মহেশ খালের বাঁধই একমাত্র সমস্যা নয়

মাত্র দেড় বছর আগে যাঁরা চট্টগ্রামের মহেশ খালে বাঁধ নির্মাণ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলেন, এত দিন পর সেই বাঁধ অপসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁরাই পক্ষান্তরে স্বীকার করে নিলেন, সেই উদ্যোগ ছিল ভুল। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর এই বাঁধের ভিত্তিফলক উন্মোচন করেছিলেন। ‘উন্নয়নের’ যেকোনো উদ্যোগেই তো নিজেদের সম্পৃক্তির কথা জানান দিতে ছাড়েন না মন্ত্রী বা সাংসদেরা। কিন্তু আজ যখন সেই বাঁধটি এলাকাবাসীর গলার ফাঁস হয়ে উঠল, তখন তার দায় কাঁধে নিতে নিশ্চয়ই তিনি আসবেন না। সম্ভাব্যতা যাচাই ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে উন্নয়ন বা সংস্কারের উদ্যোগগুলো যে অনেক সময় জনগণের ভোগান্তির বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়, মহেশ খালের বাঁধটি যেন তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। আমাদের ধারণা, চট্টগ্রামজুড়েই বিপুল অর্থ ব্যয় করে এখন যে উন্নয়নের মহাসমারোহ চলছে, তার মধ্যে এমন আরও বেশ কিছু প্রকল্প আছে, যেগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভবিষ্যতে এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।

চট্টগ্রামবাসী দিন কয়েক আগে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আতঙ্কে ছিলেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত কক্সবাজার-টেকনাফ-কুতুবদিয়াসহ উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও মোরা চট্টগ্রাম শহর ও আশপাশের এলাকায় বড় কামড় বসাতে পারেনি। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের অব্যবহিত পরে কয়েক দিনের ভারী বর্ষণে আগ্রাবাদ, হালিশহরসহ নগরের বেশ কিছু অঞ্চল তলিয়ে যায়। চট্টগ্রামবাসী অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার শিকার হওয়া এখন নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছেন। গত কয়েক বছরে অতিবৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন উপসর্গ, কর্ণফুলীর জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় নগরের বেশ কিছু এলাকা। তবে এবারের বর্ষণের পর আগ্রাবাদ-হালিশহরের বাসিন্দারা যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব। শহরের সড়ক আর নদীর মধ্যে পার্থক্যই ঘুচে গিয়েছিল যেন। শহুরে সড়কের ওপর নৌকা-সাম্পানে চড়ে পারাপার বা জাল ফেলে মাছ ধরার দৃশ্য যেমন দেখা গেছে, তেমনি কোমর ও বুকসমান পানি মাড়িয়ে হাসপাতালে যেতে দেখা গেছে রোগীদের। আগ্রাবাদ এলাকায় ‘মা ও শিশু হাসপাতালের’ নিচতলাটি ছিল পানির নিচে। অসুস্থ শিশুদের নিয়ে তাদের মা-বাবা ও ঘনিষ্ঠজনদের দুর্ভোগ তো সহজেই অনুমেয়। তার ওপর এসব এলাকায় দুই বা তিন দিন বিদ্যুৎ না থাকায় নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।

এই অভিজ্ঞতার পর মহেশ খালের বাঁধটি অপসারণের দাবি ওঠে। অথচ বৃহত্তর আগ্রাবাদ-হালিশহর জলাবদ্ধতা নিরসন কমিটির ব্যানারে এই বাঁধ নির্মাণের দাবিতে একসময় আন্দোলন করেছিলেন এলাকার কিছু মানুষ। স্থানীয় একজন সাংসদেরও সমর্থন ছিল এতে। সিটি করপোরেশনের অনুরোধে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করে বাঁধটি। বাঁধ নির্মাণের পক্ষে-বিপক্ষে এলাকাবাসী তখনই বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। সচেতন নাগরিক সমাজ নামের একটি সংগঠন তখন বাঁধ নির্মাণ বন্ধের দাবিতে স্মারকলিপিও দিয়েছিল বন্দর কর্তৃপক্ষকে। স্থানীয় সাংসদ এবং বন্দরের তৎকালীন চেয়ারম্যান তখন তাঁদের আশ্বস্ত করেছিলেন, এই অস্থায়ী বাঁধের কারণে এলাকাবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। তাঁদের যুক্তি ছিল, মহেশ খালের ওপর বাঁধ নির্মিত হলে কর্ণফুলীর জোয়ারের পানি শহরে ঢুকবে না। এ ছাড়া বৃষ্টির পানিসহ খালের অতিরিক্ত পানি পাম্পের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করলে আপাতত শহর এলাকায় পানি ওঠা বন্ধ হতে পারে। আর ছয় মাসের ভেতর জলকপাট (স্লুইসগেট) নির্মাণ করবে বন্দর। তখন এই বাঁধ ও পাম্পগুলো কাজে লাগবে।

