বিএনপির 'ভিশন-২০৩০' এবং জনপ্রশাসন

.
.

সপ্তাহ দুই আগে বিএনপি ‘ভিশন-২০৩০’ শিরোনামে দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেছে। এতে অনেক রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের আশ্বাস এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি বাদ দিয়ে ভবিষ্যৎমুখী রাজনীতির লক্ষ্য ঘোষিত হয়। এসব বিষয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশ কিছু লেখালেখি এবং বক্তৃতা-বিবৃতি হয়েছে। প্রক্রিয়াটি চলমান। কেউ কেউ বলছেন, এটা নির্বাচনের আগাম ইশতেহার। হতে পারে। এতে দোষের কিছু আছে বলে মনে হয় না। তবে দেখা দরকার প্রতিশ্রুতিগুলো সুস্পষ্ট, গণমুখী ও বাস্তবায়নযোগ্য কি না। খবরের কাগজ থেকে দেখা যায়, ৩৭টি বিষয়ে ২৫৬টি দফা রয়েছে এতে। পাইকারিভাবে গোটা ভিশন বা রূপকল্প নিয়ে আলোচনা অনেক বড় ব্যাপার। তবে দু-একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করলে এর বিভিন্ন দিক উঠে আসে। ঠিক তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে জনপ্রশাসন। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদের আইনানুগ কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্ব জনপ্রশাসনের। তাই সে জনপ্রশাসনে দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবী লোকদের সমন্বয় ঘটাতে হবে, এ বিষয়ে কেউ ভিন্নমত পোষণ করেন না। তবে বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন উল্টো পথে চলা প্রতিষ্ঠানটিকে সঠিক পথে ফেরানোর তেমন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে না।

আলোচনা হতে পারে ‘ভিশন-২০৩০’ এ বিষয়ে কী বক্তব্য রেখেছে। আমরা খবরের কাগজে যতটুকু দেখি, এখানে সুশাসন অনুচ্ছেদের একটি দফায় বলা হয়েছে, জনপ্রশাসন, বিচার, পুলিশ, কারাগার—এ চার প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কার করা হবে। প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা, সততা ও মেধার উৎকর্ষ এবং সৃজনশীলতাকে বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনে যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করা হবে। কথাগুলো মোটেই স্পষ্ট নয়। সংস্কারের ধরনটি কেমন হতে পারে, তার কোনো সংক্ষিপ্ত ধারণাই দেওয়া হয়নি। উল্লেখ নেই এসব ক্ষেত্রে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পর্কে। অথচ যথাযথ মেধাবী লোক নিয়োগ দিতে পারলেই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতার উৎকর্ষ বিধান সম্ভব। ধারণা করা অসংগত নয় যে কৌশলগত কারণেই নিয়োগ পর্বের বিষয়টি চেপে যাওয়া হয়েছে। আমাদের নিয়োগ পর্বে দীর্ঘকাল চলমান কোটা প্রথার জন্য মেধাবীরা প্রান্তজন হয়ে গেছেন। প্রাধিকার কোটাতেই চলে যায় ৫৫ শতাংশ পদ। ২০০৮-এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তাদের ‘দিনবদলের সনদে’ নিয়োগে মেধাবীদের আকৃষ্ট করার কথা বলেছিল। ক্ষমতায় গিয়েও জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্রে সরকার মেধাকে প্রাধান্য দিয়ে কোটাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে করেনি। অবশ্য চাকরিতে মেধাবীদের টেনে আনতে একটি আকর্ষণীয় বেতন স্কেল তারা দিয়েছে। এতে কিছু সুফল পাওয়া যাবে। তবে মূল সমস্যায় হাতই দেয়নি। তেমনি বিএনপিও সম্ভবত তা দিতে চায় না। তাদের দুই মেয়াদের শাসনকালে তো তা করা হয়নি। অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে তাদের পোষ্যদের জন্যও সম্প্রসারণ করেছে। পরবর্তী বিএনপি সরকার সেটা মেনেও নিয়েছে।

আমাদের সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মে সবার নিয়োগলাভের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। অবশ্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী বা অঞ্চলের জন্য বিশেষ সংরক্ষণের। এরই ফলে মহিলা, জেলা ও উপজাতি কোটা দেওয়া রয়েছে। আর স্বাধীনতার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধা এবং তারপর তাদের পোষ্য কোটা চলছে সংবিধানের কোনো সমর্থন ছাড়াই। আর তাও মোট পদের শতকরা ৩০ শতাংশ। ড. আকবর আলি খান ব্যাপক প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ একজন সুপণ্ডিত। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও। তাঁর সদ্য প্রকাশিত অবাক বাংলাদেশ-বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি বইটিতে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে শুধু পরীক্ষায় ভালো করলেই চাকরি পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে অধিকাংশ পদে কোটার ভিত্তিতে চাকরি দেওয়া হয়।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা রয়েছে, অথচ যথেষ্ট মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী নেই। তাই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তবে সংবিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে এই সুবিধা সবাইকে দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে না, শুধু যাঁরা দুস্থ মুক্তিযোদ্ধার পরিবার, তাঁদের ক্ষেত্রে কোটা দেওয়া যেতে পারে। সুতরাং আস্তে আস্তে এই কোটা হ্রাস করে বিলুপ্ত করতে হবে।’

