই হয়। অর্থমন্ত্রী এবার দেশের বৃহত্তম বাজেটটি দিতে যাচ্ছেন। সে জন্য যেভাবে পারেন, সেভাবেই চেপে ধরছেন আমাদের টাকার জোগান দেওয়ার জন্য। রাষ্ট্রের হাত অনেক লম্বা। মানুষ হয়তো ঠিকঠাক খাজনা দেবে। কিন্তু খুশিমনে দেবে কি?
দেশে অনেক সরকারি সংস্থা আছে। আমি তাদের নাম উল্লেখ করতে চাই না। কারণ, তাতে তারা গোস্সা করবে। আমরা সবাই জানি, এসব সংস্থা একেকটি সাদা হাতি। এসব জায়গায় যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা বেতন-ভাতা নিয়মিত হাতিয়ে নেন। অবসরে যাওয়ার সময় ছেঁকে নেন বিপুল পরিমাণ টাকা। এসব চাকরিজীবী ও তাঁদের পোষ্যরাই এসব সংস্থার একমাত্র উপকারভোগী। জনগণের কোনো কাজে আসে না এরা। অথচ এদের খাই-খরচ জনগণকেই মেটাতে হয়।
একদিকে জনগণের সম্পদ লুট হচ্ছে, অন্যদিকে অপচয়ের ভারও জনগণকে বইতে হচ্ছে। সম্প্রতি জানা গেছে, সরকারি চিনিকলে চিনির উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম দামে বাজারে চিনি পাওয়া যায়। এত টাকা ভর্তুকি দিয়ে চিনিকল চালানোর দরকার কী? এতে কি সমাজতন্ত্র কায়েম হচ্ছে? ব্যবসা বা শিল্প ভর্তুকি দিয়ে চালাতে হবে কেন? তা-ও আবার বছরের পর বছর? জনগণ কেন এ জন্য খাজনা দেবে? তাদের কী দায় পড়েছে? জাতীয় সংসদের সদস্যরা প্রতিবছর কিছু থোক বরাদ্দ পান। এই টাকা তাঁদের পছন্দের প্রকল্পের পেছনে খরচ করেন। এ–যাবৎ তাঁরা যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন, তার একটা সুষ্ঠু মূল্যায়ন হওয়া দরকার। হয়তো এটা হবে না। এবার হয়তো বরাদ্দ আরও বাড়বে। কারণ একটাই—সামনে নির্বাচন। জনতুষ্টির জন্য অনেক খরচ হয়তো করতে হবে তাঁদের।
আগে আমরা একটা কথা প্রায়ই শুনতাম: ‘সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল’, কিংবা ‘টাকা দেবে গৌরী সেন’। কোনো এক সময় জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘মানি ইজ নট আ প্রবলেম।’
এখন তো মুড়ি-মুড়কির মতো টাকা বরাদ্দ হয় নানান ভৌতিক প্রকল্পে। কিন্তু কথা হলো, টাকাটা সরকারেরও না, কোনো গৌরী সেনেরও না। টাকাটা পাবলিকের। সরকার হলো জনগণের টাকার হেফাজতকারী। আমানতের খেয়ানত অতি গুনাহর কাজ। জনগণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রতিটি সরকার এই কুকাজ করে যাচ্ছে। এটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে তার দিকে তর্জনী তুলে বলা হয়, ওরা উন্নয়ন চায় না।
লুটপাট ও অপচয় কমানো গেলে অল্প বাজেটে অনেক কাজ করা যায়। এতে সাধারণ করদাতারা স্বস্তিতে থাকেন। এবং মনে করেন যে তাঁদের টাকা তাঁদের জন্যই খরচ করা হচ্ছে। উন্নয়ন তো অবশ্যই দরকার। কিন্তু ৩০ কোটি টাকার কাজ ৩০০ কোটিতে করার মধ্যে বাহাদুরির কী আছে? এ দেশে মহাসড়ক বা রেলপথ তৈরির জন্য কিলোমিটারপ্রতি যে খরচের কথা আমরা জেনেছি, তা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। অর্থমন্ত্রী যদি এ ব্যাপারে একটা ব্যাখ্যা দিতেন, তাহলে আমরা তাঁর প্রতি আরও আস্থাশীল হতে পারতাম। এটা নিশ্চয়ই কোনো ‘রাবিশ’ প্রশ্ন নয়?
একসময় খুব সিনেমা দেখতাম, সিনেমা হলে গিয়ে। পত্রিকায় চটকদার বিজ্ঞাপন থাকত। যেমন আসিতেছে, শীঘ্রই আসিতেছে কিংবা মহাসমারোহে আসিতেছে, নাচে-গানে ভরপুর, আংশিক রঙিন ইত্যাদি। এখন মহাসমারোহে বাজেট আসে। জাতীয় সংসদে কয়েক সপ্তাহ ধরে কথাবার্তা হয়, বাজেট নিয়ে আলোচনার চেয়ে ৫০ গুণ বেশি গালিগালাজ হয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। সবাই বাজেটটি পড়েও দেখেন না। ছোট-বড় কিছু রাজনৈতিক দল এখনই হয়তো তাদের কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট–বক্তৃতা শেষ হওয়ার ১০ সেকেন্ডের মধ্যেই তাদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া জানা যাবে। তারা কে কী বলবে, তা এখনই বলে দেওয়া যায়। বাজেট–বক্তৃতায় যেমন বাগাড়ম্বর থাকে, বাজেট-প্রতিক্রিয়ায়ও তার কমতি দেখা যায় না। এ দেশে ছায়া বাজেট দেওয়ার রেওয়াজ গড়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সে সক্ষমতা তৈরি হয়নি।
একজন নাগরিক হিসেবে আমি অর্থমন্ত্রীর কাছে একটাই অনুরোধ জানাব, সরকারি খাতে অপচয় কমানোর লক্ষ্যে আপনার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আছে কি না। বাজেট–বক্তৃতা দেওয়ার আগে আপনি কোন রঙের ব্রিফকেস নিয়ে সংসদকক্ষে ঢুকছেন, কিংবা বক্তৃতা দেওয়ার সময় কয় গ্লাস পানি খেলেন, এ নিয়ে সংবাদ হবে। কিন্তু ‘আমজনতার’ জন্য কোনো সুসংবাদ থাকবে কি না, এ নিয়ে আমার মনে ঘোরতর সন্দেহ আছে। আমার আশঙ্কা, এবারের বাজেটটিও থোড় বড়ি খাড়া কিংবা খাড়া বড়ি থোড় না হয়ে যায়।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
[email protected]