বাঁধ নির্মাণকে ‘সাময়িক ব্যবস্থা’ এবং ছয় মাসের ভেতর জলকপাট নির্মাণের কথা তখন বারবার বলেছিলেন বন্দর কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সাংসদ এবং এই কাজে নিয়োজিত প্রকৌশলীরা। কেউ কথা রাখেননি। ছয় মাসের সময়সীমা এক বছর আগে অতিক্রান্ত হলেও জলকপাট নির্মাণের প্রতিশ্রুতিটি মনে রাখেননি তাঁরা। প্রকৃতি বিরূপ না হলে হয়তো মনেও পড়ত না। জনদুর্ভোগের ষোলোকলা পূর্ণ হওয়ার পর ১ জুন সিটি করপোরেশনের এক সভায় বাঁধটি অপসারণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে এ ব্যাপারে চিঠি দিয়ে অনুমতিও চাওয়া হয়েছে।

দেখা যাচ্ছে, জলাবদ্ধতা নিরসনের ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও বারবার এটি প্রধান ইস্যু হয়ে উঠেছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান তো হয়ইনি, উপরন্তু পরিস্থিতি আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী মনজুর আলমের কাছে মহিউদ্দিন চৌধুরীর হারের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই জলাবদ্ধতা নিরসনের ব্যর্থতাকে। ওই নির্বাচনের মাত্র দুই দিন আগে প্রবল বৃষ্টিপাতে জলমগ্ন শহরটি যেন আগের তিন মেয়াদে নির্বাচিত মেয়রের ব্যর্থতার একটি তাৎক্ষণিক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল। মনজুর আলমের নির্বাচনী অঙ্গীকারে জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল বটে, কিন্তু তাঁর মেয়াদেও তেমন কোনো অগ্রগতি চোখে পড়েনি। আর বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের কাঁধেও জলাবদ্ধতা নিরসনের দায় এসে পড়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে। ক্ষমতায় এসেই নাছির বলেছিলেন, এক বছরের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো সুসংবাদ দিতে পারবেন না। তবে নগরবাসীর ভোগান্তি যাতে কিছুটা কমে, তার জন্য খাল খনন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।

জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে রাজনীতিকদের মধ্যে সদিচ্ছা কতটুকু আছে জানি না। কিন্তু পরস্পরের ওপর দোষ চাপানোর প্রবণতা বন্ধ হয়নি। গত এপ্রিল মাসে বৃষ্টির পানিতে রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় আরও একবার নাকাল হয়েছিলেন নগরবাসী। ঠিক ওই সময়টাতেই চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামসংলগ্ন মাঠে একটি সুইমিংপুল নির্মাণ নিয়ে বিতর্ক চলছিল। আ জ ম নাছিরের এই উদ্যোগের বিরোধিতা করে আন্দোলনে নেমেছিল মহিউদ্দিন সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের একটি অংশ। এই সময়টাতে ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে জলমগ্ন শহরের ছবি দিয়ে অনেকেই নাছিরকে বিদ্রূপ করে লিখেছিলেন, ‘সারা শহরই তো এখন সুইমিংপুল!’ নাছিরের সমর্থকেরাও চুপ ছিলেন না। তাঁরা প্রবর্তক মোড়ে জলবেষ্টিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবির নিচে ব্যঙ্গাত্মক প্রশ্ন জুড়ে দিয়েছিলেন, ‘প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় কোন নদীর তীরে অবস্থিত?’ এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না প্রবর্তক মোড়ে বড় নালার ওপর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণ করে পানি নেমে যাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করার জন্য তখন সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী।

মহেশ খালের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এই খালের বাঁধটি অপসারণ করে কুমারখালী এলাকায় জলকপাট নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে সিটি করপোরেশন, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ সভায়। এর জন্য সময় লাগবে অন্তত ১৮ মাস। তবে বিশেষজ্ঞরা জলকপাট নির্মাণই একমাত্র সমাধান বলে মনে করছেন না। নালা-নর্দমাগুলো পরিষ্কার রাখা, নিয়মিত ড্রেজিং করা, খালের জায়গা দখল করে রাখা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে না পারলে কোনো উদ্যোগই শেষ পর্যন্ত কার্যকর হবে না। জলকপাট নির্মাণ যেহেতু সময়সাপেক্ষ, তার আগেই এই বাধাগুলো সরাতে হবে। শুধু মহেশ খাল কেন, চাক্তাই খালসহ নগরের সব খালকে দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার এখনই। কাজটি সহজ নয়। কেননা, এই দখলদারদের মধ্যে অনেকেই প্রভাবশালী। এখন দেখার বিষয়, ক্ষমতা গ্রহণের অব্যবহিত পর নগরের বিলবোর্ড অপসারণের ক্ষেত্রে মেয়রের যে অনমনীয়তার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল, তাঁর সেই মনোবল এখনো অটুট আছে কি না।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক  সাংবাদিক