অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক

ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর রঘুরাম রাজনের বিখ্যাত গ্রন্থ ফল্ট লাইনস পড়তে গিয়ে বইটি নিয়ে আলোচনা লেখার একটা অন্তর্গত তাগিদ অনুভব করার পর হাতে আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট। উল্লেখ্য, ৬৫০ পৃষ্ঠার বইটি ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে দেওয়া ড. রহমানের ২১৩টি বক্তৃতার সংকলন। রঘুরাম রাজনের গ্রন্থটি মূলত বিশ্ব অর্থনীতির কতগুলো ভবিষ্যৎ হুমকি এবং আশঙ্কা নিয়ে লেখা, পক্ষান্তরে আতিউর রহমানের বক্তৃতামালার সংকলনটির প্রায় সর্বতোভাবে বাংলাদেশের পটভূমিতে গাঁথা। এমনকি বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে যে একটা পরিচ্ছেদ আছে, সেখানেও এসে গেছে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শেষোক্তটি আলোচনার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়।
উল্লেখ্য, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় আতিউর রহমানের আরও বহু প্রকাশনা রয়েছে। কিন্তু আলোচ্য গ্রন্থটি কয়েকটি কারণে বিশেষত্বের দাবি রাখে। প্রথমত, গ্রন্থটি বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে দেওয়া বক্তৃতার সংকলন হলেও বক্তৃতাগুলো কেবল প্রথাবদ্ধ ভাষণ নয়, প্রতিটি খণ্ডই বক্তার চিন্তা ও আগ্রহপ্রসূত একেকটি নিবন্ধ; যা বক্তৃতার আকারে পাঠ করা হয়েছে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। নিতান্ত নিয়মরক্ষা এবং আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের প্রথাবদ্ধ যে ভাষণ বা অভিভাষণ সাধারণত পঠিত হয়ে থাকে, গ্রন্থভুক্ত বক্তৃতা বা নিবন্ধগুলো সে পর্যায়ভুক্ত নয়। এগুলোর সবই বাংলাদেশের ব্যাংকিং এবং অর্থনীতি নিয়ে সুচিন্তিত মতামত ও ভাবনার একটা সুসমন্বিত প্রকাশ। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের গ্রন্থ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিরল। তৃতীয়ত, গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এবং সম্পাদনা করেছেন বিআইবিএমের মহাপরিচালক। বিআইবিএমের মতো একটি প্রতিষ্ঠান যখন একটি সারগর্ভ গ্রন্থ প্রকাশ করে, তখন স্বভাবতই বোঝা যায়, বইটির উপাদান ও বিষয়বস্তু ব্যাংক এবং অর্থনীতি-নির্ভর।
বিষয়বস্তু বিভাজন এবং উপযুক্ত শনাক্তকরণের জন্য নিবন্ধগুলোকে মোট নয়টি পরিচ্ছেদে ভাগ করা হয়েছে। যেমন—১. কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং, মুদ্রা, রাজস্ব এবং বৈদেশিক মুদ্রানীতি, ২. প্রুডেনশিয়াল নীতিমালা, তত্ত্বাবধান, পুঁজি পর্যাপ্ততা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, করপোরেট সুশাসন, টাকা ধোলাই এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা, ৩. আর্থিক অন্তর্ভুক্তীকরণ, মোবাইল ব্যাংকিং, বর্গাচাষ, কৃষি ও এসএসমই ঋণদান, ৪. ক্ষুদ্রঋণ এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ৫. করপোরেট সামাজিক দায় ও সবুজ ব্যাংকিং, ৬. ডিজিটাল বাংলাদেশ ও ব্যাংকে তথ্যপ্রযুক্তি, ৭. বাংলাদেশের অর্থনীতি, ৮. বিশ্ব অর্থনৈতিক বিষয়াবলি এবং ৯. অন্যান্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রসঙ্গ।
কৃষিবিষয়ক ভাবনা এবং পল্লিবাংলার কৃষকের নিত্য সমস্যা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্ণধারের এই নিবিড় নজরদারি ও উদ্বেগ হয়তো অনেকের কাছে প্রথাবিরুদ্ধ মনে হতে পারে, কিন্তু দেশের কৃষি সমস্যা এবং কৃষি উন্নয়নের দায়িত্বটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আদি ম্যান্ডেটেই উপস্থিত। ১৯৭২ সালের ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার’-এ খুব স্পষ্টভাবে দেশের কৃষি উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকার কথা বিধৃত আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশের দ্বিতীয় অধ্যায়ের নবম প্যারার তৃতীয় ধারায় বলা আছে, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গভর্নর এবং ডেপুটি গভর্নর ছাড়াও আরও চারজন পরিচালক নিযুক্ত হবেন, যাঁদের ব্যাংকিং, বাণিজ্য, শিল্প বা কৃষি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা আছে। শুধু এটুকুই নয়, তৃতীয় অধ্যায়ের ১৬ প্যারার একপর্যায়ে বলা আছে কৃষি উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকার কথা। ষষ্ঠ অধ্যায়ের দ্বিতীয় প্যারার এক জায়গায় বলা আছে কৃষি উপকরণ ও কৃষিঋণের কথা। সুতরাং, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কৃষি বা কৃষক সম্পর্কে উদ্বেগ নিয়ে কথা বলেন, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেবল মুদ্রানীতি, মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রা সরবরাহ, ব্যাংকিং খাত কিংবা সর্বোপরি আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার বাইরে ভিন্ন কিছু নিয়ে কাজ করবে না, ধারণাটি তাত্ত্বিক বা প্রায়োগিক কোনো অর্থেই সঠিক নয়।