ভারত বিভিন্ন জাতি-উপজাতির দেশ। রয়েছে অনেক অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি)। আর তারাই মোট জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ। তাদের ভারতীয় জনগণের মূল স্রোতে আনার জন্যও রয়েছে কোটাব্যবস্থা। আর ১৯৭৮ সালে সেটা পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দিতে বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিপি মণ্ডলের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন কোটাব্যবস্থার ব্যাপক সম্প্রসারণের অনুকূলে প্রতিবেদন দেয়। দীর্ঘদিন ফেলে রাখার পর ১৯৯০-এ এটার অংশবিশেষ বাস্তবায়ন হয়েছে। ভারতে কোটা আছে তফসিলি জাতি ও উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির। অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বলে যে বড় অঙ্কের কোটাটি আছে, সেখানে প্রবেশাধিকার মূলত প্রথম প্রজন্মের। তাদের কারও পিতা-মাতা সাংবিধানিক পদাধিকারী কিংবা প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি, একটি নির্দিষ্ট আয়ের বেসরকারি চাকরি অথবা ব্যবসা ইত্যাদিতে সংশ্লিষ্ট থাকলে তারা সে কোটা ভোগের জন্য অনুপযুক্ত বিবেচিত হয়। আমাদের মতোই ধর্মের ভিত্তিতে নেই কোনো কোটা বিভাজন। উল্লেখ্য, ২০০৫ সালে গঠিত দিল্লি হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি রাজিন্দার সাচার কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে ভারতে মুসলমান সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ১৪ শতাংশ। সে কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে সম্প্রদায়টির আর্থসামাজিক অবস্থা তফসিলি জাতি বা উপজাতির চেয়েও অনগ্রসর। সরকারি চাকরিতে তাদের শতকরা হার আড়াই শতাংশ। এ প্রতিবেদনে তাদের উন্নয়নের জনে্য আইনি সুরক্ষার সুপারিশ করা হয়েছে। পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে সরকার এখন মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের অধিকসংখ্যক বৃত্তি দিচ্ছে। এ ধর্মাবলম্বী জোলা, চর্মকার ইত্যাদি পেশার লোক কিন্তু অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে কোটা–সুবিধা ভোগ করে। কোটা নিয়ে সতর্ক থাকতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের অনেক আদেশ রয়েছে। চাকরির গুণগত মান যাতে কমে না যায়, সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে বারবার।

কোটাব্যবস্থায় নতুন একটা সুবিধাবাদ চালু হয় বলে ভারতীয় অনেক বিশ্লেষক মতামত দিয়েছেন। তাঁদের মতে, কোনো একটি গোষ্ঠীর জন্য নির্দিষ্ট কোটা সেই গোষ্ঠীর অগ্রসরমাণ লোকগুলোই পেয়ে থাকে। এমনটা আমরা দেখছি উপজাতি (ক্ষুদ্র জাতিসত্তা) কোটা থেকে। লক্ষণীয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩টি উপজাতির মধ্যে কোটার সুবিধা নিতে পারছে মোটামুটি ৪টি। সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগুলো অনেকটা আঁধারেই আছে। গারো, হাজং, মণিপুরি দু-চারজন দেখা গেলেও সাঁওতাল, কোচ, মুন্ডা গোত্রের কেউ বিসিএসে আছেন, এমনটা নজরে পড়েনি। শতকরা ৫ শতাংশ কিন্তু কম নয়। জানা যায়, যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায় না। অনগ্রসরদের টেনে তোলার কোনো উদ্যোগও নেই। আর সে উদ্যোগ অবশ্যই নিতে হবে, প্রয়োজন হলে কোটার উপবিভাগ করে।

উল্লেখ করা সংগত, মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য যাঁরা সরকারি চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মও তা পাচ্ছেন একই কারণে। উঁচু মেধার প্রার্থীদের বাদ রেখে প্রাধিকার কোটার বলে অনেক কম মেধাবী গুরুত্বপূর্ণ চাকরিগুলোতে ক্রমান্বয়ে প্রবেশ করছেন। যথেষ্ট প্রার্থী পাওয়া যায় না। অনেক সময় খালি রাখা হয়। কখনো বা করুণা করে ছেড়ে দেওয়া হয় মেধা কোটার জন্য। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো বক্তব্য রইল না বিএনপির ‘ভিশন-২০৩০’-এ। তাদের আগের শাসনকালে দলীয়করণের যে চিত্র আমরা দেখেছি, এ থেকে বের হয়ে আসতে পারবে কি দলটি? তদুপরি গোটা শাসনব্যবস্থায় দলবাজির যে চিত্র সৃষ্ট হয়েছে, এ থেকে পেশাদারির নিরিখে কারা সরকার পরিচালনা করবে, এটা বোধগম্য নয়। সদিচ্ছা যদি থাকেও তাহলে এ প্রতিষ্ঠানকে সঠিক পথে আনা সহজ কাজ নয়। ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে সে লক্ষ্যে। এখনো ভালো কর্মকর্তা অনেক আছেন। তাঁদের দলবাজি বৈরী পরিবেশে চাকরি বা পদায়ন টিকিয়ে রাখার জন্য। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে পেশাদারির নিরিখে ঘুরে দাঁড়াবে।

তবে এর কোনো রূপরেখা কিন্তু খবরের কাগজে প্রকাশিত ‘ভিশন-২০৩০’ দলিলে দেখা গেল না। অনেক দিন খেটে এটি তৈরি করা হয়েছে। তবু অসম্পূর্ণতায় ভরপুর। স্ববিরোধিতাও আছে প্রচুর। ঠিক তেমনি দক্ষ, গতিশীল ও মেধাবী কর্মকর্তার সমন্বয়ে জনপ্রশাসন পরিচালনার প্রত্যয় থাকলেও এর নিয়োগপর্বে অবিবেচনাপ্রসূত পরিমাণে কোটা ্যবস্থার সংস্কার ও মেধাকে প্রাধান্য দেওয়ার কোনো ঘোষণাই নেই। গতানুগতিক কিছু ভালো কথা ছাড়া জনপ্রশাসনের জন্য এ রূপকল্পে নতুন কিছু নেই, বললে অসংগত হবে না।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
[email protected]