উপরিউক্ত অনুসিদ্ধান্তের সমর্থনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুনর্নির্ধারিত ভূমিকার বিষয়ে এক ভাষণে আতিউর রহমান বলেন, ‘আর্থিক স্থিতিশীলতামুখী তত্ত্বাবধান শক্তিশালীকরণের বৈশ্বিক উদ্যোগ যে রকম কার্যকর, আমার সংশয় আছে ভবিষ্যৎ অস্থিতিশীলতার পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্য এসব যথেষ্ট কি না, যদি না আমরা ফাটকাবাজারি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দ্রুত লাভের সন্ধান করার পরিবর্তে সব শ্রেণীর জনগণের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন থেকে দীর্ঘমেয়াদি উৎকর্ষের খোঁজে আমাদের আর্থবাজার ও প্রতিষ্ঠানসমূহের মূল্যবোধ এবং উদ্দেশ্যসমূহকে সামাজিক দায়িত্বাভিমুখী করে পুনর্নির্ণয় না করি।’ (পৃষ্ঠা ৩১) তাঁর এ ভাবনা এবং অনুভবের কারণে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিগত কয়েক বছরে পুনর্নির্ধারণ করেছে তার ভূমিকা। আতিউর রহমান এই ভাষণেই স্বীকার করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুনর্নির্ধারিত ভূমিকার কথা, ‘আমাদের আর্থিক খাতের লক্ষ্যসমূহ, মূল্যবোধ সামাজিক ও পরিবেশগতভাবে দায়িত্ববোধাভিমুখী করে এই খাতের করপোরেট লক্ষ্যমাত্রা এবং উদ্দেশ্যসমূহ সামাজিক দায়বোধের মূলধারায় পরিচালিত করে এবং একটি সমন্বিত ও সামঞ্জস্যমূলক আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রচারণা চালু করার মাধ্যমে তার ভূমিকা পুনর্নির্ণয় করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অনুঘটকের ভূমিকা বেছে নিয়েছে, যাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বতঃস্ফূর্তি এবং আগ্রহ সহকারে অংশগ্রহণ করছে। এটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বাস্তবায়নে সরকারের আসন্ন ও দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনাকে এমনকি চলমান বৈশ্বিক মন্দার পটভূমিতেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শক্তিশালী উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থবহভাবে সাহায্য করছে।’
অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবা বা ব্যাংকিং বলতে বোঝায় সমাজের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে স্বল্প বা বিনা খরচে আর্থিক তথা ব্যাংকিংসেবার অন্তর্ভুক্ত করা। এই সেবার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো কৃষকদের জন্য মাত্র ১০ টাকায় কিংবা তৈরি পোশাকশ্রমিকদের ১০০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার বিধান। বিগত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় এই নতুন সেবা চালু হওয়ার পর আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকাণ্ডের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। ২০০৮ সালের শেষে ব্যাংকগুলোতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৭৬ লাখ, ২০১৩ সালের শেষ ভাগে এসে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় কোটির বেশি। নতুন আমানতকারীর সংখ্যা, অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং কার্যক্রমে তাঁদের কার্যকর সেবাপ্রাপ্তি কিংবা ব্যাংকগুলোর সেবা খরচ—এ-জাতীয় বিষয়গুলো অনিষ্পন্ন থাকলেও একটা বিশাল জনগোষ্ঠী যে নতুন এই সেবা কার্যক্রমের আওতায় এসেছে, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই সেবার পরিধি আরও বিস্তৃত করার জন্য তৈরি হচ্ছে এজেন্ট ব্যাংকিং নীতিমালা, যার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকিং সেবা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে আর্থিক সেবার অধীনে আনাই হবে এই নীতিমালার উদ্দেশ্য। এই সেবা প্রদানের জন্য এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে পারবে এনজিও, সমবায় সমিতি, মোবাইল ফোন কোম্পানির এজেন্ট, ওষুধের দোকান বা মুদি দোকান, পেট্রলপাম্প বা সিএনজি ফিলিং স্টেশন, যাদের কাজ হবে সীমিত আকারের জমা বা উত্তোলন, বিদেশি রেমিট্যান্স, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ, বিভিন্ন সেবা ফি জমা নেওয়া ইত্যাদি। এসব এজেন্টের কাজের তদারক করবে নিয়োগকারী ব্যাংকের কাছের শাখা। এজেন্ট ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু হলে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবার পরিধি লাভ করবে এক নতুন মাত্রা।
দক্ষিণ এশিয়ার স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকার কথা উঠে এসেছে বইয়ের একটি ভাষণে। খাদ্য উৎপাদন বা আমদানি, বিতরণ বা মজুত সব কার্যক্রমেই ব্যাংকের অংশগ্রহণ থাকে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে সরাসরি অবদান রাখতে পারে। তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল করণীয়গুলোর ঐক্য বোঝা যায় না, কিন্তু ঘনিষ্ঠভাবে দেখলে সহজেই বোঝা যায় যে খাদ্যনিরাপত্তার অনেকগুলো প্রধান পূর্বশর্তই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বজায় রাখতে চায়—এমন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিরও শর্ত। এসব শর্ত হিসেবে তিনি উপস্থাপন করেন সহায়ক মুদ্রানীতি, স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নিয়ামকের কথা, যার মাধ্যমে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর খাদ্য ক্রয়ক্ষমতা নিশ্চিত করা যায়।
গ্রন্থটির অধিকাংশ ভাষণ বা নিবন্ধ বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং স্বল্পোন্নত দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক তৎপরতা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর আতিউর রহমানের গভীর চিন্তা এবং পরম কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নের স্বপ্নের ফসল।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
[email protected]